প্রবুদ্ধ ঘোষ

আশু অনেক মাস পরে একটা কেস পেয়েছিল। কিন্তু, এ কেসটাও রইল না বোধহয়। বোধহয় কেন, রইলই না। কোনও কেসই কি সল্‌ভ করতে পারবে না আশু? নিজেকে এত ভেঙেচুরে নেওয়ার পর, নিজেকে ক্লায়েন্টদের পছন্দসই ধাঁচায় সাজিয়ে নেওয়ার পরও আশু পারবে না?

সমস্যাটা কোথায়?

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

কমাস আগে একটা কেস পেয়েছিল – বাড়ির মেয়ে বিয়ে করে পালিয়েছে। “হারামজাদা একটা মোল্লা ওকে ফুঁসলে নিয়ে গেছে” বলেই ঘিয়ে শার্ট, সোনালি ফ্রেমের চশমার ছেলেটা একটু থমকেছিল। বোধহয় আশুর পুরো নামটা মনে পড়ে যেতেই। কিন্তু ওর কথার খেই শেষ করতে না দিয়ে ভারিক্কি লোকটা বলেছিল, “পুরো খোঁজ আনতে হবে আপনাকে। কোথায় আছে, কী করছে। তারপর বাকিটা আমরা… আপনার রিলেটিভদের মধ্যে খোঁজ নেবেন একটু”। এই শেষ বাক্যটা খচ করে বুকে বিঁধেও পিছলে গেছিল মন থেকে। এসবে এখন আর মন ভারি করে থাকে না আশু। পেশাদার গোয়েন্দা হতে গেলে এসব থাকলে চলবে না। আর, বাড়ির কলেজপড়ুয়া মেয়ে চিঠি লিখে চলে গেছে বিয়ে করে, তখন অত বুঝেসুঝে মেপে কি শব্দ-বাক্য আসে? ক্লায়েন্টরা বোস। আমহার্স্ট স্ট্রিটে বাড়ি। ভারিক্কি লোকটির ভিজিটিং কার্ডে লেখা – আলোকময় বসু, বি.টেক এম.টেক এমআইটি। “আশুবাবু, নমস্কার…” বলে ফোন করে দেখা করেছিল ক্যাফেতে। বোধহয় লোকাল কারোর থেকে নম্বর পেয়েছিল। তাড়াহুড়োয় পুরো নাম জোগাড় করতে পারেনি। তারপর ক্যাফেতে বসে পরিচয়ের সময় পুরো নাম আশফাকউল্লা শুনে ওদের একটা অস্বস্তি খেয়াল করেছিল আশু। গোয়েন্দা হতে গেলে পর্যবেক্ষণ খুব জরুরি। আশফাক নিজেকে সবসময় আশু বলেই পরিচয় দেয়। বাড়িতে ভাগ্যিস কোনো নামফলক নেই। থাকলে একটু আতান্তরে পড়তে হত। বাড়ি এসে ক্লায়েন্ট কথা শুরুর আগেই যদি ‘আশফাকউল্লা’ জেনে অস্বস্তি বোধ করত বা পিঠ দেখিয়ে দিত? আশুদের কোনোরকম আড়াই কামরার ঘরের ভেতরটা সাজানো। বাপিবাবু, মানে যে ক্লায়েন্ট নিরুদ্দিষ্ট বাবার খোঁজ করাতে এসেছিল, সে একটু বিস্ময় নিয়েই তাকাচ্ছিল চারদিকে। আশু চা-সিঙাড়া দিয়েছিল প্লেটে। সিঙাড়ায় কামড় দিয়ে বলেছিল, “বাঃ ক্যাটক্যাটে সবুজ রং না, আসমানী রং করিয়েছেন তো বেশ! পর্দাগুলোয় পুঁতি-জরি লাগানো নেই। মফতলালের কি? আমাদের বাড়িতেও এর’ম অফ-হোয়াইট…” আশুর গোয়েন্দামন ভদ্রলোকের বিস্ময়ের কারণ বুঝেছিল। আশুর খারাপ লাগতে লাগতেও লাগেনি। ওদের নাকিবুল্লা লেনের খুপরিগুলোতে বা হারসি স্ট্রিটে বেআইনি দোতলা তিনতলা উঠে যাওয়া কোঠাগুলোর খুপরিতে অতি ঝলমলে পর্দা ঝোলে না? আশু ওর কামরায় আশফাকউল্লা বলে চিহ্নিত হওয়ার সব বন্দোবস্তই সরিয়ে ফেলেছে। আব্বু-আম্মুর কামরায় কিছু চিহ্ন মোছা যায়নি। আশু বোঝে ভাল গোয়েন্দা হতে গেলে ওসব চিহ্ন ছাড়তে হবেই ওকে। বেশভূষা, লব্জ, আচার, রুচি – অনেককিছুই পাল্টে নিয়েছে আশফাকউল্লা। দেড় নম্বর কেসের সময় সুশ্রী সুবেশ অধ্যাপিকা বলেছিলেন, “ওঃ, আচ্ছা! আপনাকে দেখলে বা কথা শুনলে কিন্তু মনে হয় আপনি বাঙালি”। সবে দেড় নম্বর কেস বলেই পাকাপোক্ত হতে পারেনি আশু, এমনকি জিভটাও প্রফেশনাল হয়নি। তাই অবাক চোখে বলে ফেলেছিল, “ম্যাডাম, আপনি বোধহয় হিন্দু বলতে যাচ্ছিলেন। আমি কিন্তু বাঙালিই। বাঙালি মুসলমান।” অধ্যাপিকা বোধহয় অধ্যাপিকা বলেই বেশ অধ্যাপনাসুলভ ভঙ্গিতে বুঝিয়েছিলেন বাঙালি, হিন্দু ও মুসলিম ব্যাপারগুলি কী কী। বাংলাদেশি মুসলমান আর পশ্চিমবঙ্গীয় মুসলমান কী। দেশভাগের সময় মুসলমানরা বাঙালিদের তাড়িয়ে দিয়েছিল… ইত্যাদি। এই কেসটা ছিল বিয়ের আগে পাত্র যাচাইয়ের। আশু ওর দাদার কাছে শুনেছিল, পাত্রপাত্রী যাচাইয়ের সবচেয়ে ভাল উপায় পাড়ার মুদির দোকানে খোঁজ নেওয়া। দাদার এক দোস্তের বিয়ে ভেঙে গেছিল – মুদির দোকান থেকে জানা গেছিল ধারবাকির ফিরিস্তি, সাট্টার নেশার কথা। আশুও গেছিল বিরাটির শরৎ কলোনিতে। কিছু খোঁজ পেয়েছিল, অনেককিছুই পায়নি। কারণ পাত্র ছেলেটি আধুনিক দস্তুর মেনে অনলাইন কেনাকাটিতে অভ্যস্ত। আশু খাঁটি সত্যান্বেষী হতে চায় বলেই সিস্টেমের ঘাঁতঘোঁত আর ফাঁকগুলো ধরে ফেলেছিল – একটি অনলাইন বিক্রয়কেন্দ্রের আধা-ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করে গলা ভিজিয়েছিল। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কেরানীর সঙ্গে পুরনো আলাপ ঝালিয়েছিল। ছেলেটি কী কী জিনিসের অর্ডার দেয়, ইএমআই দেয় কিনা এইসব জানা যাবে। তবে, আশুর এই কেসটা হাফ। কেসের মাঝপথে অধ্যাপিকা ফোন করে ধরা গলায় বলেছিলেন যে, মেয়ে বিয়েটা করতে চাইছে না কিছুতেই, ও লেসবিয়ানই থাকবে। আশু ভেবেছিল এবারে হয়ত মেয়েটির গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার কথা বলবেন ভদ্রমহিলা; কারণ, মোট ফি-র ১/৩ ভাগ তো দেওয়াই ছিল প্রথম দিন। অধ্যাপিকা আশুর ভাবনায় জল ঢেলে ফোন রাখার আগে ধরা-থেকে-ক্রমশ ভেজা গলায় বলেছিলেন, “সাইক্রিয়াটিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিয়েছি। কোনও ভাল এন্ডোক্রিনোলিজিস্টের নাম্বার পেলে বোলো তো ভাই… ইশ, অ্যাতোদিনেও মা হয়ে কিচ্ছু করতে পারলুম না…”। ফোন রাখার পর গুগল করে আশু জেনেছিল এন্ডোক্রিনোলজিস্ট মানে হরমোনের ডাক্তার, শরীরে বিভিন্ন হরমোন ইমব্যালান্সের ব্যাপারে নিদান দেন তিনি। বাকি টাকা মিসেস দত্ত আর ফেরত চাননি। আশুও উচ্চবাচ্য না করে দুবার “নিশ্চয়ই” একবার “আচ্ছা” আর অস্ফূটে “সেই তো” বলার পরে ফোন কেটে গেছিল।

কমাস আগের কেসটা

এই কেসটার ব্যাপারে খোঁজখবর শুরু করেছিল আশু। মেয়েটির নাম দেবকী। ও যে কলেজে পড়ত, সেখানে গেছে তিনদিন। তালতলা মোড়ের পাশে। কলেজের পাশে পান-সিগারেটের গুমটিতে গল্প জমিয়েছে। কলেজের বাইরে বাইকে ঠেস দিয়ে আড্ডা মারে যারা, তাদের সিগারেট দিয়েছে। “ভাইয়ের অ্যাডমিশন নিতে চাই, তাই এলাম” বলে জপিয়েছে। ছেলেটির নাম শওকত আতিফ খান। দেবকীর বছর দুয়েক সিনিয়র। একবালপুরে থাকে। রইস না হলেও সচ্ছল পরিবার। তবে, বাড়ির সঙ্গে খুব একটা সম্পর্ক নেই। গিটার বাজায়, গান গায়, ওটাকেই পেশা করতে চায়। প্রায়ই বাড়ি ফিরত না। বাড়ির লোকের খুব হেলদোল নেই শওকতকে নিয়ে। আশুর কয়েকদিন সময় লেগেছিল, কোথায় যেতে পারে ওরা, সেটা জানতে। বাড়ির আর কলেজের আশেপাশে খোঁজখবর করে দুটো সম্ভাবনা পেয়েছিল – হয় কেরল নয় তো ব্যাঙ্গালোর। আলোকময় বসুকে ফোন করে বলেছিল আশু। ওর খটকা ছিল, পুলিশে কেন বলেননি আলোকময়রা। কিন্তু গোয়েন্দাবুদ্ধি দিয়েই টের পেয়েছিল – বসুবাড়ির সম্মান তাদের ছোট মেয়ের থেকে অনেক বেশি। গোয়েন্দা লাগিয়ে খোঁজ নিয়ে তারপর প্রয়োজনমত প্রভাব খাটিয়ে মেয়েকে উদ্ধার করে আনবে। আশুর অত ভাবলে চলবে না। আলোকময়ও তেমনটাই ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন – আশুর কাজ ফাইনাল খোঁজটুকু দিয়ে টাকা নিয়ে নেওয়া। ব্যাস। আশু রেজিস্ট্রি অফিসে খোঁজ নেওয়ার জন্য ঘুষ দিতেই যাচ্ছিল। কোন বন্ধুরা সাক্ষী দিয়েছে, তাদের নাম-নম্বর বের করে খোঁজখবর করলেই… তখনই খাঁদু বোস ফোন করেছিল। ওই সোনালি ফ্রেম। ভাল নাম অভিষেক বসু। পাড়ায় খাঁদু বলে পরিচিত। আশু প্রথমেই বোসদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিল। সব পলিটিকাল পার্টিকে নিয়ম মেনে চাঁদা দেয়। একসময় কলকাতায় পাঁচটা বাড়ি ছিল বোসদের। এখন দুটো। চেতলার বাড়ি প্রোমোটারের হাতে যাব যাব করছে। আলোকময়ের বড়দিদি বাড়ির অমতে বিয়ে করে চলে গেছিল। বছর কয়েক পরে স্বামী-মেয়ে সমেত আত্মহত্যা করে। পাড়ার চায়ের দোকানে খবর পেল আশু। “ওদের বংশের মেয়েগুলো ওর’ম। রাঙ্গুঠাকমা মানে, খাঁদুর ঠাকুর্দার মেজদি, সমিতি করবে বলে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে চলে গেছিল মাঝরাত্তিরে। সে এক কেচ্ছা… দাদুর কাছে শুনেছি…” আশু এমন ভাঙা ভাঙা কথা জুড়ে একটা অবয়ব খাড়া করতে পেরেছিল। দেবকী আর শওকতের খোঁজ খাঁদুদের দিলে সেটা ওদের পক্ষে খুব সুখের হবে না, এইটা বুঝতে আশুর গোয়েন্দা-ইনস্টিংক্ট খুব দেরি করেনি। তবু, ক্লায়েন্টের স্বার্থই গোয়েন্দার স্বার্থ। আশু রেজিস্ট্রি অফিসের গেটের থেকে মিনিট দুই দূরে যখন, তখনই ফোন করেছিল খাঁদু – “শুনুন ভাই, আপনাকে আর এগোতে হবে না… ন্না, ন্না, তবে, পেয়ে যাব। কোথায় পালাবে?… আমরা হিমানী মুখার্জীকে অ্যাপয়েন্ট করেছিলুম… হ্যাঁ, উনিই… উনি কেরলে ওদের আস্তানা ট্রেস করে দিয়েছেন… ঠিক আছে, আপনি আপনার মত করলেন… আর দেখতে হবে না আপনাকে… হ্যাভ আ নাইস ডে”। টি-বোর্ডের সামনের রাস্তায় তখন বিকেলের সঙ্গে আলোর সমঝোতা কমে আসছে। অফিসফেরতা লোকজনের জুতোর শব্দ, মোবাইলের রিংটোন, ঝালমুড়ি-পাপড়ি বানানোর শব্দ, ভিখিরির কাতর চাওয়া, মিনিবাসের কন্ডাক্টরের খিস্তি – শেষ বিকেলকে সিনেম্যাটিক করে তুলছে। এত শব্দের মধ্যে, এত বর্ণের মধ্যে আশু শুধু ওই সমঝোতা কমে আসা বিকেলের আলোকেই চিনতে পারল। আশু মোবাইল খুলে নোটসে লিখে রাখল কেস ফস্কে যাওয়ার অনুভূতি। দু-চার লাইন। শেষে – “আশু এই কেসটা পারল না” লিখে নোটস সেভ করার আগে ‘আশু’ কেটে আশফাকউল্লা লিখে সেভ করে মোবাইল পকেটে রাখল। অনেক ভিড় আর শব্দের মধ্যে হঠাৎ একা হয়ে যাওয়ার একটা সন্ধে-সন্ধে গন্ধ আছে। আশু সেদিকেই এগোল। ওই গন্ধটা পেরোতে পেরোতে আশু হিসেব করে নিল আম্মুর জন্য কী কী ওষুধ নিতে হবে। তাড়াহুড়োয় প্রেসক্রিপশন নিতে ভুলে গেছে। নামগুলো মনে আছে। নেক্সিটো-৫ প্রেসক্রিপশন ছাড়া দেবে না। বাকিগুলোয় চাপ হবে না। বাগরি মার্কেট থেকে ফেরার সময় রয়াল থেকে চাপ কেনার ইচ্ছে হয়েছিল আজ। সস্তার আতরের গন্ধের মত সে ইচ্ছে উবে গেছে। সন্ধে-সন্ধে স্বাদ জিভে লেগে আছে। আশু এগোচ্ছে ট্রামরাস্তার দিকে। ওঃ, হেকিমি তেলটা নিতে হবে মনে করে। কোন পীরবাবা আম্মুকে দিয়েছিল – ওতেই ব্যথা কম থাকে বলে আম্মুর বিশ্বাস। আশু পাশের গলির দিকে এগোল।

আশুর কটা কেসের কেস-স্টাডি

সেগুলোর কথা কেমন হলুদ খোয়াবে আসে। আশু নিজের ঘরে শুয়ে। টেবিলে পড়ে রয়েছে মোবাইল। একটা সিরিজ হয়ে যাচ্ছে নিজের মত। এপিসোড এইট। আশু সাত নম্বর এপিসোড থেকেই বুঝতে পারছিল খুনী কে! দুই আর চার নম্বর এপিসোডটা দেখার সময় পজ করে করে চালিয়েছে। জুম করে ভিক্টিমের ঘরের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেছে। পাঁচ নম্বরে হেডফোনের ভল্যুম বাড়িয়ে সন্দেহজনক তিনজনের কথাবার্তা শুনেছে। সাত নম্বর এপিসোডের শুরুতে বুঝতে পারছিল যে, ভিক্টিমের ছেলেই হয়ত আসল খুনি। শেষে এসে অ্যালিবাইগুলো মিলছে না দেখে আর কথা শুনে আঁচ করে ফেলেছে। মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা রয়েছে ছেলের। তবে, বাকি দুই সন্দেহজনকের বৃত্তান্ত হঠাৎ ছেঁটে ছোট করে দিল কেন আশু বোঝেনি। আরেকটু ফেনিয়ে তুললে রহস্যের বিস্তার ঘটাতে পারত। ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট হত। এখন এপিসোড এইট। আরও একটা এপিসোড রয়েছে। আশু শুয়ে আছে। মোবাইলটা বন্ধ করতে ইচ্ছে করছে না। ঘুম আসছে কি? নাকি জ্বর? ম্যাজম্যাজ করছে গা। আচ্ছা, সব সিরিজেই শুধু খুন কেন? খুন ছাড়া কি ক্রাইম হয় না? ওই যে ভদ্রমহিলা নিজের মেয়েকে জোর করে নিজের ধারণাছকে স্বাভাবিক করে তুলতে চাইছেন, ওটা অপরাধ না? আলোকময় বসু ভাইঝির খোঁজ পেয়েছিলেন। এর্নাকুলাম থেকেই ভাইঝিকে জার্মানি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সেজো বোনের কাছে। শওকতের রোজগেরে দাদাকে পুলিশ হঠাৎ থানায় তুলে নিয়ে গেছিল, তাও আবার বাগুইআটি থানা। পরেরদিন শওকতের আম্মুর পায়ের ওপর দিয়ে একটা গাড়ি চলে যায়। এইসব বালামুসিবতের জন্যই হয়ত শওকতকে রাজি হতে হয় কলকাতা ফিরে আসতে। ওর গানের অ্যালবামের টাকা খাঁদু দিয়েছিল। হিমানী মুখার্জীর টিম সবটা মিটমাট করে দিয়েছিল। এটাও কি অপরাধ না? হিমানী নিজে মধ্যস্থতা করেছিলেন বলে শওকতের আম্মুর পায়ের চিকিৎসার খরচের এককালীন চেক দিয়েছিল খাঁদু। ফিজ না-ই বা পেল, গোয়েন্দার সত্যসন্ধানের আকাঙ্ক্ষা থেকে আশু খবর নিয়েছিল। আশু কি এমন সুন্দর-সহজ একটা সমাধান করে দিতে পারত? সেইজন্যেই বোধহয় খাঁদু বিশ্বাস করতে পারেনি আশুকে। তবে, আশুর প্রায়-প্রফেশনাল গোয়েন্দামনে ছাই ছাই মেঘ জমেছিল শওকত-দেবকীর একজন কমন-ফ্রেন্ড অক্রূরের জন্য। অক্রূর সাক্ষী দিয়েছিল ওদের রেজিস্ট্রির সময়। হিমানীর টিমের লোক আর খাঁদু এর্নাকুলামে পৌঁছানোর আগে দেবকীকে ফোনে সাবধান করেও দিয়েছিল। সেই অক্রূর একদিন লিলুয়ায় বাড়ি ফেরার সময় ট্রেন থেকে পড়ে যায়। দরজার সামনের রড থেকে হাত পিছলে গেছিল। কেস ক্লোজড। আশুর খোয়াবে একটা কাঁটা দুলতে থাকে প্রায়ই – দেবকী-শওকতের এর্নাকুলামের নম্বর অক্রূরকে এসএমএস করে দিয়েছিল আশুই। যদি সাবধান করে দিতে পারে ওদের। সিম ফেলে দিয়েছিল পরে। অক্রূর যদি খবরটা না দিত, তাহলে হয়ত ওর হাত পিছলে যেত না। এখন নভেম্বরের আলো কমে গেছে মগরিবের আজানের সঙ্গে। আশুর সঙ্গে মহল্লার সম্পর্ক কমে গেছে যেরকম। ছোটি মসজিদের পাশের নাস্তাঠেক ভুলে গেছে আশু। নওয়াজ, পন্টি, মাহিরা ডাকে না ওকে, দাওয়াত দেয় না। আশুর গা থেকে প্রাচীন ধুলোর মত স্মৃতি খসে খসে পড়ে। আশুর মনকেমন করতে থাকে ব্যর্থ কেসগুলোর জন্য। অক্রূরের জন্য। বাঁকাউল্লার জন্য। সোনাইয়ের জন্য। ছোটি মসজিদের ইমামের দেওয়া লজেন্সের জন্য। অদৃশ্য কাঁটাটা দুলতে থাকে। বিশ্বদেববাবুর কথা মনে পড়ে। খুব ছোটবেলায়, আশু তখন প্রাইমারিতে পড়ে, আব্বুর এক দোস্তের বাড়িতে গেছিল। রাজাবাজারের গ্যাস কোম্পানিতে আব্বুর সহকর্মী ছিল। আবছা আবছা মনে আছে উনি ডান হাতে কনুইয়ের নিচে একটা পট্টি বেঁধে রাখত। ফুল-আঁকা কাপে চা দিত। ওই চায়ের কাপের জন্য মনখারাপ হয়। এমন মনখারাপগুলো কি ঋতজার চুলের মত উড়ে আসে? দেবকীর নাকের পাশে অমনই ছোট্ট তিল ছিল না? আর, ঋতজার মতই দেবকীর কি গজদাঁত আছে? ঋতজা আর আশু ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে গেছে রাজারহাটে। পেয়েও গেল। ঋতজার কপালে টিপ, মাথায় ওড়না আর গজদাঁতের হাসি দেখেই কি বাড়িওলা গলে গেল? আশুর দরজায় বেল বাজছে। কোনো নতুন ক্লায়েন্ট? তখনই ঋতজা চান করে বেরিয়েছে, ভিজে গা। আশু দরজার দিকে না গিয়ে আসমানী রঙের বেডরুমে ঋতজাকে জড়িয়ে ধরে ভেজা কাঁধে ঠোঁট ঘষছে। বিছানার চাদরটা আব্বুর পছন্দ করে কেনা। আব্বু তো মরে গেছে। বিছানা খালি। ঋতজার ঠোঁটে স্ট্রবেরি? আশুর নিঃশ্বাস ঘন হতে হতে লিঙ্গ শক্ত হচ্ছে। ঋতজা হাতে নিতেই আশুর শরীর কাঁপছে। “এটাই সুন্নত করা? আচ্ছা, এর’ম কাটা বলেই কি তোরা ছোট থেকেই ভায়োলেন্সে বিশ্বাস করিস?” আশুর শরীরের কাঁপুনি কমে আসছে, কেমন অদ্ভুত একটা স্বাদ মাথাকে শান্ত করে দিচ্ছে।

#

আশু একটা অদ্ভুত কেস পেয়েছিল। বাগবাজারের বোসপাড়ার যেখানে পুরনো বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট উঠছে, সেই গলির তিন নম্বর বাড়ির কেস। যৌবনের শেষপ্রান্তে মারা যায় সোনাই। স্বজন কেউ ছিল না। পরিজন ছিল কিছু। তারা বাড়িটির নিচের তলা হড়প করার চেষ্টা করলে সোনাইয়ের পাড়ার দুই বন্ধু আশুর কাছে আসে। ঘোঁতনদার ঠেকে কবে যেন আলাপ হয়েছিল। আলুকাবলি চাটের সঙ্গে রাম খেতে খেতে। আশু প্রাইভেট ডিটেকটিভ শুনে সাত্যকি আর ফটকা লাফিয়ে উঠেছিল। “আরিব্বাস, দাদা তুমি বন্দুক রাখো সাথে? চাইনিজ? বিলিতি?” আশু হেসেছিল। যে কবার দেখা হয়েছে, আশুকে জিজ্ঞেস করেছে, “দাদা, কেস সলভ করার গল্প বলো না!” আশু গল্প বলেছে। গল্পই। এক অধ্যাপিকা একটি মেয়ের সম্পর্কে খোঁজ করিয়েছিলেন আশুকে দিয়ে – আশু জানিয়েছিল মেয়েটি খুব ভাল, ইস্কুলে পড়ায়। সেই মেয়েটির বাড়িতে কথা বলে তাদের রাজি করিয়েছেন অধ্যাপিকা। আশু গেছিল সঙ্গে, উনিই নিয়ে গেছিলেন। ভাল টাকা পেয়েছিল আশু কেসটায়। উনি নিজে বিজ্ঞান পড়ান তো, উদার খুব। সমকামী বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই; তবে নিজের মেয়ের ব্যাপার, তাই উনি একটু খোঁজখবর করিয়ে নিলেন আর কি! “সবাই মেনে নিল, দাদা? এঃ, আমার হোমোদের কেমন যেন লাগে! অবশ্য ওরা শিক্ষিত, পয়সা আছে, ওদের আলাদা ব্যাপার”, “আত্মীয়-টাত্মীয়রা মানল বিয়েটা? খবরে…” ওদের বিস্ময়ে আশু হেসেছিল। “এখানে হয়নি, উনিই উদ্যোগ নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে পাঠিয়ে দিয়েছেন ওদের। খুব ভাল আছে ওরা।” আরেকবার ওরা একটা বড় পেগ খাইয়েছিল আশুকে। আশু বলেছিল ও গোয়েন্দাগিরি করে একটা কাপলকে খুঁজে বার করেছে। ভয়ে পালিয়ে গেছিল ওরা। সেই কোচি শহরে। আশু মধ্যস্থতা করে দুজনের বাড়িতে বুঝিয়ে আসিফ আর সংযুক্তার সব বিপদ কাটিয়ে দিয়েছে। সত্যান্বেষী তো মানবিকও। সংযুক্তা ওখানেই একটা চাকরি পেয়েছে, আসিফ সুখে আছে। এই কেসে ফি নেয়নি আশু। মেয়ের বাবা খুব বড় মনের মানুষ, তাই জোর করে হাজার পঞ্চাশেক টাকা আশুকে দিয়েছিলেন, সঙ্গে নেমন্তন্ন। “খুব পুণ্যি করলে দাদা, ভাবা যায় না। জানো তো, আমি শারুখের ফ্যান। ওর বৌ কিন্তু হিন্দু। দাদা, পুরো সিনেমার মত কাজ করেছ গো”। আশু হেসেছিল। সেদিন ফেরার পথে সাত্যকি আর ফটকা ওকে জোর করেছিল বিফ ভুনা দিয়ে পরোটা খাবে বলে। জোর মানে আবদার, “আশফাকদা, তুমি তো প্রায়ই খাও। আমাদের আজ একবার নিয়ে চলো না। বাড়িতে তো খাওয়া হবে না… তুমি ভাল দোকান চেনো।” আশু, ঈষৎ লাল চোখ আর বিরক্তি নিয়েই, বলেছিল, “আমি খাই না, ফটকা। আমি ওর’ম না। আমার ভাল লাগে না।” সাত্যকি আহত বিস্ময়ে তাকিয়ে ফটকাকে টেনে নিয়ে চলে গেছিল। মাস তিনেক পরে ফটকাই অবশ্য আশুকে ফোন করে ডেকেছিল ঘোঁতনের ঠেকে। “সোনাইদা খুব জিগরি ছিল আমাদের। তুমি একবার ওকে দেখেছ এখানে আমাদের সঙ্গে। ওর দুটো মাত্র টান ছিল গো – বাড়ি আর মাল। ও কিছুতেই বাড়ি বেচতে পারে না…” আশু তেমন কিছু লাভ নেই জেনেও কেসটা নিয়েছিল। বাপ-মা মরা ছেলেটার সঙ্গে বাড়ির অন্য শরিকরা খুব বাওয়াল করত। প্রোমোটার ডেকে ওরাই চাপ দেওয়াত সোনাইকে। সই করে দিলেই বাড়ি বেচে দেবে। ফটকা, লাড্ডুরা ঠিকই বলেছিল, সোনাইয়ের সঙ্গে ক্ষারাক্ষারি ছিল শরিকি পরিজনদের। আশুর পক্ষে খুব সহজ হয়নি কাজটা। বাঁ হাতের খেল ভেবে কাজটা নিয়ে সপ্তাহ তিনেক লেগে গেছিল। বাড়ির ভেতরের দিকে আর ওপরের তলায় যে আত্মীয়রা থাকত, তারা প্রথমে পাত্তা দিতেই চায়নি। “গোয়েন্দা? আমার জামাইবাবু পুলিশে আছে কিন্তু।” কিংবা “এ বাড়িতে রাধামাধবের পুজো হয়। তুমি ওই সোনাইয়ের ঘরের সামনেটায় দাঁড়িয়ে কথা বলো।” পরিজনরা মুখে মুখে ছড়িয়ে দিয়েছিল যে, সোনাই ওদের কত ঘনিষ্ঠ ছিল, ওদের মান্যিগণ্যি করত। দলিল দেখিয়েছিল, সোনাইয়ের সই জ্বলজ্বল করছে। আশুর অনুমানক্ষমতা ওকে বারবার সতর্ক করে দিচ্ছিল মিথ্যে ধরে ফেলায়। অনুমান করেছিল যে, সোনাইয়ের সইটা জাল। কিন্তু বুঝবে কী করে? নিচের তলার চাবিটাও দিচ্ছিল না। ফটকা-পেদোরা হুজ্জুতি করে চাবি নিয়ে এসে ঘর খুলে দিয়েছিল। দুদিনের মাথায় অবশ্য পাড়ার মোড়ে আশুকে চমকেছিল কাউন্সিলরের ছেলেরা। প্রোমোটারি হলে ওদেরও বখরা থাকবে। আশু হাল ছাড়েনি। যুক্তি সাজাচ্ছিল। অনুমান ধরে এগোচ্ছিল। সোনাইয়ের মৃত্যুটা স্বাভাবিক, হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক। শ্যামপুকুর থানার জুনিয়র এসআইকে ঘুষ দিয়ে ফাইল, রিপোর্ট দেখেছিল। সাত্যকি মার্ডার সন্দেহ করেছিল। আশু তেমন কিছু প্রমাণ পায়নি। তবে, সোনাইয়ের ঘরের আলমারিরর পেছনের দেওয়ালে একটা খোঁদলের মধ্যে দলিলটা পেয়েছিল। সঙ্গে একটা শেষ ইচ্ছে লেখা কাগজ। বড় অদ্ভুত ইচ্ছে – একতলার অতগুলো ঘরের দুটোতে লাইব্রেরি করবে। আর বাঁদিকের দুটো ঘরে বন্ধুবান্ধবের মদ খাওয়ার ছোট ঠেক। খোঁদলটা খুঁজে বের করতেই বেশ কয়েকদিন চলে গেছিল – কেউই ওটার হদিশ জানত না। সোনাইয়ের ডায়রি আর মোবাইলের নোটসে সেভ করা কিছু টেক্সট পড়ে আশু খুঁজে পেয়েছিল খোঁদলটা। ফটকা লাড্ডুদের খুশি ছাপিয়ে একটা খ্যানখ্যানে গলা এসেছিল বাড়ির ভেতর থেকে – “রাধামাধবের বিগ্রহ আছে ভেতরে। একটা নেড়ে এসে মদের ঠেক করবে। তেঁতুলের নেই মিষ্টি আর লেড়ের নেই ইষ্টি এ জন্যেই বলে। বাচ্চুকে খবর দে তো।” বাচ্চু মানে কাউন্সিলর আসবে – এসে নিশ্চয়ই প্রোমোটারের পক্ষে কিছু একটা করবে। লাড্ডু ফটকা পেদোদের ক্ষমতা আর কতটুকু? আর, ঠেক তৈরির কাগজপত্র তো আবগারি দপ্তর দেবে, তাতে আশুর কোনও হাত নেই। এমন ঘোর লোকবসতির মধ্যে না দেওয়ারই কথা। ফটকারা চাঁদা তুলে হাজার পাঁচেক দিয়ে গেছিল আশুকে। আর, বার হয়ে গেলে ফি-হপ্তায় মদ খাওয়ানোর প্রমিস। আশু বুঝেছিল ও পাড়ায় তার একটা স্থায়ী বদনাম হয়ে গেল – ওদিকে আর কেস জুটবে না। তা’লে জুটবে কোথায়? ডেটা-এন্ট্রির কাজে ঢুকবে না আশু। কিন্তু…

নিরুদ্দেশের তদন্ত থেকে প্রাপ্তি

এক ক্লায়েন্ট এসেছিল মানসিক ভারসাম্যহীন বাবাকে খুঁজে দেওয়ার জন্য। পরনে চেক সবুজ শার্ট, ধুসর স্ট্রাইপড নেভি ব্লু ট্রাউজার, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, বয়েস ৭০। প্রত্যেকদিনের রাহাখরচ ৫০০ টাকা আর খুঁজে দিতে পারলে কুড়ি হাজার নগদ। প্লাস আশুর ফিজ তো আছেই। মোটমাট অনেকটা। আব্বুর ইন্তেকালের সময় খুব বেশি কিছু করতে পারেনি আশু। ভেতরে ভেতরে রোগ অনেকটা ছড়িয়ে যাওয়ার পর ধরা পড়েছিল। তখন চিকিৎসার যা খরচ হত, তার অর্ধেক জোগাড় হয়েছিল কোনোমতে। আশু আব্বুকে ভালবাসত খুব, কিন্তু তেমন কিছু করারও ছিল না। এই ভদ্রলোক বাবাকে খুঁজতে এত খরচ করবেন জেনে আশুর হৃদয় নিজের আব্বুর জন্য বেদনার্দ্র হয়ে উঠেছিল। অক্টোবরের শুরু তখন। আশু জানকবুল করে নেমে পড়েছিল। এই ক্লায়েন্টের কেস সলভ করলে একটু নাম ছড়াতেও পারে। একজন অ্যাসিস্ট্যান্টও রাখবে আশু। কাগজে বড় বিজ্ঞাপন দেবে। মোবাইল নম্বর ধরে সুরাহা হয়নি। প্রাচীন মডেলের ফোন, সিম রিচার্জ করা নেই। বন্ধ হয়ে গেছিল। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলেছিল আশু। হাই ব্লাড প্রেশার, একবার ডেঙ্গি – এছাড়া আর কোনো বড় অসুখ নেই। ছেলে বলেছিল মানসিক স্থিতি ঠিক নেই, কিন্তু প্রেসক্রিপশন দেখাতে পারেনি। আত্মীয়রাও কিছু বলতে পারেনি। দূর সম্পর্কের এক বিধবা পিসির খোঁজ পেয়েছিল ছেলেটির জেঠুর থেকে। মুঠিসোনা গ্রাম। মালদার ভেতর। এতদিনে ভদ্রলোককে খুঁজে পেয়েছিল আশু। টাকাকড়ি সাথে কিছু নিয়ে যাননি। পালিয়েছিলেন ছেলের থেকে। আশুর অনুমান মিলে গেছিল। নভেম্বর মাস এগিয়ে আসছে। লাইফ সার্টিফিকেট জমা দিতে বাবাকে ব্যাঙ্কে হাজিরা দেওয়াতে হবে। অক্টোবরের মাঝামাঝি ছেলে এসেছিল তাই আশুর কাছে। পেনশনের টাকা ছেলেই তুলতে পারে, সের’ম ব্যবস্থা করা আছে। ছেলেই তোলে, বিশ্বদেববাবু তার ভাগ পান না। মাসোহারা ছেলেই ঠিক করে দেয়, তাতে বড়জোর পাড়ার দোকানে চা-সিঙাড়া খাওয়া যায়। কিন্তু, নভেম্বরে ব্যাঙ্কে গিয়ে বেঁচে থাকার প্রমাণ না দিলে পেনশন বন্ধ হয়ে যাবে। বিশ্বদেবকে খুঁজে পাওয়া প্রয়োজন। বিশ্বদেববাবুর বাঁচতে ইচ্ছে করে খুব। নভেম্বরে ব্যাঙ্কে না গেলে কী হবে? পেনশন আটকে যাবে? যাক। মুঠিসোনা গ্রামে বাঁচার রসদ কিছু বেশিই আছে। বিশ্বদেববাবুর ওই গ্রামতুতো বোন বেশ যত্নে রেখেছে তাঁকে। ছেলে বাবার নিরুদ্দেশের খবর বেশি জানাজানি করেনি ভয়ে। “অবসাদে ভুগছে, ঠিক হয়ে যাবে, ওই একটু বেড়াতে পাঠিয়েছি নর্থে” – এসব আউড়ে ম্যানেজ দিয়েছিল ব্যাপারটা। আশু ১২ দিনের ৫০০ টাকা করে পুরোটাই নিয়েছিল। তারপর মুঠিসোনা থেকে ফিরে গ্রামতুতো পিসির ঠিকানা বলে দিয়েছিল ছেলেকে। বাকি টাকাটা নিয়েছিল। বিশ্বদেববাবুর “না, ওকে ঠিকানা বোলো না আশু” বাক্যটা কানে লেগে ছিল, কিন্তু বেশিদিন লেগে থাকলে আশু গোয়েন্দা হতে পারবে না। এই কেসটা সলভ করে নতুন কেস যদি আসে, আসুক না! আসেনি। বাপিবাবু আশুকে ফোন করে বলেছিল, “আপনার নাম আশফাক বলেননি পিসির বাড়িতে?” – “আমি তো প্রফেশনাল কাজে গেছিলাম। নাম-পদবি বলার থেকেও কাজটা…”— “না, না আশুবাবু, ইয়ে আশফাকভাই, এটা ঠিক করেননি। পিসি খুব বিরক্ত হয়েছে। বাসনকোসন ফেলতে হয়েছে। আমাকেও চাট্টি কথা শুনতে হল খামোকা।” ফিজের টাকা থেকে কিছুটা কেটে নিয়েছিল বাপিবাবু।

গোয়েন্দা হওয়ার জ্বিন কেন চাপল?

আশু ছোট থেকেই গোয়েন্দা গল্পের ভক্ত। ওর সুন্নতের সময় দূর রিস্তার এক দাদা একটা বই দিয়েছিল – ‘নিজে করো গোয়েন্দাগিরি’। ছোট ছোট গল্প। প্রত্যেক গল্পের শেষে তিনটে করে প্রশ্ন থাকত। পাঠককে সেগুলোর উত্তর দিতে হবে। আশু বইয়ের শেষ পাতার উত্তরগুলো একেবারে যে দেখেনি তা নয়। তবে, ৪০টা গল্পের মধ্যে খান ছয়েক দেখতে হয়েছিল। তিনটে আব্বু বলে দিয়েছিল। বাকিগুলো আশু নিজে ভেবে বের করেছিল। আশুকে গোয়েন্দা গল্পের ভক্ত করে তুলেছে ফেলুদা আর কিরীটি রায়। রাজাবাজারের কোনোরকম একটা বাড়ির কোনোরকম আড়াইটে ঘরে আশুরা থাকে। নাকিবুল্লা লেনের বাকি খুপরিগুলির সঙ্গে আশুদের খুপরির আসল তফাত – দুটো বইয়ের আলমারি। আশুর দাদা শান্তিপুর থেকে কলকাতায় চলে এসেছিল দেশভাগের পরপরই। বাকি রিস্তেদাররা জমি-বাড়ি বদলাবদলি করে বরিশালে চলে গেছিল। আশু তাদের দেখেনি কখনো। দাদার কাছে খুব ছোটবেলায় আশু গল্প শুনত। বুকের পাশে বসে দাড়ি আঁচড়ে দিত, সুড়সুড়ি দিত। আর, গল্প শুনত। আশুর দাদা বস্তির ঠিকা জমির ওপরে বানানো এই যে আড়াই কামরার বাড়িতে উঠেছিল, সেটা আদতে ছিল মফিজুল নামের এক ট্রামশ্রমিকের ছেড়ে যাওয়া ঘর। ছজনের পরিবার থাকত। ১৯৫০-এর মার্চে হাওড়ায় দাঙ্গা শুরু হতেই ওরা ভয়ে পাকিস্তানে চলে গেছিল। আশুর দাদা তার কমাস আগেই কলকাতা এসেছে। শান্তিপুরের মহল্লায় দু-একটা বাড়িতে আগুন লাগানো শুরু হতেই আর ঝুঁকি নেয়নি দাদা। ভিটে ছেড়েছিল, হাতের কাছে যা যা পেয়েছিল আর বই নিয়ে। ছকু খানসামা লেনে মাথা গুঁজেছিল। দুটো ঘরে ঠাসাঠাসি। তারপর নাকিবুল্লা লেনের বাড়িটির হদিশ পেতেই… আশুর ইস্কুলে বা কলেজে এগুলো খুব হাসির গল্প ছিল। এর’ম আদৌ হয়েছিল নাকি? মনার বাড়িতে একবার নাস্তা খেতে গেছিল – আশুদের উদ্বাস্তু হবার কথা শুনে মনার জেঠু হাসি আর রাগ মেশানো কেমন অদ্ভুত গলায় বলেছিল, “শোনো আশফাক, তুমি ছোট তো, এগুলো ঠিক জানো না। ওপার থেকে এঁটো পাতার মতো উড়ে আসার যন্ত্রণা আমরা বুঝি। তোমরা আরামে আছ, তাই রসিয়ে রসিয়ে গল্প বানাতে পারো।” আশু পরে বুঝেছে মনার জেঠুর রাগমেশানো হাসিটা বড্ড গভীর ক্ষত থেকে তৈরি। গল্প-কবিতা যা পড়েছে, সবই তো মনার জেঠুর যন্ত্রণার প্রতিরূপ। জাগৃতি লাইব্রেরিতে যে কটা উপন্যাস আর পুজোসংখ্যা পড়েছে, তাতে মনার জেঠু বা নন্দিনীর দিদার ঠাকুরদালানে মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে আসা ব্যথাটুকু বুঝতে পেরেছে। আশুর দাদা, মফিজুলদের কথা পেয়েছে নাকি সেখানে? আশুর দাদা শান্তিপুরে গ্রামের বাড়িতে একটা আলমারিতে বই রাখত। লোকজন বেশ মান্যি করত। কয়েক বিঘে জমি ছিল। ওই আলমারিতে প্রিয়নাথ দারোগার বই, হুকাকাশি আর পরাশর বর্মা ছিল। আশু অবশ্য পোকায় খাওয়া শুকনো নিমপাতা দেওয়া বইগুলি পেয়েছিল; কিন্তু গোগ্রাসে গিলত। আশুর আব্বু ব্যোমকেশ আর দীপক গোয়েন্দার বই কিনত। আশুর প্রথম ক্লায়েন্ট কিন্তু আশু নিজেই। তার প্রথম গোয়েন্দাগিরি শান্তিপুরে তাদের ভিটে খুঁজে বের করা! মনার জেঠু, নন্দিনীর দিদা বা সৌভিকের ঠাকুর্দার বাস্তবগুলো শুনে শুনে নিজের দাদা আর আব্বুর বয়ানগুলো গপ্পো গপ্পো মনে হত। সন্দেহের নিরসনেই আশুর প্রথম গোয়েন্দাগিরি। ফিরে এসে আব্বুর কাছে প্রথম ক্লায়েন্ট ফিজ চেয়েছিল – ভিটে খুঁজে বের করার যন্ত্রণার ফিজ – যন্ত্রণাটা আব্বুর চোখেও দেখতে পেয়েছিল। আশু বলেছিল, ওদের ভিটের সামনের দিকে ক্লাবঘর হয়ে গেছে। পেছনের দিকটায় মদের ঠেক। ফারুখ আহমেদ বা মোবারকদের নামও কেউ শোনেনি। দাদার কাছে অশ্বত্থ গাছের কথা শুনত আশু। সেটা খুঁজে পেতেই ভিটে চিহ্নিতকরণ করতে পেরেছিল। তবে, আশু ক্রমশ বুঝতে পারছিল যে, আশফাকউল্লা নামের কেউ গোয়েন্দা হয় না। অন্তত গোয়েন্দা সাহিত্য লেখা হয় না তাদের নিয়ে। আশফাকের কলেজবন্ধু সমন্বয় হঠাৎ ফোন করেছিল, “তুই নাকি গোয়েন্দা হয়েছিস? কী কী সলভ করলি?” সমন্বয় বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের প্রথম পর্ব নিয়ে গবেষণা করছে। ও-ই বলেছিল বাঁকাউল্লার কথা। গোয়েন্দা বরকতউল্লা বা বাঁকাউল্লা। দারুণ ইন্টারেস্টিং সব গল্প নাকি! “হ্যাঁ রে, তুই ছদ্মবেশ ধরিস?” আশু কী করে সমন্বয়কে বোঝাবে যে, ক্রমশ একটা ছদ্মবেশের মধ্যেই ঢুকে পড়ছে ও। নাকি, আজন্মের ছদ্মবেশ ছেড়ে বাঙালি গোয়েন্দার বেশ পরে নিতে প্রস্তুত হচ্ছে? তিন নম্বর কেসের সময় এক কনস্টেবলের সঙ্গে নাস্তাপানির সুযোগ হয়েছিল। ভবানীপুর থানা। পরপর কয়েকদিন যেতে হয়েছিল ওকে। জর্দাপান পছন্দ করত কন্সটেবল বিশ্বাসদা। আশু একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, মুসলমান গোয়েন্দাকে নিয়ে কোনো ডিটেকটিভ গল্প লেখা হল না কেন? দত্তদা বলেছিল, “দেখ আশু, বেশিরভাগ চোর-ছ্যাঁচড়া থেকে টেররিস্ট মোল্লা। কথাটা খারাপ ভাবে নিস না। আমি তো নিজে গোয়েন্দা বিভাগে ছিলুম এককালে। জানি। আমাদের কলকাতার, শুধু কলকাতার কেন, গোটা দেশের ক্রাইম রেকর্ড দেখ। মোল্লারাই… তুই রেপ বা রাহাজানি বা সিডিশনের কেস দেখ, দেখবি…” আশু আলাদা করে আর কী দেখবে? ক্রমশ অন্ধকারের মধ্যে দৌড়ের গতি বাড়াচ্ছিল আশু। ওর দৌড় থেকে ছিটকে যাচ্ছিল সাদানিদের ফিজ, বাড়ি ভাড়া না পেয়ে বেঁচে যাওয়া টাকা, ঋতজার ঠোঁট থেকে পিছলে যাওয়া সংলাপ, হারিয়ে যাওয়া ভিটে, আব্বুর বন্ধ হয়ে যাওয়া গ্যাস ফ্যাক্টরি। ইনস্টিংক্ট জেগে থাকে – গোয়েন্দা হতে হবে আশুকে – নামী সাহিত্যিকের প্রচুর বিক্রি হওয়া গল্পের মত দাপুটে গোয়েন্দা। আশু প্রাণপণে চাইছিল অন্তত ভাল মুসলমান হতে। ওর আধার কার্ডে লেগে থাকা পদবি, ওর পদবির গায়ে লেগে থাকা পরিচিতি, ওর পরিচিতির গায়ে জড়িয়ে দেওয়া চিহ্নক, আর প্রতিটি চিহ্নের গায়ে লেগে থাকা প্রত্যাখ্যাত আলো। আশু ঘোঁতনের ঠেক থেকে ফেরার পথে রুটি-তড়কা কিনে এনেছিল। সন্ধ্যে পুরিয়ে গেছে। এশার আজান শেষ হয়ে গেছে। আশু রুটি-তড়কা আম্মুর ঘরে রাখল। নিজের ঘরে এসে গীতা খুলে বসল। আশু রোজ গীতাপাঠ করে। রামায়ণ জানে। ওর বাসায় বইপত্র পড়ার অবাধ স্বাধীনতা ছিল। আশুর পছন্দ ছিল ডিটেকটিভ গল্প। আর, রোজ নিয়ম করে গীতা পড়া। প্রথমদিকে আশফাক খুঁজত কীভাবে ওর হিন্দু বন্ধুদের মতো হওয়া যায়, তাদের পাঠরুচির সঙ্গে নিজেকে মেশানো যায়; তারপর অভ্যেস হয়ে গেল। আশফাক যুক্তিচর্চার জন্য বহু বই থেকে লজিকাল রিজনিং অনুশীলন করেছে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিদেশি গোয়েন্দাদের পড়েছে। কিন্তু, গোয়েন্দা হতে গেলে সবচেয়ে আগে তো সামাজিক গতিবিধির স্বীকৃতি চাই। ক্রমশ তাকে আশু হয়ে উঠতে হবে। আশফাকউল্লার জন্য ডেটা-এন্ট্রির কাজ আছে, শেয়ার মার্কেটের দালালি আছে। হাজিচাচা পার্ক সার্কাসের হাসপাতালে ফুড ডিপার্টমেন্টে টেম্পোরারি কাজ দেবে বলেই রেখেছে। শর্ত একটাই – আশুকে পাঁচ ওয়ক্ত নমাজ পড়তে হবে আর মদ খাওয়া ছাড়তে হবে। “জ্বিনপরির আছর কাটা আশফাক” – এটুকুই তো চেয়েছে হাজিচাচা। কিন্তু, আশু গোয়েন্দা হতে চায়, পেশাদার। ওকে নিয়েও একটা বাংলা গল্প লিখুক না কেউ।

আশু নিজেকে ছেঁটে কেটে ফেলতে চায়

আশু মহালয়া শুনত। ভোরে অ্যালার্ম দিয়ে রাখত। ঠিক চারটেয় উঠে পড়ত। একবার উঠতে পারেনি বলে পরের বছর থেকে মহালয়া শুনে ঘুমোতে যেত। আশু শুধু শুনত না, সেকথা বলতও সবাইকে। সিটি কলেজে বিকেলের নরম আলো ঝালমুড়ি সিগারেট চাউয়ের আড্ডায় “এবার মহিষাসুরমর্দিনী শুনলি? গায়ে কাঁটা দিল না?” কিংবা, “এবার পাঁচ নম্বর চ্যানেলের থেকে ৩ নম্বর চ্যানেলে বেশি ভাল মহালয়া দেখলুম” বলে কথা শুরু করত। একবার অর্ক খ্যা-খ্যা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল, “ওই সুদেষ্ণার নাচ দেখবি বলেই টিভি খুলেছিলি। ফালতু ঢপাস না!” আরেকবার ঋতজা জিজ্ঞেস করেছিল, “কিন্তু, তোদের তো এসব মূর্তিপুজো-টুজো দেখা… মানে এগুলো তোদের হারাম না কী যেন… ওই যে ব্রাহ্মণবেড়িয়ায় মূর্তি ভাঙা হল…” আশু বুঝেছিল ঋতজা খারাপ মনে কিছু বলেনি। ঋতজার মুখ থেকে বেরনো কথা আশুর কাছ অবধি পৌঁছতে পৌঁছতে কেমন ভায়োলিনের সুর হয়ে যেত। ঋতজার চুল এদিক ওদিক উড়লে আশুর বুকেও ডানা ঝাপটাত। আশু সব দেখত, দেখার ভেতরে আরেকটু দেখত। ফুচকা কোল্ডড্রিঙ্ক একসাথে খেত সবাই। কিন্তু আশু যেবার আম্মুর বানানো সেমাই নিয়ে গেছিল, ঋতজার কেন যে পেট খারাপ হল! আশুর গোয়েন্দামন বলেছিল ঋতজা ভেবেছে গোরুর মাংস আর সেমাই এক হাঁড়িতে রান্না হয় বা ঠেকাঠেকি তো হয়ই। কিন্তু, ভায়োলিনের সুর শোনা মন ওকে বুঝিয়েছিল, ওদের ঘরে তো গোরুর মাংস হয়ই না, ঋতজার সত্যিই পেট খারাপ। গোয়েন্দামনের সবচেয়ে বড় শক্তি হল ইন্সটিঙ্কট। অনেককিছু বলতে চাইত সেটা আশুকে, আশু এইসব স্পেশাল কেসে ইন্সটিঙ্কটকে পাত্তা দিত না। আশু মহালয়া নয়, মহিষাসুরমর্দিনীই বলত, স্পষ্ট উচ্চারণে। দুটো গান আর বেশকটা স্তোত্র মুখস্থ আশুর। এখনও। কেউ “মহালয়া শুনি না” বললে আশু তার বলার ভুল ভাঙিয়ে দিত – “না রে, ক্যাসেটের ওপরে মহিষাসুরমর্দিনী লেখা, দেখিস!” নৈঋত ওকে বিশ্বাস করত। ওর ইস্কুলের ব্যাচমেট। বাকিরা “ধুর, আমাদের কালচার তুই বেশি জানিস?” বলে উড়িয়ে দিলেও নৈঋত ওর থেকে গোয়েন্দা গল্পের বই নিত। ওকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে দুবার। আশুর প্রথম মদ নৈঋতের সঙ্গে বসে খাওয়া। বিয়ারে চুমুক। “এসব খাওয়া ঠিক না নৈঋত” – “কেন, হারাম? হ্যাঁ?” হা হা হেসে উঠেছিল নৈঋত। তার পরেও দু-তিনবার বারে যেতে গিয়ে পা হিঁচকেছে আশুর। “ওদের এসব খাওয়া হারাম, তাই ও খাবে না” – কলেজের অনিকেতের কথা শুনে জেদ করেই খেয়েছিল আশু; ওই ছোট্ট গ্রুপটা থেকেও বাদ পড়ে যেত যদি? এসব মনে পড়লে হাসি পায় আশুর এখন। নৈঋত অন্য একটা কলেজে ভর্তি হল। পলিটিক্স করত। আব্বুর সেই দোস্তের মতই। গ্যাস ফ্যাক্টরির দোস্ত। সে কনুইয়ের নিচে হাতের কিছুটা জায়গায় পট্টি বেঁধে রাখত কেন, বড় হয়ে জেনেছে আশু। ওখানে রাম-সীতার উল্কি ছিল। অনেক ছোটবেলায় করানো। বড় হয়ে সেইসব চিহ্ন ছেঁটে ফেলতে চেয়েছিল – উল্কি মোছা যায় না বলেই ঢেকে রাখত পট্টি দিয়ে। আশুর আব্বুকেও বলত অনেক চিহ্ন ছেঁটে ফেলার কথা। আব্বু হাসত। নৈঋতের সঙ্গে ইস্কুল ছাড়ার কয়েক বছর পরে দেখা হয়েছিল – ও তখন পার্টিই করছে মন দিয়ে। আশুর ইচ্ছে এবং ইচ্ছের জন্য বদলে নেওয়া আশুকে দেখে হেসেছিল নৈঋত। ওর সঙ্গে আর দেখা হয়নি আশুর। অনেক রিস্তেদারের সঙ্গেও দেখা হয় না আর। সম্পর্কগুলো আশুর হেডফোনের মতো জট পাকিয়ে যায়। গোয়েন্দা হলেই কি সব জট খুলে ফেলা যাবে?

আশু যেবার ফলো কেসে বাড়ি ভাড়া নিতে গেছিল, ওর ধর্মজ্ঞান খুব কাজে লাগবে ভেবেছিল। এই কাজটা ওকে দিয়েছিল খেতান কোম্পানির ম্যানেজারের আত্মীয়। হাজার সাতেক টাকা খরচ করে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল আশু। ছোট্ট কলাম। ফোন এসেছিল। পার্ক স্ট্রিটের একটা রেস্তোঁরায় ডেকে খেতানের ম্যানেজার কাজ বুঝিয়ে দিয়েছিল। সাদানি ম্যানুফ্যাকচারারের রিজিওনাল হেডকে অনুসরণ করার কাজ। “আমরা লো প্রোফাইল কাউকে খুঁজছিলাম। ওদের নজরে যাতে না পড়ে। আপনার অভিজ্ঞতা আছে এসবে?” স্যান্ডউইচের সবচেয়ে বেশি পুরের জায়গাটা কামড়াতে কামড়াতে মাথা নেড়েছিল আশু। মেয়োনিজের ঠোঁট মুছে বলেছিল, “করেছি আগে কয়েকটা। এত নামী কোম্পানির না। কিন্তু…” রাজারহাটে বাড়ি খুঁজতে হবে আশুকে। ভাড়া। মি. যাদবের বাড়ির কাছে না থাকলে সারাক্ষণ অনুসরণ করা যাবে না। অ্যাডভান্সের থোক খারাপ ছিল না। একটা দেড় কামরার ফ্ল্যাট নেওয়া, অনুসরণ করার গাড়িভাড়া সবই হয়ে যায় দিব্য। আশু ভেবেছিল একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট রাখবেই এবার। ভাল অঙ্কের টাকা হাতে আসবে কেসের পরে। ঘরে আম্মুকে একা ফেলে যাওয়া ঝামেলার একটা উদ্বেগ তো থেকেই যায়। মোতিবিবিকে দিনে আশি টাকা করে দিত। কসাই মহল্লায় থাকে মোতিবিবি। দিনে রাতে তিন ঘন্টা করে এসে আম্মুকে দেখে যাবে। ভাড়া পেল না আশু। প্রথম দুদিন বাড়ি থেকে রাজারহাট চলে গেছিল ভোরে। তারপর সারাদিন গাড়ির পেছনে, যাদবের অফিসের সামনে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে তিন নম্বর দিনে সকালে পৌঁছতে পারেনি। “আজ মিটিংয়ে বেরিয়ে গেছে যাদব। এক মাসের একটা কাজ। সেটাও করতে পারেন না ঠিক করে? টেন্ডারের দিন কোনো গোলমাল হলে…” চার নম্বর থেকে ছ নম্বর দিন ভাড়ার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছে আশু, বাড়ির দালাল ধরেছে। ছ নম্বর দিনে পাড়ার একটা চেনা দালালকে পাঠিয়েছিল রাজারহাটের ওই ব্লকগুলোতে বাড়ি ভাড়া খুঁজতে। নিজে গেছিল যাদবের গাড়ির পেছনে। সন্ধেবেলায় রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল খেতানদের। আটকে গেছিল এক্সপ্রেসওয়েতে। উত্তরপ্রদেশের একটি মসজিদে আগুন লাগানো আর ভাঙাভাঙি কীসব হয়েছে – তার বিরোধিতা করে এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ। যাদব আর সাদানির গাড়ি কীভাবে যেন বেরিয়ে এসেছিল জ্যাম কেটে। আশু আটকে গেছিল। “নিজেদের ধর্মের লোকদের বোঝাতে পারেন না? চুতিয়া শালা। খালি অবরোধ আর আগুন লাগানো। আপনার লোকেরাই আপনার রাস্তা কাটছে?” আশু ভাল শুরু করেছিল। এই কেসটা ঠিকঠাক লাগবেই! সাতদিনের মাথায় আশু ফের আশফাকউল্লা হয়ে গেল। অথচ, বাড়ি ভাড়া নেওয়ার প্রাথমিক কথা ঠিকঠাক এগিয়েছিল। ভোটার আর আধার কার্ডটাই সব গোলমাল করে দিল। “আপনাকে দেখে তো ঠিক… সরি দাদা, আমরা এখন ভাড়া দেব না”… “আপনি ভাল বাংলা বলেন তো! আরবি… না এখন আমরা বাড়ি ভাড়া দিতে চাইছি না, সামনে ছেলের বিয়ে” আশু মরিয়া হয়ে বলেছিল ও গরু খায় না দাড়ি রাখে না নমাজে আগ্রহী না আশু পুজোয় প্যান্ডেলে ঘোরে রবীন্দ্রসঙ্গীত জানে অনেক শ্লোক জানে… আশু ফিরে এসেছিল নাকিবুল্লা লেনে। সাদানিরা অবশ্য প্রফেশনাল। অ্যাডভান্সের অর্ধেকটা ফেরত নিয়ে গেছিল। আশু নিজেকে এত ভেঙেচুরে নিল, তবু কী করে ধরা পড়ে যায়? কেন ব্যর্থ হচ্ছে আশু? আশু একসময় লিঙ্গের ওপরে পুরু করে একটা চামড়ার ঠুলি পরিয়ে রাখত। স্কিন-হাগিং ঠুলি, যাতে কাটা ব্যাপারটা বোঝা না যায় চট করে। নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ত না তাতে? “নমস্কার, আমি আশু” – সহজভাবেই বলত আশু। কিছু কি লাভ হল? ভোটার আর আধারের নাম পাল্টাতে গেলে এফিডেফিট করাতে হয়। কিন্তু, সরকারি দফতর মেনে নেবে? অনেক টাকার ব্যাপার। আশু কি তা’লে টেম্পোরারি চাকরি একটা জুটিয়ে নিয়ে টাকা জমাবে? তারপর যদি পাল্টে নেয় সব? আদর্শ গোয়েন্দা চরিত্র হয়ে উঠবেই আশু।

#

আশফাকউল্লার এই কেসটাও বোধহয় থাকবে না। বোধহয় কেন, থাকবেই না। আঁচ পেয়ে গেছে সে। কেসটা কী, কেন থাকবে না, সেটা জেনে কী হবে বলুন? ঘুরেফিরে একই কথা উঠে আসবে। আর, শেষমেশ এটা তো গল্পই। এসব বাস্তবে হয় নাকি? আশফাকউল্লা রাজাবাজারের ট্রামরাস্তা পেরিয়ে মহল্লায় ঢুকছে। একটা পার্সেল ওর হাতে, প্যাকেটের ওপরে জ্বলজ্বল করছে – রয়াল। এশার আজান শেষ হলে আশফাক রকির ঠেকে পুরনো দোস্তদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠবে। অথব আশু রংচটা সিঁড়ি, স্যাঁৎলা ধোয়া গোসলখানা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালবে – সিসিফাসের মত পরের ক্লায়েন্টের ফোনের জন্য অপেক্ষা করবে। এমন সম্ভাবনাগুলো রেখে গল্পও শেষ হল। রয়ালের প্যাকেটটা একটা রহস্যহীন রহস্য হয়েই থাক। আশু নামটা আর নাকিবুল্লা লেনের আড়াই কামরার ঘরটা ছাড়া বাকি সবটুকু বানানো। নিছক গল্প।

আরো পড়ুন টলমলে ট্রিবিউটে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গুবলেট

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.