অরিজিৎ গুহ

‘ওই যে ওই যে পালাচ্ছে ওদিক দিয়ে।’

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

‘ধর, ধর শালাকে। দেখিস যেন পালাতে না পারে।’

ধুপ ধাপ ধুপ ধাপ কয়েকটা পায়ের আওয়াজ। পেছন পেছন ভারী বুটের খট খট আওয়াজ। দৌড়াচ্ছে। প্রত্যেকেই দৌড়ে চলেছে। খালি পায়ের বা চটির আওয়াজগুলোও দৌড়ে চলেছে আর ভারী বুটের খটখট আওয়াজগুলোও দৌড়ে চলেছে।

সেন্ট্রাল এভিনিউর দিক থেকে গাড়ির আওয়াজ ভেসে আসছে মাঝেমাঝে। সরু সরু প্রায়ান্ধকার গলিগুলোতে কিছুক্ষণ আগেও লোকজনের চলাফেরা ছিল। হইচই ঠাট্টা মশকরা ছিল। সন্ধে থেকেই এই জায়গা হয়ে ওঠে নরক গুলজার। চলে অনেক রাত অব্দি। গভীর রাতে এখন সবকটা বাড়ির দরজাই প্রায় বন্ধ। রাস্তার আলোর নেভানো। ব্যবসা সেদিনের মত আপাতত শেষ। গলিগুলো প্রায় ফাঁকা।

সেই ফাঁকা গলির মুখ দিয়ে ভেতরের দিকে দৌড় লাগাল কয়েকটা ছেলে। পিছন পিছন ধর ধর বলে দৌড়ে আসছে আরো কয়েকটা লোক। হাতে তাদের উদ্যত পিস্তল। কাঁধের সাথে বেল্ট দিয়ে বাঁধা। নতুন কমিশনারের নির্দেশে পুলিশকে পিস্তল কাঁধের সাথে বেল্ট দিয়ে বেঁধে রাখতে হচ্ছে যাতে পিস্তল কেউ ছিনতাই না করতে পারে।

অশোক, সুবোধ আর যতীন — তিনজন তিনদিকে ছিটকে গেছে। কে কোথায় গেছে বলা মুশকিল। রাতের মিটিংটায় তিনজনেই একসাথে ছিল। বাগবাজারে অমলদার বাড়ির মিটিং শেষ হতে হতে এগারোটা বেজে গেছিল। তিনজনেই আরো কয়েকজনের সাথে পায়ে হেঁটে ফিরছিল। ওরা যাবে আমহার্স্ট স্ট্রিট আর বাকিরা যাবে মেডিকাল কলেজের মেসে। পুলিশের কাছে মনে হয় আগেই খবর ছিল। সেন্ট্রাল এভিনিউতে পড়তেই তাড়া করল সবাইকে।

অশোক দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে ছুটতে বাঁদিকের ছোট্ট সরু গলিতে ঢুকে ধাক্কা মারল একটা ঘরে। ভেতর থেকে একটা মেয়ের ঘুম জড়ানো গলা। কেএএএ? অশোক বলল ‘একটু দরজা খুলুন প্লিজ।’ দূরে শোনা গেল পিস্তলের গর্জন। গুড়ুম। আর তার সাথে কারো একজনের চিৎকার ‘কমরেড চারু মজুমদার জিন্দাবাদ। নকশালবাড়ি লাল সেলাম।’

হাতে একটা লন্ঠন নিয়ে দরজা খুলল মেয়েটি। লন্ঠনটা একটু ওপরে তুলে আগন্তুকের মুখে ফেলে মুখ দেখার চেষ্টা করল মেয়েটি। ‘বাপিদা তুমি!’ বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল।

বড় রাস্তার ওপর দিয়ে প্রাণকেষ্টর ভ্যান চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। অনেকগুলো মাল আছে আজ। পিছন দিকটা অনেকটা ভারী হয়ে গেছে। ভ্যানের চাকা যেন ঘুরতেই চাইছে না। প্রাণকেষ্টর ভ্যানের মতই প্রাণকেষ্টও যেন জীবনটাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বয়ে নিয়ে চলেছে। মুখে তিন চারদিনের না কামানো দাড়ি, ময়লা জামাটার নানা জায়গায় ছোপ ছোপ দাগ। বিড়ি খাওয়া বুকটা প্যাডেলের চাপে চাপে হাপরের মত ওঠানামা করছে।

মাথায় একরাশ চিন্তা নিয়ে মাল বয়ে নিয়ে চলেছে চুঁচুড়া সদরের দিকে। মহাজন কালীপদবাবু কিছুটা যেন দয়া করেই প্রাণকেষ্টকে এখনো কাজে রেখে দিয়েছেন। তা না হলে এক ঘন্টার রাস্তা দু ঘন্টায় মাল নিয়ে পাড়ি দেওয়া প্রাণকেষ্টকে কাজে রাখার কোনো যুক্তিই নেই। প্রাণকেষ্ট নিজেও সেটা ভাল করে জানে। কাজটা চলে গেলে খুবই অসুবিধা হবে প্রাণকেষ্টর। অন্তত মেয়েটার বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলে তারপর নিজের একলা একটা পেট যা হোক করে চলে যাবে।

মেয়ের চিন্তা মাথায় আসতেই পায়ে যেন জোর ফিরে এল প্রাণকেষ্টর। প্যাডেলে চাপ দিল জোরে। আর কিছুটা টেনে নিয়ে যেতে হবে। মেয়েটার বিয়েটা দিয়ে যেতেই হবে যে করেই হোক। ছেলে একটা পাওয়া গেছে। কালীপদবাবুর আড়তেই কাজে লেগেছে। আড়তের মাল ওজন করে হিসেবের খাতায় লিখে রাখার কাজ। কিছুটা বিদ্যেবুদ্ধি আছে পেটে। জোয়ান ছেলে, খাটতে পারে, সেই দেখেই পছন্দ হয়ে গেছিল প্রাণকেষ্টর। এখানে একাই থাকে। মানিয়ে নিতে পারলে মেয়ে সুখে শান্তিতেই থাকতে পারবে। প্রাথমিক একটা কথাবার্তাও সেরে রেখেছে প্রাণকেষ্ট। তবে ছেলে পণ চাইছে বেশ কিছুটা টাকা। অতটা দিতে পারবে না ও। কথাবার্তা বলে ওটা কিছুটা কমাতে হবে। প্যাডেলে চাপ দেয় প্রাণকেষ্ট।

ঘরের কাজ সেরে ফুলু এবার এতক্ষণে একটু নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পেল। সেই কোন সকালে ঘুম থেকে উঠে উনুন ধরিয়ে বাপের জন্য রান্না করে আগের দিনের বাসনপত্র মেজে ঘরদোর ধুয়ে মুছে স্নান করে একটু হাঁপ ছেড়ে নিশ্বাস নিতে পারে। দুপুরের এই সময়টা একান্তই ওর নিজের। মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবার পুরো দায়িত্বই নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে। কোনোমতে ম্যাট্রিকুলেশনটা অব্দি পড়াশোনা চালাতে পেরেছে মায়ের অসুস্থতার মাঝেই। তারপর অবশ্য কলেজে ভর্তির কথা ভাবতেও পারেনি ফুলু। এর মাঝেই মা মারা যাওয়াতে ওর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে আর আক্ষেপ করারও সময় পায়নি।

মাঝেমাঝে খুব চিন্তা হয় বাপটার জন্য। বিয়ে হয়ে চলে গেলে বাপটাকে কে দেখবে! সকালে উঠেই কোনোমতে একটু খেয়েদেয়েই দৌড়াতে হয় কালীবাবুর আড়তে। তারপর থেকে সারাদিন গাধার খাটুনি ভ্যান নিয়ে।

বিয়ের কথা মনে আসতেই মনটা উদাস হয়ে গেল ফুলুর। বাপিদার সাথে দুদিন আগেই সমস্ত কিছু চুকিয়ে বুকিয়ে দিয়ে এসেছে। ফুলু আকাশকুসুম কল্পনা করে না। গরীব ভ্যানওয়ালার মেয়ে যে বাপিদাদের বাড়ির বৌ কোনোদিনও হতে পারবে না সেটা ও আগেই জানত। কিন্তু মস্তিষ্কের কথা হৃদয় আর কোনদিনই বা শুনেছে! বছর কয়েক আগে এক অলস দুপুরে আমবাগানে যেদিন আঠেরোর বাপিদার হাতের ছোঁয়ায় ষোলোর কিশোরী ফুলুর শরীর শিরশিরিয়ে উঠেছিল, সেদিন দুজনেই বুঝেছিল ওরা বড় হয়ে গেছে। ছোটবেলার খেলার সম্পর্ক আর নেই দুজনের মধ্যে। তার আগে থেকেই মা অবশ্য ফুলুকে বলত ‘এবার ধিঙ্গিপনাগুলো একটু বন্ধ করো। বড় হচ্ছ।’ কিন্তু অসুস্থ মায়ের পক্ষে অত চোখে চোখে রাখাও সম্ভব ছিল না। তখনো ফুলু বড় হওয়া কাকে বলে জানত না। সেদিন একবারে বুঝে গেছিল। বাপিদাও হয়ত বুঝেছিল। তা নাহলে বাপিদার চোখমুখ ওরকম হয়ে যেত না। এরপর থেকে দুজনের সম্পর্ক বইতে থাকে অন্য খাতে।

বাপিদা আরো কটা বছর সময় চেয়েছিল। কলকাতার কলেজে পড়তে গিয়ে ছুটির সময়ে মাঝেমাঝে আসত বাপিদা। সেই সময়গুলো কত তাড়াতাড়ি যে কেটে যেত ফুলুর, ও নিজেও ঠিক বুঝতে পারত না। সারা দুপুর দুজনে তাদের পুরনো জায়গা আমবাগানে চলে যেত চুপিচুপি। তারপর গল্প গল্প আর গল্প। বাপিদা কলকাতার গল্প বলত। বলত নতুন এক দিন আসছে যখন আর গরীব লোক বড়লোক বলে কিছু থাকবে না। সবাই সমান হয়ে যাবে। চোখ বড় বড় করে শুনত ফুলু। ‘বাবাকে তাহলে আর ভ্যান চালাতে হবে না?’ অবাক ফুলুর প্রশ্নে উত্তর দিত বাপিদা ‘পারলে চালাবে, না পারলে চালাবে না। অন্য যে কাজ পারবে সেই কাজই করবে।’ ‘তাহলে টাকা কে দেবে? কালীবাবুর কাছে কাজ না করলে তো কালীবাবু টাকা দেবে না!’ বাপি উত্তর দিত ‘তখন আর কালীবাবুরাই থাকবে না। সবাই মিলে খাটবে, সবাই মিলে রোজগার করবে। কেউ কম কেউ বেশি নয়’। অনেক কথাই বুঝতে পারত না ফুলু।

মাঝেমাঝে ফুলু ভাবত এই সম্পর্কের পরিণতি কী। কোনোদিন কি বাপিদাদের বাড়ির বৌ হতে পারবে ও! তা কি সম্ভব! দুই বাড়ির অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্তরের যে দূরত্ব তা মেটানো কখনই সম্ভব নয়। বাপিদার বাড়ি থেকে তো মানবেই বা কোনোদিন। আর বাবা শুনলে তো ফুলুকে মেরেই ফেলবে মনে হয়। গুম হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। তারপরই আবার সেসব কথা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বাপিদার সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা মনে করে। অপেক্ষা করতে থাকে আবার কখন আসবে বাপিদা। অনেক কথাই ঠিক বুঝতে পারে না ফুলু।

গরমের ছুটিতে এবার দিন পনেরো আগে যখন আসে, তার আগেই বাবা ফুলুকে বিয়ের ব্যাপারে আভাস দিয়ে রেখেছিল। বাবারই কাজের ওখানে কোনো এক ছেলে পছন্দ করেছে বাবা। ফুলু প্রথমে শুনে হতভম্ব হয়ে গেছিল। কী বলবে বুঝতে পারেনি। তারপর বাস্তব অবস্থা চিন্তা করে দেখল ঠিকই তো, বিয়ে তো একদিন করতেই হবে। বাবা ওর বিয়েটা নিয়ে অনেক চিন্তায় থাকে। মাঝেমাঝে বলে ‘তোর বিয়েটা না দিয়ে তো মরেও শান্তি পাব না রে মা।’ তখনই ঠিক করে নিয়েছিল এবার বাপিদাকে সব খুলে বলে একেবারে পাকাপাকিভাবে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসবে।

শেষবারের মত বাপিদার থেকে বিদায় নেওয়ার আগে ছলছল চোখে বাপিদা বলেছিল ‘পরে কখনো যদি কোথাও দেখা হয়, চিনতে পারবি তো?’ শেষবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল বাপিদাকে ফুলু। তারপর ছুটে চলে আসে। সারারাত বালিশ চেপে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিল। ভোরবেলা উঠে অনেকক্ষণ ধরে চোখে জলের ঝাপটা মেরেছিল ফুলু।

‘ফুলু! তুই এখানে! এখানে কেন? কবে থেকে আছিস এখানে?’

দরজাটা বন্ধ করতে করতে একগাদা প্রশ্ন করে গেল অশোক। ফুলুর গলায় ‘বাপিদা তুমি’ চিৎকারটা শুনেই চমকে উঠেছিল অশোক। তড়িঘড়ি দরজা বন্ধ করতে করতে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দিল ফুলুর মুখের ওপর।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ঠোঁট চেপে মুখে একটা রহস্যময় হাসি এনে বলে উঠল, ‘কপাল গো বাপিদা, সবই কপাল। কপালের ফেরেই এসে উঠেছি এখানে।’ বলে খাটের পাশের একটা ছোট টুলের ওপর হ্যারিকেনটা রেখে বিছানায় এসে বসল ফুলু। হাত ধরে অশোককেও বসিয়ে দিল বিছানায়। বলল ‘এই ঘরে শুধু বিছানাই আছে গো। বিছানা সর্বস্ব ঘর আমার। তোমাকে বসতে দেওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। এই খাটেই বসতে হবে।’

‘তোর বর কোথায়? এখানেই থাকে নাকি?’

এবার হো হো করে হাসতে হাসতে খাটের ওপর লুটিয়ে পড়ল ফুলু। হাসির দমকে চোখ থেকে জল বেরিয়ে এল। হো হো হাসিটা আস্তে আস্তে হাসির সাথে কান্নায় মিশে গেল। দু চোখ ভরা জল নিয়ে বলে উঠল ‘যে বরের সাথে বাবা বিয়ে দিল তার সাথে দু মাস গ্রামে ঘর করার পর সে একদিন আমাকে বলল সে নাকি কলকাতায় চাকরি পেয়েছে। এবার কলকাতায় চলে যাবে। সাথে আমাকেও নিয়ে যাবে। চিরকাল গ্রামে থাকা মানুষ আমি, কলকাতার নাম শুনেই লাফিয়ে উঠেছিলাম। কলকাতা কত্ত বড় শহর। ছোটবেলা থেকে নামই শুনে এসেছি। ভাবলাম এবার কলকাতাকে সামনে থেকে দেখব। তা সে দেখা এমন হল আমার চিরজীবনের মত দেখার শখ ঘুচে গেল।’

‘কেন? কী হল তারপর?’

হ্যারিকেনের আলোটা আরেকটু উসকে দিয়ে ফুলু আবার বলতে শুরু করল, ‘কলকাতা আসব শুনে তো জন্মের মত বাঁধাছাদা করতে লাগলাম। গোছগাছ করে ট্রেনে চেপে বসলাম। পথে আসতে আসতে সে আমার সাথে কী সোহাগ তার। বিয়ের পর থেকে কখনো এমন ভালভাবে কথা বলেনি। আসার আগে একবার বাবার সাথে দেখা করে আসতে চেয়েছিলাম। তা সে শুনে বলল দরকার নেই। আমি খবর পাঠিয়ে দেব। কষ্ট বুকে চেপেই উঠে বসেছিলাম ট্রেনে। ট্রেন চলতে শুরু করতেই আমার হাত চেপে ধরে বসে রইল। স্টেশনে স্টেশনে ফিরিওয়ালাদের কাছ থেকে খাবার দাবার সহ কত কী যে কিনে দিল কী আর বলব। ট্রেন শিয়ালদা স্টেশনে আসতেই উঠে বসল ট্যাক্সি গাড়িতে। বলল এখন উঠছে একটা ছোট বাড়িতে। সেখানে ভাড়া নিয়েছে। কদিন বাদে ভাল জায়গায় উঠে চলে যাবে। ট্যাক্সি এসে এ পাড়ায় থামতেই আমার কী একটা যেন সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু কিছু বলিনি, চুপ করে ছিলাম। ভেবেছিলাম কদিন পর তো অন্য জায়গাতেই উঠে যাব। রাস্তা থেকে বাড়ি অব্দি যেতে এমনভাবে সবাই তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে আর মাঝেমাঝে এ ওর গায়ে হেসে ঢলে পড়ছিল, তাতে কিছুই বুঝতে পারিনি।

ঘরে এসে একজন মাসির জিম্মায় আমাকে রেখে বলল, আমি একটু আসছি। খাবার দাবারের ব্যবস্থা করে। তুমি লক্ষ্মী মেয়ের মত হয়ে থাকবে। ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ করতেই সে মাসিকে বলে গেল, মাসি রেখে গেলাম। দেখো একটু। সেই যে একটু সময়ের জন্য আসছি বলে বেরোল আর ফিরে এল না। চিন্তায় চিন্তায় বারেবারে মাসিকে বলতে মাসি বলল, চিন্তা করিস না মা, তুই তো আমার কাছেই আছিস, জলে তো আর পড়ে নেই। দেখ হয়ত কোথাও কাজে আটকে গেছে। নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দোর আটকে দুদিন খুব কাঁদলাম, তারপর তৃতীয় দিনে মাসি এসে সব খুলে বলল। বলল ও নাকি আমাকে মাসির কাছে বিক্রি করে দিয়ে গেছে। এবার থেকে মাসি যা বলবে তাই শুনে চলতে হবে।

দুদিনেই কাঁদতে কাঁদতে কিছুটা আন্দাজ করে ফেলেছিলাম যে কী হতে চলেছে। মাসি যখন বলল তখন আর চোখে জল আসেনি, কিন্তু কষ্ট হয়েছিল বাবার জন্য। বাবা শুনলে কী করবে সেই ভেবেই খুব কষ্ট হয়েছিল। তারপর তো আস্তে আস্তে ঘরে লোক আসতে শুরু করল। মাসিই সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিল তার আগে। অসুবিধা কিছুই হয়নি।’

একটানা অনেকক্ষণ ধরে নিজের জীবনের গল্প শুনিয়ে থামল ফুলু। অশোক হ্যারিকেনের আলোয় ভালো করে লক্ষ্য করে দেখল ফুলুর মধ্যে সেই গ্রাম্য সহজ সরল বালিকার ভাবটা আর নেই। বদলে মুখে চোখে একটা চপলতা এসেছে। হাসির ভঙ্গিমায় যেন স্পষ্ট আহ্বান থাকে। মাত্র তো বছর পাঁচেক হবে। এর মধ্যেই এতটা পালটে গেছে ফুলু! ভেবে অবাক হয় অশোক। ভাবে যদি একটু সাহসী হতে পারত, সমাজের চোখরাঙানিকে ভয় না পেত তাহলে হয়ত ফুলুকে এখানে পড়ে থাকতে হত না। আবার তার পরক্ষণেই মাথায় এল, তাহলে ওর আজকের যে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো, যে অনিশ্চিত জীবন অতিবাহিত করে চলেছে তার অঙ্গ কি করে নেওয়া যেত ফুলুকে? ঠিক বুঝতে পারে না।

ঠিক সেই সময়ে পুলিশ ভ্যানের সাইরেনের শব্দ যেন জাগিয়ে দিয়ে গেল সমস্ত পাড়াকে।

‘আমি আজ আসি। পারলে পরে আবার আসব রে ফুলু। পুলিশ এখানে এলে বলিস তুই কাউকে দেখিসনি।’ এই বলে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেল অশোক।

‘নমস্কার, আকাশবাণী কলকাতা। খবর পড়ছি তরুণ চক্রবর্তী। আজ পশ্চিমবঙ্গে গঠিত হল বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভা। রাজ্যপাল এ এল ডায়াস মুখ্যমন্ত্রী সহ মন্ত্রীসভার সকল সদস্যকে শপথবাক্য পাঠ করান। এরপরে প্রথম ক্যাবিনেট বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, সমস্ত রাজবন্দীদের বিনা শর্তে মুক্তি দেওয়া হবে।’

প্রেসিডেন্সি জেলের মধ্যেকার খোলা চত্বরটায় গোল হয়ে বসে রেডিওর খবর শুনছিল প্রায় জনা পঁচিশেক রাজনৈতিক বন্দি। ওদের ফার্স্ট ক্লাস প্রিজনারের তকমা দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক ওই রাজনৈতিক বন্দিরা অবশ্য জেলের ভিতর অনেকটা লড়াই করেই ফার্স্ট ক্লাস প্রিজনারের অধিকার আদায় করেছে।

কদিন আগেই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বিরাট জয় পেয়েছে বামফ্রন্ট। ৭৭-এর জানুয়ারিতে জরুরি অবস্থা শিথিল হওয়ার সাথে সাথেই সংশোধনবাদী সিপিএম ভোটের রাজনীতির ক্ষীর খাওয়ার জন্য ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক, বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেস এবং আরসিপিআইকে নিয়ে বামফ্রন্ট জোট গঠন করে। চটকদার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং কংগ্রেস দলের অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জনগণ ঢেলে ভোট দেয় বামফ্রন্টকে। ভোটের আগে থেকেই বন্দিমুক্তির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল অবশ্য।

অশোক ভাবছিল এই বন্দিমুক্তির পেছনে সিপিএমের কোন রাজনীতির খেলা রয়েছে। এই দলটাকে কিছুতেই বিশ্বাস করে না ও। ভোটের স্বার্থে যা খুশি এরা করতে পারে।

হইহই করে পেছন থেকে ওদের গ্রুপের বাকি কমরেডরা এসে অশোককে জড়িয়ে ধরাতে চমক ভাঙে ওর। বন্দিমুক্তির ঘোষণায় সবাই আজ খুশি।

অশোক আজ দেড় বছর ধরে জেলে বন্দি। কমরেড সিএম মারা যাওয়ার পর থেকেই যতীন আর অশোক আলাদা গ্রুপে ভাগ হয়ে গেছিল। চীনের পার্টি কমরেড সিএমের সমালোচনা যখন করেছিল, সেই রিপোর্ট লুকিয়ে রাখা হয় বেশ কিছুদিন। সিএম শেষবার ধরা পড়ার কদিন আগে সেন্ট্রাল কমিটির মিটিং ডেকে সেই রিপোর্ট তুলে দিতে চেয়েছিলেন পার্টির কাছে। কিন্তু কমরেড সিএমকে ঘিরে থাকা এক গোষ্ঠীর সেই রিপোর্ট প্রকাশে ছিল ঘোরতর অনীহা। অশোক ধরা পড়ার পর জেলে মাঝেমাঝে বসে ভাবত ভুলটা কোথায় ছিল। শ্রেণিশত্রু খতমের লাইন নিতে গিয়ে শুধুমাত্র খতমের লাইনে চলে যাওয়াটাই ভুল হয়েছিল, নাকি সঠিক গণসংগঠন না গড়ে শুধুমাত্র আবেগের বশে বিপ্লবের পথে ঝাঁপিয়ে পড়াটা ভুল ছিল? চিনের পার্টির অনেকগুলো সমালোচনার মধ্যে এটাও একটা সমালোচনা ছিল যে গণসংগঠনে মনোযোগ না দিয়ে জনগণের সাথে নিবিড় যোগাযোগের ক্ষেত্র তৈরি না করে জনগণকে বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত করা যায় না। কমরেড সিএমের সেই ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীর এইসব মানতে খুব অসুবিধা ছিল। তাদের মতে ওসব গণসংগঠন-ফংগঠন আসলে সংশোধনবাদী চিন্তাধারা। বিপ্লবের আসল কাজ ওসব দিয়ে হয় না। এগুলো এক ধরণের এসকেপিস্ট চিন্তাধারা। যতীন ছিল সেই মতবাদের সমর্থক। অশোক চেয়েছিল পার্টিটাকে পুনর্গঠন করা হোক ভুল ত্রুটিগুলোকে মেনে নিয়ে। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে দিনের পর দিন মতবিরোধ চলেছে। অবশেষে দুজনেই দুজনের পথ খুঁজে নিয়েছে। শেষ জানা খবর অনুযায়ী যতীন এখনো আন্ডারগ্রাউন্ডে রয়েছে।

সুবোধ মারা গেছিল পুলিশের গুলিতে যেদিন ফুলুর সাথে সোনাগাছির গলিতে অশোকের দেখা হয় সেদিনই।

ফুলুর সাথে পরে আর দেখা হয়নি। পালিয়ে পালিয়েই বেড়াতে হয়েছে পুরো সময়টা জুড়ে। গ্রামে গিয়ে শ্রেণিশত্রু খতম অভিযান করা, আন্ডারগ্রাউন্ড থাকা এসব করতে করতেই কোথা দিয়ে যে ছ ছটা বছর চলে গেল বুঝতেই পারে না। ফুলুর কথা ভেবে মন খারাপ করার আর সময়ই পায়নি। অনেকদিন পর ফুলুর কথা মনে পড়তেই একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় যেন বুকটা টনটন করে উঠল। আশ্চর্য হল অশোক। কেন হল? এরকম তো হওয়ার কথা নয়! যে জীবনের পথে ও রয়েছে সেখানে এসব রোমান্টিসিজমের তো স্থান নেই!

সকাল বেশ বেলা করেই হয় এ পাড়ায়। অলস সকাল গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে চলে বেলা সাড়ে বারোটা-একটা অব্দি। দিন যেহেতু শেষ হতে হতে শেষরাত হয়ে যায় প্রায়, তাই সকাল শুরু হতে হতে দশটা এগারোটা বেজে যায়। একটা বেজে গেলেই তখন হাঁড়ি চড়ানোর কথা মনে পড়ে। তাড়াতাড়ি করে কিছু একটা চাপিয়ে দিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করেই আবার বিকেলের জন্য প্রতীক্ষা শুরু হয়ে যায়।

সকালের দিকে একমাত্র পাড়ার লোক ছাড়া বাইরের লোক আর কেউ থাকে না। মোটামুটি নিস্তব্ধই থাকে। শুধু নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি বা চুলোচুলি ছাড়া আর অন্য কোনোকিছুর আওয়াজ পাওয়া যায় না এখানে।

প্রায় ছ বছর আগের এক রাতের বাড়ি চেনার অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে অশোক এসে পড়ল আবার সেই গলিতে। কদিন আগেই সবার সাথে ছাড়া পেয়েছে ও। গ্রামের বাড়িতে কটা দিন থেকেই আবার কলকাতায় চলে এসেছে। লিবারেশনপন্থীরা ঠিক করেছে সংসদীয় পথেই থাকবে। স্টাডি সার্কেল তৈরি করা হবে ব্লক লেভেল অব্দি। জনগণকে সঠিকভাবে মার্ক্সবাদের আলোকে দীক্ষিত করতে হবে। সংশোধনবাদ আর সংকীর্ণতাবাদ দু ধরণের বিপদ সম্পর্কেই অবহিত করতে হবে। অশোককে দক্ষিণবঙ্গের স্টাডি সার্কেলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রচুর কাজ এখন।

স্মৃতির ওপর ভর করে আবার ফুলুর দরজায় টোকা দিল অশোক। এবার দিনের বেলা। প্রকাশ্য দিবালোকে।

দরজা খুলে ভুত দেখার মত চমকে উঠল ফুলু। সবে ঘুম ভেঙে উঠেছে। ও ভাবতে পারেনি যে বাপিদা দ্বিতীয়বার আসবে ওর বাড়িতে। ভেবেছিল হয়ত কোনো কাস্টমার বিরক্ত করতে এসেছে এই সাতসকালে। যদিও ঘড়ির কাটা ছুঁয়েছে এগারোটার ঘর, কিন্তু ফুলুদের কাছে এটাই সাতসকাল। বাপিদাকে দেখে খুব অবাক হল ফুলু। সেই যে সেবার বলে গেছিল ‘আসি রে ফুলু, পারলে পরে আবার আসব’, ফুলু জানত বাপিদা আসলে আর কোনোদিনই আসবে না ওর কাছে। ওর কাছে আসাটা ভদ্রলোকেদের শোভা পায় না।

‘কী রে, ঢুকতে দিবি না? দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছিস?’

চমক ভেঙে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। অশোক ঢুকে ঘরের চারিদিকটা দেখল একবার। আগেরবার যখন এসেছিল অন্ধকারে হ্যারিকেনের আলোতে বুঝতে পারেনি সবটা। এবার দিনের বেলা ভাল করে দেখল ঘরটা। বেশ সাজানো গোছানো পরিষ্কার ঘর। এক কোণায় হাঁড়ি কড়াই সহ রান্নার সরঞ্জাম, বিছানার কাছে মাথার ওপরে একটা ছোট্ট মত ঠাকুরের আসন। সেখানে কয়েকটা ঠাকুরের ছবি। ঘুম থেকে ওঠা ফুলুকে সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের মত লাগছে। অগোছালোভাবে শাড়িটা জড়িয়ে আছে গায়ে। চোখে মুখে একটা শান্ত স্নিগ্ধ ভাব। অশোকের বুকটা হুহু করে উঠল। এই ফুলু হতে পারত একান্তভাবে ওরই। খুব ইচ্ছে করছিল ফুলুকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু নিজের আবেগকে বশে রাখল অশোক।

‘কেমন আছিস ফুলু?’

‘আমাদের আর কেমন থাকা। যেরকম থাকি সেরকমই। খারাপ নয়। আমাদের মত করে ভাল থাকা। তোমার খবর বলো। তোমাদের সবাইকে তো নতুন সরকার ছেড়ে দিয়েছে জেল থেকে। তুমি আমার খবর না রাখলেও আমি কিন্তু তোমার খবর নজর করতাম। পেপারে তোমার অ্যারেস্ট হওয়ার খবর বেরিয়েছিল। ছাড়া পেয়ে গ্রামে গেছিলে?’

ফুলুর এই কথাটা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে অশোকের বুক থেকে। সত্যিই তো, ফুলুর তো কোনো খবরই আর রাখতে পারেনি। পার্টির কাজে ফুলুকে যে ভুলেই গেছিল। বলল, ‘হ্যাঁ গ্রামে গেছিলাম। মা মারা গেছে বছর চারেক আগেই। বাবা দাদা আর বৌদি এখন থাকে। আমার উপস্থিতি খুব একটা পছন্দ করল না কেউই। কদিন থেকেই তাই আবার চলে এলাম। কলকাতাতেও কাজ বাড়ছে।’

‘আমার বাবার কী খবর গো? অনেকদিন আগে বাবাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। আমি পোস্ট করিনি। একজন খদ্দের আছে উড়িষ্যায় তার ব্যবসা। কলকাতায় এলে আমার কাছে আসে। তাকে দিয়ে বলেছিলাম উড়িষ্যা থেকে পোস্ট করতে। যাতে অন্তত জানে যে আমি বেঁচে আছি। অনেক দূরে আছি বলে যেতে পারি না। ভুলটাই জানুক, ঠিকটা জানলে হয়ত আর নিজে ঠিক থাকতে পার‍ত না। উড়িষ্যার পোস্টে বাবাও একবার কাকে দিয়ে যেন চিঠি লিখিয়েছিল। বলেছিল বিয়ের পরপরই বাচ্চু মানে আমার যে স্বামী ছিল সে কালীবাবুর ওখান থেকে কাজ ছেড়ে চলে যায়। তারপর থেকেই কোনো খবর না পেয়ে নাকি খুব চিন্তায় ছিল। আমি মনে মনে ভাবছিলাম কাজ করার আর দরকার কি। আমাকে বিক্রি করেই হাতে যা টাকা পেয়েছিল তা দিয়েই ওর বেশ কদিন চলে যেত।’

‘তোর বাবা এখনো কালীবাবুর ওখানেই ভ্যান চালায়। আগের থেকে শরীর অনেক ভেঙে গেছে। বয়সও তো হল কম না। একদিন দেখা হয়েছিল। বললাম, কেন চালাচ্ছ আর? ছেড়ে দাও না। বলে ছেড়ে দিলে শরীরে আরও জং ধরে যাবে। যতদিন পারছি ততদিন করি।’

‘বাপিদা, ভাত বসাচ্ছি, ডাল ভাত খেও দুটো। গতকাল ট্যাংরা মাছ আনিয়েছিলাম। ঝাল করি?’

জেলে যাওয়ার আগে অব্দি আমহার্স্ট স্ট্রিটের মেস ছিল ওর পার্মানেন্ট ঠিকানা। জেল থেকে বেরনোর পর বেলেঘাটার বস্তিতে এক কমরেড শঙ্কর সোনকারের বাড়িতেই থাকে এখনো অব্দি। গেঞ্জি কলের শ্রমিক সোনকারের দিনের বেলা ডিউটি থাকলে অশোক রান্না করে নেয় আর রাতের ডিউটিতে সোনকার এসে রান্না করে। কোনোমতে আলুসেদ্ধ ভাত খেয়েই অর্ধেক দিন কাটাতে হয়। ফুলুর কথায় খুব লোভ হল অশোকের। লোভটা আসলে খাওয়ার প্রতি নয়। একটা সুন্দর সংসারের প্রতি। মাঝেমাঝে অশোকের আক্ষেপ হয় কাদের জন্য ওরা সব কিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে অনিশ্চিত জীবন বেছে নিল! সবাই তো বেশ সুন্দর সংসার করে সাজিয়ে গুছিয়ে বসে রয়েছে। মরল একমাত্র ওদের মত কিছু বোকারাই!

‘হ্যাঁ রে ভাত বসা। খেয়েই যাব। তোর হাতে প্রথমবারের মত খেয়ে দেখি কেমন লাগে।’

অশোকের কথায় ফুলু লজ্জা পেল।

‘কমরেডস, এক জরুরী ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য আজকের এই মিটিং ডাকা হয়েছে।’

জেলা সম্পাদকের গমগমে গলাটা ছুঁয়ে গেল হলঘরের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত অব্দি।

‘আমাদের পার্টি ঠিক করেছে চারু মজুমদারের অসম্পূর্ণ কাজ নিজেদের কাধের ওপর তুলে নেবে। আমরা মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী যে কটি পার্টি ফ্যাকশন রয়েছে সবাইকে নিয়ে এক ঐক্যবদ্ধ পার্টি প্রতিষ্ঠা করতে চলেছি। জানি না আমরা কতটা সফল হব, তবে চেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে।’

জরুরী ভিত্তিতে তলব পেয়ে পার্টির এই মিটিংটা অ্যাটেন্ড করতে ছুটে এসেছে অশোক। খুব সাংগঠনিক নানা আলোচনা হবে আর বিশেষ করে অশোককে নাকি থাকতে বলেছেন জেলা সম্পাদক। তাকে নিয়ে কোনো একটা প্রস্তাব নাকি নেওয়া হবে। অশোক এখনো বুঝতে পারছে না ওকে নিয়ে বিশেষ কী দরকার আছে জেলা সম্পাদকের। স্টাডি সার্কেল তো নিয়মিতই চালাচ্ছে ও। পার্টির সমস্ত মিটিংয়ে যখন যেরকমভাবে পারে যোগ দেয়। তবে শঙ্কর সোনকারকে ও বলেছে গেঞ্জির কল বা কোথাও কোনো কাজ থাকলে ওকে বলতে। আসলে কারো ঘাড়ের ওপর বসে খেতে খুব লজ্জা লাগে অশোকের। এমনও নয় যে কমরেড সোনকারের মাইনে খুব বেশি বা দেশের বাড়িতে পৈতৃক সম্পত্তি প্রচুর আছে। কাজেই কাজটা ওর দরকার। সোনকার অবশ্য ওকে ভরসাও দিয়েছে যে খুব তাড়াতাড়িই ওদের কারখানায় সুপারভাইজার একটা দরকার। অশোকের যেহেতু পড়াশোনা রয়েছে, তাই কাজটা ওর হয়ে যাওয়ারই কথা। সেই জন্য কি কিছু হল? কে জানে?

‘এ ছাড়াও গণসংগঠনের দিকে পার্টি জোর দিচ্ছে এখন। খুব শীঘ্রই আমরা পিপলস ফ্রন্ট নামাতে চলেছি। এই পিপলস ফ্রন্টই হবে ভবিষ্যতে আমাদের সংসদীয় মুখ।’ গমগম করছে জেলা সম্পাদকের গলা।

অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে অশোক। মাঝেমাঝেই ফুলুর মুখটা ভেসে উঠছে। সেদিন ওর হাতে ভাত ডাল আর মাছের ঝোল খাওয়ার পর বিছানায় গড়িয়ে পড়েছিল অশোক ক্লান্তিতে। কখন বিকেল হয়েছে বুঝতেই পারেনি। ফুলুর ডাকে ধড়মড় করে উঠেছিল অশোক। ফুলু বলেছিল ‘এবার বাড়ি যাও বাপিদা। এখন আর তোমার থাকা ঠিক হবে না। পরে আবার এসো।’

বুঝেছিল অশোক। রাস্তায় বেরিয়ে সেদিন অনেকক্ষণ একটা পার্কে বসে ছিল একা। একটা অদ্ভুতরকম ভাললাগার অনুভূতি হচ্ছিল। ভাবছিল কেন এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল দিনটা। কদিন পর আবার গেছিল ফুলুর কাছে। তারপর আবার।

‘এতক্ষণ যে সাংগঠনিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করলাম এই ব্যাপারে যদি কমরেডদের কিছু বলার থাকে তাহলে মিটিংয়ের শেষে বলতে পারেন আপনারা। এবার আমরা আমাদের মিটিংয়ের অন্য অংশে আসব। যেটা আমাদের কাছে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। এরকম পরিস্থিতিতে আমাদের কাউকে আগে পড়তে হয়নি। আমাদের সব সময় মাথায় রাখা উচিত বিপ্লবী দলের কর্মীরাই দলের সম্পদ। জনগণ সব সময় কর্মীদের ওপর নজর রাখেন। কাজেই আমাদের নিজেদের আচার আচরণ ঠিক রাখার দায় আমাদের নিজেদেরই।’

মিটিংয়ে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করল অশোক। কার ব্যাপারে বলছেন জেলা সম্পাদক? বুঝতে পারছে না অশোক।

‘আমাদের চালচলন আচার আচরণ যদি ঠিক না হয় তাহলে জনগণকে আমাদের জবাবদিহি করার দায় থাকে। আপনারা এখানে যারা যারা উপস্থিত আছেন তারা কেউ কেউ বিবাহিত, আবার কেউ কেউ অবিবাহিত। প্রত্যেকেই নিজের নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিষয়টা এখানে উত্থাপন করে আমার নিজেরই খুব অস্বস্তি হচ্ছে, কিন্তু এতই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, উত্থাপন না করেও পারছি না। আমাদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কমরেডকে যদি নিয়মিত বেশ্যালয়ে যেতে দেখেন জনগণ, তাহলে আমাদের পার্টির প্রতি জনসাধারণের কীরকম ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় তা বোঝা যাচ্ছে কি?’

চমকে ওঠে অশোক। কার ব্যাপারে বলছেন কমরেড? ওর ব্যাপারে নয় তো?

‘হ্যাঁ কমরেড অশোক, আপনার ব্যাপারেই বলছি।’

অশোকের চমকে ওঠার দিকে লক্ষ্য রেখে বলে ওঠেন জেলা সম্পাদক।

‘আপনার নিয়মিত বেশ্যালয়ে গমন আমাদের পার্টির কাছে অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি নিজে হয়ত বুঝতে পারছেন না যে আপনি নজরদারির মধ্যে রয়েছেন। ভেবেছিলেন আপনি পার্টিকে ফাঁকি দিতে পারবেন। পার্টি কিছু বুঝতে পারবে না। কিন্তু আপনার ধারণা যে সর্বার্থে ভুল সেটা আপনি জেনে রাখুন। পার্টিকে ঠকানো সহজ নয়। পার্টির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে পার পেয়ে যাবেন ভাবলে ভুল ভাবছেন।’

‘কাউকে আমি ঠকাইনি, আর এই জীবন থাকতে পার্টির প্রতি আমি কোনোরকম বিশ্বাসঘাতকতা কোনোদিনই করতে পারব না।’

জেলা সম্পাদকের গলা ছাড়িয়ে উঁচু গলায় বলে উঠল অশোক। সমস্ত কমরেডের মুখ এখন ঘুরে গেছে অশোকের দিকে। সবাই নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করে যাচ্ছে অশোককে।

‘আপনি কি মনে করেন আপনার নিয়মিত বেশ্যালয়ে যাওয়া পার্টির পক্ষে ক্ষতিকারক নয়?’

‘আমি বেশ্যালয়ে ফুর্তি করতে যাই না কমরেড। আমি সেখানে বিশেষ একজনের কাছে যাই। তাকে আমি ভালবাসি।’

অশোকের এই কথায় স্তম্ভিত হয়ে গেল সমস্ত হলঘর। কেউ ভাবতে পারেনি অশোক এরকম একটা উত্তর দেবে। জেলা সম্পাদক নিজেও কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন অশোকের দিকে। এরপর মাথা নামিয়ে বললেন, ‘নিয়মমত কোনো কমরেডকে পার্টি থেকে বহিষ্কারের আগে সেই কমরেডের কাছে কারণ দর্শাতে চাওয়া হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে আপনারা সবাই একমত হবেন নিশ্চয়ই যে সরাসরি কমরেড অশোককে বহিষ্কারই একমাত্র পথ যদি না উনি এই মিটিং থেকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন যে আর ও পাড়ার পথ মাড়াবেন না।’

‘অসম্ভব।’ চিৎকার করে উঠল অশোক।

গলা থেকে উঠে আসা কান্নাটা কোনোক্রমে গিলে মিটিং থেকে বেরিয়ে ফুলুর বাড়ির দিকে হাঁটা লাগাল অশোক। কতদিনের সম্পর্ক আজ ছিন্ন হয়ে গেল কয়েক ঘন্টার মধ্যে। শুধু একটা মিটিং। ব্যাস। তাতেই সব সম্পর্ক সব আবেগের ইতি।

ফুলুর কাছে যেতে হবে। ওকে জিজ্ঞাসা করতে হবে ও কি অশোকের সাথে বেরিয়ে আসতে পারবে, নাকি ওখানেই থাকবে? অশোকের অবশ্য কোনোকিছুতেই আপত্তি নেই। সোনকার ভাইকে তাগাদা দিতে হবে গেঞ্জি কলের চাকরিটার জন্য। জোরে জোরে পা চালাল অশোক।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.