একুশ শতকের প্রথম দুটি দশক পার করেই আমরা বুঝতে পারছি বাঙালি বুদ্ধিজীবীর হিসেব খাতায় একটা বড় গরমিল আছে। তা হাতের মাদুলি, কোমরের তাগা, চোখের মেগাসিরিয়াল দেখেই বোঝা যায়। আমরা আপাতত তার সিনেমা চর্চার কথা ভাবি। আমরা কেউই বোধহয় বুঝতে পারিনি যে উত্তমকুমার চলে যাওয়ার পর অর্ধশতকও কাটবে না, হুড়মুড় করে বাঙালির সাধের ছায়াছবির সেটটি ভেঙে পড়বে। এখন মনে হয় ভাবনাতেই কোথাও একটা গলদ ছিল।
ইতিহাসের মায়াহরিণী যে আমাদের কতভাবে ছলনা করে গেল! বাঙালি বুদ্ধিজীবী গত শতাব্দীর পাঁচ ও ছয়ের দশক ধরে দেখলেন শুধু চলচ্চিত্রের ‘আর্ট’-এর সম্ভাবনা। কানন দেবী, প্রমথেশ বড়ুয়াকে আমরা ভুলে গেলাম। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটককে আবিষ্কার করার উচ্ছ্বাসে; পথের পাঁচালী, অযান্ত্রিক-এর মুগ্ধতায় আমরা খেয়ালও করলাম না যে জনপ্রিয়তার আঙিনাটুকুও একই সময়ে ঝলমল করতে শুরু করেছিল। দুজনে দেখা হল – উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন! পৃথিবীর অন্য দেশ হলে অবশ্যই গবেষণার বিষয় হত যে এমন অনন্য সময় আর কোথাও আছে কিনা যখন সিনেমার ভাষা ও গল্প যেমন শিল্পের মাপকাঠিতে উতরে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, তেমনভাবেই নায়ক-নায়িকা নির্ভর ছবির পরিসর দর্শককে ছবিঘরে টেনে আনছে। আমরা বুঝে উঠতে পারিনি যে আমাদের কল্পলোকের সারথি শুধু ঋত্বিক আর সত্যজিৎ নন, একেবারে বিপরীত দিক থেকে দেখলে অজয় কর, নির্মল দে, অগ্রগামী, অগ্রদূতদের মত তুলনারহিত প্রতিভারাও। আমরা অবশ্য আপাতত অজয় করের দিকেই তাকাব।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ফরাসি দেশে ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, জঁ লুক গোদার প্রমুখ নামকরা পরিচালক দেখাতে পেরেছিলেন যে হলিউডের বাঁধাধরা বাণিজ্য সড়কেও জন ফোর্ড বা আলফ্রেড হিচকক কেন আলাদা গ্রহের বাসিন্দা। কিন্তু আমাদের তেমন সমালোচক দুর্ভাগ্যজনকভাবে নেই। যদি থাকতেন তবে হয়ত বলা যেত, সুচিত্রা সেন কখনোই এমনভাবে ফুটে উঠতেন না যদি অজয়ের ক্যামেরা তাঁকে ফ্রেমে না ডেকে আনত। হলিউডের প্রখ্যাত নায়িকা গ্রেটা গার্বোকে নিয়ে আলোচনার সময়ে সুন্দরীশ্রেষ্ঠা গার্বোর মুখ নানা ছবি আঁকে বলে সিনেমাতাত্ত্বিকেরা দাবি করেন। অথচ স্বয়ং গার্বো জানতেন দর্শক তাঁর কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করে। ফলে যে পরিচালকই তাঁকে নায়িকা রূপে বেছে নিন না কেন, তিনি নিজে আলোকচিত্রী হিসাবে বেছে নিতেন উইলিয়াম ড্যানিয়েলসকে। ফলে ছবির পর ছবিতে গার্বোর মুখের এমন একটি রেখচিত্র গড়ে উঠেছিল যা কেবল প্রকৃত গুণীদের থাকে। এভাবেই রাউল কুতারের ক্যামেরা আনা কারিনাকে তৈরি করেছে, নিকভিস্তের ক্যামেরা হ্যারিয়েট অ্যান্ডারসনকে।
আমার মনে হয় বাংলা ছায়াছবির জগতে অজয় আর সুচিত্রার সম্পর্কও এইরকম। সুচিত্রার যে আপাত ভ্রূ ভঙ্গি অথবা অভিমানী কটাক্ষ, যেন দূর দিগন্তে ক্ষীণ শশাঙ্ক বাঁকা, সাদাকালোর অলৌকিকতায় অজয় সে প্রতিমায় চক্ষুদান করেন হারানো সুর (১৯৫৭), সপ্তপদী (১৯৬১) এবং সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩) নামের তিনটি ছবিতে। এমনকি উত্তমকুমার বা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যে উপস্থাপনা, তাও অজয়ের এমন রচনা যে অন্য পরিচালকদের সঙ্গে তুলনা টানলেই বোঝা যাবে তা কত স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট। পরিচালক অজয়কে বাদ দিয়ে যদি শুধু চিত্রগ্রাহক অজয়কে মনে রাখি, তাহলে দেখব সপ্তপদীর ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ – সেই পথটুকু অজয় কী অসামান্যভাবেই না বর্ণনা করেছিলেন রিভার্স মোশনে। যেন আলো আর অন্ধকারে আঁকা কোনো ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রপট।
আগে ফরাসি ছায়াছবি লা রেগলে দ্য জু (খেলার নিয়ম) ছবির মোটরযাত্রা এরকম পথেই সম্পন্ন হয়েছিল। সেখানে আয়োজন ছিল অনেক বেশি। তবু এই বিদেশি দৃষ্টান্ত ছাড়াই অজয় হাড়ে মাংসে বাঙালি। উত্তম ও সৌমিত্রের বিপরীতে যে সুচিত্রা, তাঁর চাহনিতে যে কারুকাজ, তা ততটা হলিউডের নয় যতটা বৈষ্ণব পদাবলীর। দেবকীকুমার বসু তাঁর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য (১৯৫৪) ছবিতে বিষ্ণুপ্রিয়ার ভূমিকায় সুচিত্রাকে মোটামুটি চণ্ডীদাসের নায়িকা হিসাবে সাজিয়েছিলেন। আর অজয় হারানো সুরে যে সুচিত্রাকে ‘তুমি যে আমার’ গানের মুহূর্তে নিবেদন করেন, তিনি ‘থির বিজুরি’ সম, কলহান্তরিতা। অজয় তাঁর নায়িকাকে উদাসিনী সাধিকা হতে পরামর্শ দিয়েছিলেন – ‘যেমত যোগিনীপারা’। আর গানটিতে সুচিত্রার নির্মাণ দেখলে অনুমান করতে ভুল হয় না – ‘চকোর পাইল চাঁদ,/পাতিয়া পিরীতি ফাঁদ,/কমলিনী পাওল মধুপ’।
আমাদের ছবিতে অজয় এমন এক কথক যিনি বাঙালি মনের গভীরে ডুব দিয়ে উদ্ধার করে আনেন স্মৃতির নুড়িপাথর। কালিদাসে হারানো আংটির পুনরুদ্ধার যেমন দুষ্মন্ত ও শকুন্তলাকে মিলিত করে, হারানো সুর ছবিতেও সেই বিচ্ছেদ আর মিলনের গল্পটিই নতুন করে বলা হয়। আমাদের আর মনে থাকে না যে হারানো সুর আসলে হলিউডের র্যান্ডম হারভেস্ট ছবিটির অনুবাদ। অজয় হয়ত হলিউডের কাছে হাত পাতেন, কিন্তু তাঁর প্রকাশভঙ্গি এমন দেশজ যে বোঝাই যায় চলচ্চিত্রের কারিগরি বিদ্যা তাঁর হাতের তালুর মত চেনা। যেমন হলিউড থেকে তিনি নিঃসঙ্কোচে ব্যাকলাইট ব্যবহার করার পদ্ধতি জেনে নেন। কিন্তু যখনই এই আলোকে তিনি উত্তমকুমার ও সুচিত্রার চুলের ফাঁকে ফাঁকে ব্যবহার করেন, তার নাটকীয়তা হলিউড মেলোড্রামার বদলে হিন্দু পৌরাণিকতার অনেক কাছাকাছি চলে যায়। সপ্তপদীর কৃষ্ণেন্দু মিশনারি হয়ে যেতে পারে, কিন্তু তার মুখাবয়বে স্পষ্টই ধরা পড়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রণয় আদল। আমার বলার কথা এই যে ক্লোজ-আপের ব্যবহারে, বিশেষত লো অ্যাঙ্গল সফট ফোকাসের প্রসঙ্গে অজয় বোধহয় আসমুদ্রহিমাচলেই তুলনারহিত। তাঁর সৌজন্যেই উত্তমের সকালের আলোর মত হাসি দেখে সুচিত্রার মত আমাদেরও মনে হয় – ‘আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লু পেখলু পিয়া-মুখ-চন্দা’।
আরো পড়ুন ‘বাম বৃত্তে না থাকায় উত্তমকুমার বুদ্ধিজীবীদের অবজ্ঞার শিকার হয়েছেন’
গল্প বলার কী আশ্চর্য পারিপাট্য! নিউ থিয়েটার্স ঘরানার ‘সাহিত্য ধর্ম’ তাঁকে সুরভিত করে রাখে আজীবন। গল্প রচনার প্রতি ধার্মিকের আনুগত্যে তিনি শরৎচন্দ্র তো বটেই, প্রতিভা বসু, সুবোধ ঘোষ বা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের শরণ নিয়েছেন। কিন্তু দৃশ্য ও ছবির বিন্যাসে সেই চিত্র জরির গয়নায় কাঁচ কাটা হীরে। সৌমিত্র নানা চরিত্রের জন্য স্মরণীয়, কিন্তু সাত পাকে বাঁধা ছবিতে তরুণ অধ্যাপকের অনমনীয় কিন্তু লাজুক পৌরুষ অজয়ের সৃষ্টি। আর তা মধ্যবিত্ত অহঙ্কারের স্থায়ী মিথ এই ২০২৩ সাল পর্যন্ত। এই ছবির প্রোজেকশন দেখে স্বয়ং সত্যজিৎ অজয়কে ছবিটি বিদেশে পাঠানোর পরামর্শ দেন আর সেই সূত্রেই সুচিত্রা মস্কো বিজয়িনী। অথচ গল্প থাকা সত্ত্বেও, নায়ক-নায়িকা বর্জন না করেও, টালিগঞ্জের বাণিজ্যিক ঘরানার মধ্যেই অজয় এক স্রষ্টা। শুধু সংলাপ যে একটা ছবিকে কতদূর টেনে নিয়ে যেতে পারে সপ্তপদীর দ্বিতীয়ার্ধ তার চূড়ান্ত প্রমাণ, যেখানে কৃষ্ণেন্দু ও রিনা ব্রাউনের কথোপকথনই একমাত্র নাট্যবস্তু। ভেবে দেখুন ওথেলো অভিনয়ের পর্বটুকু। একজন বাঙালি তরুণ প্রণয়িনীর কাছে সামান্য স্পর্শের আঁচ পেতে চায়। তা কি উপমারহিতভাবে ট্র্যাজেডির আগুনে পৌঁছে যেতে পারে, তা এই দৃশ্যে এক্সপ্রেশনিস্ট আলোর ব্যবহার মিড লং শটগুলিতে দেখলেই বোঝা যায়। চরম অবিশ্বাস থেকে রিনা যিশুখ্রিস্টের ছবির দিকে গুলি ছুঁড়লে টেবিল ল্যাম্পের কাচ ভেঙে যায় – আলো কাঁপতে থাকে রিনার ছবিতে। বা মত্ত মাধবীলতার মত রিনা যখন ট্রেনের ধাতব শব্দে কাঁপতে থাকা আয়নায় কৃষ্ণেন্দুকে ভাঙতে দেখে ভ্রষ্ট স্মৃতি ফিরে পায়, সেই মুহূর্তটি? পশ্চিমের পণ্ডিতরা মেরলিন দিয়েত্রিশকে নীল দেবদূতিতে পরিণত করার জন্য কত না প্রবন্ধ লিখেছেন পরিচালক স্টার্নবার্গ সম্পর্কে! একদা এই টালিগঞ্জেও ছদ্মবেশী দেবতা হিসাবে দেখা দিয়েছিলেন অজয় কর। কথা ও সুর, আর ছবির কারুকার্যময় অন্দরমহলে তিনি সিনেমার যে রাজকন্যার বাসরশয্যা রচনা করেছিলেন তা নিয়ে আমরা তেমন কথা বলিনি। আমাদের চলচ্চিত্রবোধ কি এখনো বুঝতে পারবে না যে বাংলা বাণিজ্যিক সিনেমা, এমনকি হিন্দিও আমাদের এক ধরনের জনপরিচিতি? আমরা অজয়কে শুধু ভাল পরিচালক ভেবেছি, ভাল গল্প বলিয়ে ভেবেছি। আমরা যে সোনা ফেলে আঁচলে গিঁট দিয়েছি তা কি এখনো বুঝতে পারলাম?
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।