ঔষ্ণীক ঘোষ সোম

আজ থেকে ১৪৫ বছর আগে (২ বৈশাখ ১২৮৪, ইং ১৮৭৭) অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা জেলার সাভারের নিকটবর্তী উলাইল গ্রামে শ্রী দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের জন্ম হয়। আর তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বই ঠাকুরমার ঝুলি প্রকাশিত হয় ১৯০৭ সালে। তারও প্রায় ১১৫ বছর হতে চলল। এতগুলো বছর পেরিয়েও তার জনপ্রিয়তা খুব একটা কমেনি। বরং বলা ভাল নানা ক্ষেত্রে মানুষ এই বইয়ের কাছে বারবার ফিরে যাচ্ছেন। বিশেষত শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন সিলেবাসে দক্ষিণারঞ্জনের এই বই অন্তর্ভুক্ত করার পর শিক্ষাঙ্গনেও এই নিয়ে চর্চা বৃদ্ধি পেয়েছে। একজন সাহিত্যিক বেঁচে থাকেন তাঁর সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে এবং একটি সাহিত্যকর্ম থেকে যায় তাকে নিয়ে চর্চার মধ্যে দিয়ে। সুতরাং আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি দক্ষিণারঞ্জন  মিত্র মজুমদার এবং তাঁর ঠাকুরমার ঝুলি কালোত্তীর্ণ।

দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি এবং অন্যান্য শিশুসাহিত্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার আগে তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরুর দিকে একবার ফিরে তাকাব। দক্ষিণারঞ্জন ছিলেন রমদারঞ্জন  মিত্র মজুমদার এবং কুসুমকুমারী দেবীর একমাত্র পুত্রসন্তান। মাত্র ন বছর বয়সে তিনি তাঁর মাকে হারান। তারপর থেকে পিসিমা রাজলক্ষ্মী দেবী চৌধুরানীর কাছে মানুষ হতে থাকেন। ছোটবেলায় মা এবং তারপরে পিসিমার মুখে রূপকথা এবং লোককথার নানা গল্প শুনতে শুনতে তিনি বেড়ে ওঠেন। সেইসময় থেকেই তাঁর মনে সেইসব অপরূপ গল্প গভীর ছাপ ফেলে যেতে থাকে। তিনি মনে মনে লালন করতে থাকেন রূপকথার সেই চারাগাছটি, যা পরে মহীরুহ হয়ে আপামর বাঙালি পাঠককুলকে ছায়া দেবে শতাব্দীর পর শতাব্দী।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

একসময় দক্ষিণারঞ্জন তাঁর বাবার কর্মক্ষেত্র মুর্শিদাবাদে চলে আসেন। সেখানে বাবার সযত্নে গড়ে তোলা বিশাল লাইব্রেরি তাঁর সামনে বিশ্ব সাহিত্য জগতের দরজা খুলে দেয়। শুধু সাহিত্য নয়, বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ এবং তার অলংকরণ দক্ষিণারঞ্জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যা পরে তাঁর করা ঠাকুরমার ঝুলির অলংকরণে প্রতিভাত হবে। পঁচিশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ উত্থা প্রকাশিত হয়। সেই সময় থেকেই তিনি সুধা নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতে শুরু করেন। মুর্শিদাবাদে বেশ কিছুদিন থাকার পর তিনি আবার ফিরে যান ময়মনসিংহে, পিসিমার জমিজমা দেখভাল করার জন্য। কাজের খাতিরে তাঁকে বাংলার গ্রামে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াতে হত। সেখানেই তিনি খুঁজে পেলেন বাংলার চিরন্তন রত্নভান্ডার। আবহমানকাল ধরে মা মাসি ঠাকুমা দিদিমা পিসিমারা যেসব রূপকথা-লোককথার পসরা সাজিয়ে বসেন ভাবীকালের জন্য, সেইসব অপরূপ গল্পকথা দক্ষিণারঞ্জন নতুন করে আবিষ্কার করলেন। তাঁর স্নায়ুতে সেইসব রূপকথার গল্পের স্পন্দন সুরচিত হল। একে একে বাংলার বাতাসে, মাটিতে ছড়িয়ে থাকা গল্প সংগ্রহ করতে থাকলেন, সঙ্গী কেবল একটা পুরনো ফোনোগ্রাফ যন্ত্র। গল্প সংগ্রহের কাজ শেষ করে দক্ষিণারঞ্জন চলে গেলেন কলকাতায়। তারপর শুরু হল সংগৃহীত গল্পের সঙ্গে কল্পনার মাধুরী মিশিয়ে এক অনন্য অধ্যায় সৃষ্টির কাজ।

১৯০৭ সালে ঠাকুরমার ঝুলি বই হয়ে প্রকাশিত হয়। দক্ষিণারঞ্জন তাঁর বইয়ের গল্পগুলিকে সাজিয়েছিলেন মা-ঠাকুমার মুখের ভাষায়। যেন পাঠক তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে চিরন্তন সেই আদুরে স্বর শুনতে পায়। কিন্তু হায় রে বাঙালি পাঠক! তাদের কপালে সে সুখ সইল না। কিছু বেরসিক সমালোচকের সমালোচনার চাপে পড়ে দক্ষিণারঞ্জন তাঁর গল্পের ভাষা বদলাতে বাধ্য হন। এখন আমরা যে ঠাকুরমার ঝুলি হাতে পাই তা সেই পরিমার্জিত রূপ।

এই রূপে ঠাকুরমার ঝুলি পুনরায় প্রকাশিত হওয়ার পর বাঙালি পাঠক তাকে সাদরে গ্রহণ করে। প্রকাশের সালটি আমাদের খেয়াল করতে হবে — ১৯০৭। দুবছর আগেই বঙ্গভঙ্গ হয়েছে। তার আগুন মানুষের মধ্যে তখন প্রবলভাবে জ্বলছে। বাঙালি নিজের অতীতকে নতুন করে তুলে আনবার চেষ্টা করছে পায়ের তলার মাটি শক্ত করবার জন্য। আমরা যদি সেই সময়ের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব একদিকে রবীন্দ্রনাথ ছেলেভুলানো ছড়া সংগ্রহ করছেন, পাশাপাশি গোরার মত একটি উপন্যাস লেখা হয়ে চলেছে। সে বছরই হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে খুঁজে আনছেন চর্যাপদ, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বাংলার ব্রতকথা সংকলন করছেন। সবাই শিকড়ের সন্ধানে রত। এর মাধ্যমে হয়ত তাঁরা নিজেদের বোঝবার, নিজেদের জানবার চেষ্টা করছেন। নিজেদের পরিচয় গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন, যে পরিচয় ঔপনিবেশিক ছায়া মুক্ত এক স্বতন্ত্র পরিচয়। দক্ষিণারঞ্জনের ঠাকুরমার ঝুলি এই ধারা বহির্ভূত নয়, আমরা তাকে এই আত্মানুসন্ধানের প্রক্রিয়ার অঙ্গ হিসাবেই দেখব। তাহলে তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বুঝতে সুবিধা হবে।

ঠাকুরমার ঝুলিতে দক্ষিণারঞ্জন শুধু গল্পের পসরা নিয়েই হাজির হলেন না, ছোটদের মনোগ্রাহী করে তাদের কল্পনাকে উসকে দিতে তিনি তার সাথে প্রচুর ছবি নিজে আঁকলেন, তারপর উড কাটে খোদাই করিয়ে ছাপলেন। ঠাকুরমার ঝুলির প্রশংসায় সেই সময়ে যাঁরা কলম ধরেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রমেশচন্দ্র দত্ত, স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অক্ষয়কুমার মৈত্র, স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতেও এই বইয়ের প্রশংসা করে বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাঙালি শিশুমনে এই বই চিরন্তন জায়গা তৈরি করে নেয়।

দক্ষিণারঞ্জন তাঁর গোটা জীবন মূলত শিশুসাহিত্য সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত করেন। ঠাকুরমার ঝুলির পাশাপাশি তিনি ছোটদের জন্য লিখেছেন দাদামশায়ের থলে, ফার্স্ট বয়, লাস্ট বয়, সবুজ লেখা, বাংলার সোনার ছেলে, চিরদিনের রূপকথা, ক্যাঙ্গারু, উৎপল ও রবি, চারু ও হারু, খোকা-খুকুর খেলা, আশীর্বাদ ও আশীর্বাণী, কিশোরদের মন, আমার দেশ ইত্যাদি। শুধু ছোটদের জন্য গল্প, কবিতাই নয়, দক্ষিণারঞ্জন তাদের জন্য অনেক শিক্ষামূলক বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রবন্ধও রচনা করেছেন। সবুজ লেখার মধ্যে এরকম অনেকগুলি নিদর্শন পাওয়া যায়। বিজ্ঞান সংক্রান্ত লেখা হলেও তা খুবই সহজ এবং সুখপাঠ্য ভাষায় রচনা করা হয়েছে। সেইসব লেখায় শিক্ষার গাম্ভীর্যের লেশমাত্র নেই, আছে গল্প বলার ঢঙে সহজ করে ছোটদের বুঝিয়ে দেওয়ার কৌশল। ছোটদের জন্য লেখার পাশাপাশি তিনি অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান এবং কবিতা রচনা করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হল ‘আমার দেশ’, যাতে পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সুরারোপ করেন। এছাড়াও দক্ষিণারঞ্জনের অন্যান্য লেখাগুলির মধ্যে রয়েছে ঠাকুরদাদার ঝুলি, আর্য নারী, ঠানদিদির থলে ইত্যাদি।

এতগুলো বছর পার করে এসেও দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার এবং তাঁর ঠাকুরমার ঝুলি জনপ্রিয় এবং প্রাসঙ্গিক। তবে সেই তুলনায় তাঁর অন্যান্য লেখাগুলি অনেকটাই অবহেলিত। এছাড়াও তাঁর প্রচুর লেখা অগ্রন্থিত থেকে গেছে এবং অনেক বই এখন আর পাওয়াও যায় না। এখন যদি সুরসিক পাঠক এবং দায়িত্ববান সাহিত্যপ্রেমীরা এগিয়ে এসে দক্ষিণারঞ্জনের সমস্ত কাজ একত্র করে নতুন যুগের পাঠকের কাছে তুলে ধরেন, সেই কাজই হবে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ছাত্র। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। দক্ষিণারঞ্জন লেখকের প্রমাতামহ

আরো পড়ুন

বিদ্রোহ আর প্রেমের দিব্যি

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.