গুরুগম্ভীর বিতর্ক বা ইতিহাসের চুলচেরা বিশ্লেষণ নয়, পথচলতি নাগরিকের রোজকার যাতায়াতের পথে অতীতের স্মৃতি বা কোনও প্রশ্ন নিয়ে সাদাসিধে কিছু বয়ান।
বি-বা-দী বাগ অঞ্চলে ব্যস্ত একটি চৌমাথা। উত্তরে রবীন্দ্র সরণি (চিৎপুর রোড), দক্ষিণে বেন্টিঙ্ক্ স্ট্রিট, পুবে বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট (বৌবাজার স্ট্রিট), পশ্চিমে লালবাজার স্ট্রিট। ক্রসিংয়ের উত্তর-পশ্চিম কোণে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর, চলতি লব্জে যা কিনা লালবাজার। রবীন্দ্র সরণিতে একটু ঢুকেই ডান হাতে ৮ নং রবীন্দ্র সরণি। অবশ্য এ বাড়ির পরিচিতি এই ঠিকানায় নয়। সেকালে কলকাতার অন্যতম প্রধান রাস্তা চিৎপুর রোড-কে দুটি অংশে ভাগ করা হয়েছিল — আপার এবং লোয়ার। দক্ষিণবর্তী অংশ — লালবাজার থেকে মেছুয়াবাজার হল লোয়ার। বাকি উত্তরাংশ হল আপার। আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এ বাড়ির ঠিকানা ৬ নং লোয়ার চিৎপুর রোড।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের একদা আবাস ছিল এই বাড়ি। কবিজীবনের স্বর্ণোজ্জ্বল পর্ব এ বাড়িতেই। মাদ্রাজ থেকে ফেরা এবং বিলেত যাওয়ার মাঝখানে। ১৮৫৬-য় মাদ্রাজের পাট চুকিয়ে কলকাতায় ফিরে এসে প্রথমে কিছুদিন ছিলেন ১নং দমদম রোডে, কিশোরীচাঁদ মিত্রের বাড়িতে। জুলাইয়ে পুলিশ কোর্টের হেড ক্লার্ক নিযুক্ত হন। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে ওখানে ইন্টারপ্রেটারের পদ পান। এই সময়েই পুলিশ কোর্টের লাগোয়া চিৎপুর রাস্তার ঠিক ওপারে এই দ্বিতল বাড়িটি ভাড়া নিয়ে বাস করতে লাগলেন। একে একে এই পর্বে তাঁর রচনা: শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, একেই কি বলে সভ্যতা, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, মেঘনাদবধ প্রভৃতি। “এক রাতের মধ্যে করা” নীলদর্পণের তথাকথিত ইংরাজি অনুবাদও এই বাড়িতেই (যদিও অনুবাদক কে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে)। এ বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল বহু স্মরণীয় মানুষের। পণ্ডিত রামকুমার বিদ্যারত্নের কাছে মধুসূদনের সংস্কৃত শিক্ষা এখানেই। ১৮৬১-র মাঝামাঝি অবধি কবি এ বাড়িতে থেকেছেন বলে মনে করা হয়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
বাড়িটির তৎকালীন পরিপার্শ্বের এক টুকরো বর্ণনা আছে গোলাম মুরশিদের আশার ছলনে ভুলি গ্রন্থে: “বাড়িটি মন্দ না-হলেও সে পাড়াটাকে ভদ্রলোকের পাড়া বলে গণ্য করা শক্ত। পাঁচ নম্বর বাড়িটি ছিলো ব্রজনাথ মিত্রের সোডা এবং লেমনেড তৈরির দোকান। অন্য পাশে সাত নম্বরে অল্পদিন আগেও ছিলো ঘোড়া আর গাড়ি ভাড়া দেবার দোকান। দশ এবং এগারো নম্বর তখনো গাড়ি আর ঘোড়া ভাড়া দেওয়ার দোকান। এ ছাড়া, তৈরি কাপড়-চোপড় এবং নানা ধরনের দোকান সেই রাস্তায়। বেশির ভাগ বাসিন্দাই হিন্দুস্তানী। দুর্ভাগ্যক্রমে এ হেন পাড়ায় তাঁকে সে সময়ে বাস করতে হয়েছিলো।”
১৯৮০-র দশক থেকে বাড়িটিতে বার কয়েক গিয়েছি। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায়। ঘরগুলো বড়। বাদ্যযন্ত্র (হারমোনিয়াম ইত্যাদি) তৈরির কারখানা। রাস্তার লাগোয়া দোতলার খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রোমাঞ্চিত বোধ করেছি। বাবার কাছে শুনতাম, সদর দরজায় ঢোকার মুখে বসানো একটা মারবেল ট্যাবলেটে লেখা ছিল : Here lived Michael… ইত্যাদি। সেটি এখন অদৃশ্য।
এই লেখার সঙ্গে অবশ্যই দিতে হচ্ছে আনন্দবাজার পত্রিকা-র অনলাইন সংস্করণে সহসা প্রাপ্ত বাড়িটির একটি ফটোগ্রাফ।
চিত্রঋণ: আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন
ছবিতে দেখা যাচ্ছে দেয়ালে সাঁটা দুটি হিন্দি সিনেমার পোস্টার। তুফান (Toofan) এবং বাদবান (Baadbaan)। ফিল্মি নথি বলছে, দুটিরই মুক্তি ১৯৫৪-য়। ফটোগ্রাফটিও তখনকার, এমনটা নির্ণয় করা যায়। ১৯৫৪ থেকে আজ ২০২১, এত বছরে সে বাড়িতে ঘটেছে বিস্তর সংযোজন, পরিবর্তন। এখনকার ছবির সঙ্গে মেলালেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাড়ির আজ জীর্ণ দশা। দোতলার সামনের ঘরের মাঝের খিলানটি টিকে আছে। রয়ে গেছে সামনের বারান্দায় পুরনো রেলিংয়ের কিছুটা। একতলায় দেখা যাচ্ছে বাদ্যযন্ত্রের দুটি দোকান — শরৎ সর্দার অ্যান্ড সন্স’ আর ‘ মণ্ডল অ্যান্ড কো.’— ১৯৫৪-তে ছিল, এখনও আছে।
৬ নং বাড়ি, এখন
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।