সেদিন একজন প্রবীণ সাহিত্যিকের কাছে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে জানিয়েছিলাম আমার সাঁওতালি ভাষা শেখা খুব জরুরি। কারণটা তিনি জানতেন। এর তিনদিন পর, যখন আমি বিষয়টি প্রায় ভুলে গেছি, তখন তিনি এক রকম উপযাচক হয়ে আমার সাঁওতালি ভাষা শেখা নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। জানতে চাইলেন, রেড ইন্ডিয়ানদের নিয়ে উপন্যাস লিখতে গেলে কি তাদের ভাষা জানা দরকার? আমি তাঁর এই প্রশ্নের একটি চটজলদি উত্তর দিলাম বটে, তবে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ত হল না। আমি বলতে চেয়েছি, অবশ্যই ভাষাটা জানা দরকার। তবে ব্যবহারের জন্য নয়। রেড ইন্ডিয়ানদের বুকনির ভাঁজগুলো জানার জন্য, একজন লেখককে ততটা পরিশ্রমী হতেই হবে।
গদ্যসাহিত্যে সংলাপের একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে। সংলাপ একই সঙ্গে ঘটনা, চরিত্র এবং লেখকের অভিপ্রায়কে তুলে ধরার কাজ করে। অর্থাৎ গদ্যসাহিত্যে সংলাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ টুল হিসাবে লেখকরা ব্যবহার করে থাকেন। সংলাপের মধ্য দিয়ে লেখক কথ্য ভাষার বিভিন্ন ফোনেটিক আবেদন, বাগধারা, সিনট্যাক্স এসব, তাঁর চরিত্র এবং তার পরিপার্শ্বকে স্পষ্ট করতে ব্যবহার করেন। তবে এ কথা বলা যেতেই পারে যে, এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনও স্থির সমীকরণ আমাদের হাতের কাছে নেই। এমনিতেই গদ্যসাহিত্য, বিশেষত নভেল/ছোটগল্প সাহিত্যের অন্য শাখার চেয়ে বয়সে নবীন। কবিতার মতো এখানে নির্দিষ্ট শৃঙ্খলাবদ্ধতা নেই। এর ফলে গদ্যসাহিত্যে নিত্যনতুন পরীক্ষা নিরীক্ষার সম্ভাবনা থেকে যায়। সংলাপ এর ব্যতিক্রম নয়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
বাংলা নভেলের প্রথম সার্থক প্রচেষ্টা প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল। সেই নভেলে ঠকচাচা চরিত্রটি খানিক আরবি/ফারসি আর খানিক চলতি বাংলা মিশিয়ে এক মিশ্র ভাষায় সংলাপ বলে। আমার অনুমান প্যারীচাঁদ বেশ নিরাপদ দূরত্বেই ঠকচাচার ভূগোলকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। ফলে তাঁর সংলাপে কৃত্রিমতা এসেছে। হুতোমের সেই সংকট ছিল না। কারণ তাঁর সাহিত্য বিবৃতিপ্রধান। সংলাপপ্রধান নয়। ফলে আমরা যখন বঙ্কিমের “পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?” সংলাপে এসে পৌঁছাই, তখন এ-ই প্রতীয়মান হয় যে আমরা আমাদের গ্রামজীবনের ভাষা থেকে সরে গিয়ে নদিয়া-শান্তিপুরি ভাষাকে নিজেদের গদ্যে সংলাপ রচনার যোগ্য মনে করলাম। ব্যাপারটা এমন এক পর্যায়ে গেল, যখন গোরা উপন্যাসে আমরা দেখলাম সংলাপ নির্মাণে কৃত্রিমতার ঝোঁক। এই ঝোঁক শরৎচন্দ্রে যেন আরও প্রকট হল! তাঁর চরিত্রের সংলাপ আর শ্রেণিগত না হয়ে প্রতিনিধিগত হয়ে গেল। অর্থাৎ তাঁর বড়দিদি কিংবা মেজদিদি স্থানকাল নির্বিশেষে সর্বত্রই একই ধরণের সংলাপে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। দেখে মনে হয় এই পর্বে সংলাপ নির্মাণে আমাদের সাহিত্যিকদের নজর একচোখা কাকের মতোই খানিক ছিল।
এই অবস্থায় সচেতন এক পাল্টা রাস্তায় এলেন মানিকবাবু, তাঁর পদ্মানদীর মাঝি-তে। কিন্তু কুবের মাঝি পূর্ববঙ্গের কোনও এক নির্দিষ্ট জেলা বা অঞ্চলের প্রতিনিধি না হওয়ায় পদ্মানদীর সংলাপ মোটের ওপর সর্বজনীন প্রান্তিকতায় রূপ পেল। যে রাস্তায় বাকি জীবন মানিকবাবু আর হাঁটেননি। পুতুলনাচের ইতিকথা-য় গাওদিয়ার মানুষজন ওই নদিয়া-শান্তিপুরি ভাষায় সংলাপ বলে। এমনকী অনেক পরে ছোটবকুলপুরের যাত্রী বা রাঘব মালাকার-এ-ও তিনি প্রান্তিক ভাষায় ফিরে আসেননি। তারাশঙ্কর রাঢ় বাংলাকে তুলে ধরলেও সতীনাথের ঢোঁড়াইয়ের মতো কিছু বাগধারা কিংবা সিনট্যাক্স ব্যবহার করে কেবল লোকজ ভাষার আদল রাখলেন তাঁর সাহিত্যে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সংলাপ রচনায় “তোমার মন নাই কুসুম?”-এর স্তরে উঠতে পারেননি। সংলাপে তিনি বহুলাংশে মিতব্যয়ী রয়ে গেলেন।
কমলকুমার সংলাপ রচনায় কৃপণ ছিলেন। যেমনটা ধূর্জটিপ্রসাদ। তাঁরা উভয়েই সংলাপকে প্রায় তাঁদের মূল টেক্সটের অংশ হিসাবে গড়ে নেন। অমিয়ভূষণ রাজনগর-এ সংলাপ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সেই সংলাপ চরিত্রের নয়, তাঁর নিজস্ব অবস্থানগত। তাঁর একই প্রবণতা আমরা দেখি চাঁদবেনে নভেলে। এমনই এক তির্যক অবস্থান নিয়েছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর সংলাপ রচনায়।
সংলাপ রচনার প্রয়োজনীয়তা বাংলা ভাষায় হঠাৎ-করেই ১৯৫০-এর দশক থেকে শুরু হল। যেমন দেবেশ রায় রাজবংশীদের ভাষার আদল নিয়ে এলেন তাঁর সাহিত্যে, ঠিক তেমনই হাসান আজিজুল হক প্রান্তিক মানুষের মুখের ভাষাকে সাহিত্যে সংলাপমুখর করলেন। এই যে ট্রেন্ড — এই ট্রেন্ড, বলা যায়, আজ বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ গদ্যলেখক যেমন ব্যবহার করছেন, ঠিক তেমনি পশ্চিমবঙ্গেও। সংলাপপ্রধান এমন সাহিত্য যেমন উত্তীর্ণ হয়েছে সমরেশ বসুর দেখি নাই ফিরে-তে বাঁকড়ি বুলিতে, তেমনই হাসান আজিজুলের আগুনপাখি-তে। কিন্তু খুবই দুঃখের, দেবেশ-আজিজুল প্রান্তিক মানুষের সংলাপকে যেখানে নির্দিষ্ট ভূগোলের জন্য সার্থকভাবে রচনা করতে পেরেছেন, তেমনটা সকলে পারেননি। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংলাপ — আরোপিত বুকনি হয়ে গেছে। এর টাটকা উদাহরণ গত কয়েক বছরের দুই বাংলার ব্যর্থ উপন্যাসের তালিকা। যদি একটু ঘনিষ্ঠ নজরে দেখা যায়, তাহলে হয়ত দেখা যাবে কৃত্রিম সংলাপ রচনার কারণেই উপন্যাসগুলো বহুলাংশে ব্যর্থ হয়েছে।
এবার আমি আসি বাংলা গদ্যসাহিত্যে সংলাপ-রচয়িতা এক অথর-এর কথায়, যিনি এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে এক অনাবিষ্কৃত প্রহেলিকা! তিনি হলেন জীবনানন্দ দাশ।
জীবনানন্দের গদ্যসাহিত্য সংলাপমুখর। তিনি অনেক ক্ষেত্রে কেবল সংলাপ ব্যবহার করে কাহিনীর পরিণতি কিংবা না-পরিণতিতে পৌঁছেছেন। পরপর টানা সংলাপ লিখে গেছেন। কিছুটা পরে পাঠকের পক্ষে বোঝা দুষ্কর হয়ে যায় সংলাপের মালিক কে। নারী? না পুরুষ! একই লোক কি সংলাপগুলো বলছে? নাকি বাখতিন-তত্ত্বমতে বহুস্বর? আমরা এই বিষয়ে বিস্তারে যাব, তার আগে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলে নেওয়া যাক।
জীবনানন্দ খোদ বরিশালের মানুষ হয়েও কোথাও বরিশালি ভাষার টান ব্যবহার করেননি। এমনকী বাড়ির মেয়েদের সংলাপ রচনাতেও তিনি সম্পূর্ণত ছিলেন শান্তিপুরি, অর্থাৎ কলকাতার লিখিত ভাষা অনুসারী। বাঙাল ভাষার কোনও গন্ধ সেখানে নেই।
এবার সংলাপ রচনার রহস্যময়তায় আসা যাক। জীবনানন্দের সংলাপ বহুকৌণিক। প্রথমত, যে চরিত্রের মুখের সংলাপ, সেই চরিত্রের বৈশিষ্ট্য তিনি রাখছেন সংলাপে। দ্বিতীয়ত, ভাষাগত প্রান্তিকতা না থাকায় স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে চরিত্রের মুখে যে সংলাপ, তার মালিক কিন্তু লেখক স্বয়ং! লেখকের নিঃশব্দ নির্দেশে চরিত্রগুলো সংলাপ বলছে। আবার সংলাপগুলো যখন পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করছে, তখন বেশ বোঝা যাচ্ছে আসলে সংলাপগুলো ভান। অথর জার্নালধর্মী কিছু লিখছেন। মনোলগ। স্বগতোক্তি। নিজের কথা নিজেই বহু চরিত্রের মুখ দিয়ে বলিয়ে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। দ্বিধা-দ্বন্দ্বে (যেমন তাঁর রচনায় বহুল ড্যাশ আর হাইফেনের ছড়াছড়ি থাকে) সংলাপের মালিক কখনও লেখক নিজেই, কখনও-বা চরিত্র, কখনও আবার স্বয়ং পাঠক। এ এক অদ্ভুত প্যারাডক্স! আবিলতা। যাঁরা এই প্যাটার্নটিকে মান্যতা দিয়েছেন, যেমন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, অরূপরতন বসু, কমল চক্রবর্তী — তাঁদের কাছে সংলাপ প্রান্তিকতা থেকে উঠে এসে, বড় নিজস্ব হয়ে গেছে। আপন হয়ে গেছে।
ফলে রেড ইন্ডিয়ানদের নিয়ে নভেল লিখলে আমি অবশ্যই রেড ইন্ডিয়ানদের মুখের ভাষা সংলাপ হিসাবে ব্যবহার করব না। তবে তাদের ভাষাটা আমাকে জানতেই হবে, যাতে কোনও চরিত্র ঠকচাচার মতো কৃত্রিম না হয়ে ওঠে। কিংবা কপালকুণ্ডলার মতো পরিশীলিত। চরিত্রের আদল রক্ষায় আমাকে জানতে হবে তাদের সংলাপের বুকনি। এটাই বোধহয়, মাস্টারি না করে, বাংলা সাহিত্যের চালু রুট হয়ে উঠতে পারে।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।