বাংলার থিয়েটার চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ সব অভিনেত্রীরা এসেছেন ঠিকই, কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে বাংলার থিয়েটারে পিতৃতান্ত্রিকতার প্রবল দাপট রয়েছে। একদম প্রথম থেকেই অভিনেত্রীরা প্রচণ্ড বৈষম্যের শিকার। এখনও অবস্থা একইরকম। কেবল পিতৃতন্ত্র নয়, এক ধরনের নারীবিদ্বেষী মনোভাবও তাতে মিশে থাকে। কাজের পরিবেশ অভিনেত্রীদের জন্য একেবারেই অনুকূল নয়। যতই আমরা প্রগতিশীলতার কথা বলি, তাতে অবস্থাটা বদলায় না। কিছুদিন আগেই যেমন এক প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন এক অভিনেত্রী। এইরকম অবস্থায়, তীব্র পুরুষতান্ত্রিক একটা ব্যবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে শাঁওলী মিত্র আর্ন্তজাতিক মানের কাজ করে গিয়েছেন। অন্যতম শ্রেষ্ঠ পারফর্মার, দাপটের সঙ্গে লড়ে গিয়েছেন। শাঁওলীদির মৃত্যুর পর এই কথাটা সজোরে সামনে আনা জরুরি। এটা যে কতবড় সত্যি, সেটা আমরা, থিয়েটারের ভিতরের লোকেরা জানি।

ওঁর সময়টা আরও বেশি জটিল ছিল। তার মধ্যেই লড়েছেন। ওঁর বাবা শম্ভু মিত্র এবং মা তৃপ্তি মিত্র দুজনেই বহুরূপী থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন, এরকম একটা সময়ে শাঁওলীদিকে নিজের দল তৈরি করে কাজ করতে হচ্ছে। শম্ভুবাবু সেই অর্থে আর থিয়েটার করবেন না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একটা পর্যায়ের পরে। তৃপ্তি মিত্রও প্রায় নেই। এই সময় বাংলা থিয়েটারের অভিনেত্রী হিসাবে একটা সময় জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক স্তরে একটাই কিন্তু নাম তখন — শাঁওলী মিত্র।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আমি ভাগ্যবান যে শাঁওলীদির সেরা সময়ের অভিনয় দেখতে পেরেছি। ছোট থেকেই থিয়েটার দেখছি, তাই নাথবতী অনাথবৎ বা কথা অমৃতসমান যখন করছেন, আমি দেখার সুযোগ পেয়েছি। আসলে শাঁওলীদির থিয়েটারের ক্লাসিকাল ট্রেনিং ছিল। বহুরূপী ঘরানা, ধ্রুপদী প্রশিক্ষণ। সেটা একেবারেই শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্রদের হাতে ধরে তৈরি করে দেওয়া প্রশিক্ষণ। কিন্তু শাঁওলীদির সেখান থেকে একটা ডিপার্চারও ছিল। শম্ভু মিত্র বেরিয়ে যাওয়ার পরেও তো বহুদিন বহুরূপী থিয়েটার করেছে। ওঁদের নাটকে শম্ভু মিত্র ঘরানার একটা ছাপ কিন্তু থাকতই। সবসময় সেটা যে খুব সদর্থক ছাপ, এমনও নয়, অনেকসময় বেশ নঞর্থক ছাপও বটে। বলা যায়, একটা ঘরানার সীমাবদ্ধতা ছিল বহুরূপীর। সেই সীমাবদ্ধতাকে শাঁওলীদি একক দক্ষতায় ভেঙে দিয়েছিলেন। ওঁর অভিনয় অনেকখানি সমসাময়িক হয়ে উঠেছিল, বহুরূপীর থেকে অনেকটা আলাদা। এই যে ছাঁচ ভেঙে বেরোতে পারা, এটা খুব বড় বিষয়।

নাটক বাছার ক্ষেত্রেও স্বকীয়তা ছিল। বিতত বীতংস-র মত নাটক একেবারে সমসময়ের ঝুঁটি ধরে নাড়া দিচ্ছে। এর পরে সার্ত্রের একটি রাজনৈতিক হত্যা — অর্পিতা ঘোষের অনুবাদে। শাঁওলীদি অভিনয় করেননি, ওঁর নির্দেশনা ছিল, অসাধারণ এক রাজনৈতিক থ্রিলার।

আরেকটা কথাও বলা জরুরি, পরবর্তীকালে শাঁওলিদি একটা আধুনিক ট্রেনিং মেথডোলজি তৈরি করেন পঞ্চম বৈদিকে। থিয়েটারটা যে হেলাফেলা করার মতো শিল্পমাধ্যম নয়, তাতে সেটা প্রকট হয়েছিল। খুব যত্ন করে তৈরি করা সেই মেথডোলজি থেকেই অর্পিতারা উঠে এসেছেন। খুব আধুনিক ভাবনা এবং প্রয়োগ ছিল সেটা।

শাঁওলীদির আরেকটা দিক নিয়ে বলি। উনি ঠিক হোক, ভুল হোক, সব সময় রাজনৈতিক বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। গা বাঁচিয়ে থাকেননি। আমি বলব, শম্ভু মিত্রের থেকে তাঁর মেয়ের এটাও একটা বড় ডিপার্চার। শম্ভুবাবু বহু বিতর্কিত বিষয়ে একদম চুপ থেকেছেন। গণনাট্যের দিনগুলো বাদে ওঁর প্রায় কোথাও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। খাদ্য আন্দোলনে তো বটেই, এমনকি কার্জন পার্কে প্রবীর দত্তের মৃত্যুতেও পথে নামেননি। সে সময় বাদল সরকার, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় সকলেই পথে নামছেন, অসিত বসু নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কার্জন পার্কেই আবার অভিনয় হচ্ছে। উৎপল দত্ত ঠায় বসে থাকছেন। এই গোটা সময়কালে কিন্তু শম্ভুবাবু চুপ। এমনকি উনি বিবৃতি দিতেও অস্বীকার করেন। জরুরি অবস্থার সময়েও তাই। কোনো কথা বলেননি। যদি ওঁর চাঁদবণিকের পালা নাটকে জরুরি অবস্থার সমালোচনা পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে যাকে রাস্তায় নামা বলে, তা করেননি।

শাঁওলীদি কিন্তু সব সময় প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। তাঁর বিবেচনামত যা করার করেছেন, তাঁর অবস্থান ঠিক না ভুল তা ইতিহাস বিচার করবে। কিন্তু উনি গা বাঁচিয়ে চলেননি। সে কারণে তাঁর মৃত্যুর পরও বহু কথা হচ্ছে। এমনভাবে হচ্ছে, যা শুনতে খুব ভাল লাগছে না। আমি ঠিক ভুলের কথা বলছি না, তার বিচার সময় করবে। ওঁর রাজনৈতিক অবস্থানের আমি তীব্র বিরোধী। রাজনৈতিকভাবে উনি ভুল করেছেন বলে আমি মনে করি। কিন্তু এই যে নিজের বিবেচনামত এগিয়ে যাওয়া, ঝুঁকি নেওয়া — এটা জরুরি ছিল বলে মনে করি। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড়ের সময় যেমন, তৃণমূল আমলেও নাট্য অ্যাকাডেমি ছাড়ার সময়েও তেমন উনি নিজের বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করতে পিছপা হননি।

শাঁওলীদির একটা আশ্চর্য উষ্ণতা ছিল। কমবয়সীদের জন্য এটা ছিল খুব জরুরি। আমি তো ওঁর রাজনৈতিক অবস্থানের বিরোধী, দ্বিধাহীনভাবে বিরোধী। কিন্তু দেখেছি রাজনৈতিক বৈরিতা শাঁওলীদিকে জুনিয়রদের কাজের প্রশংসা করতে বাধা দেয়নি। মন খুলে মতামত দিতেন তিনি। এটা খুব বড় পাওনা আমাদের।

আসলে শাঁওলীদির একটা অদ্ভুত ডিগনিটি ছিল। শম্ভু মিত্রেরও তাই। দুঃখজনক হল, শেষ ১০-১২ বছরে শাঁওলীদির সঙ্গে যে রাজনৈতিক শক্তির যোগাযোগ ছিল, তার কোনো ডিগনিটি নেই। তৃণমূলের মত দল, তার নেত্রী যে রকমভাবে মৃতদেহ হাইজ্যাকের রাজনীতি করেন, শাঁওলীদি যে সেটা করতে দেবেন না, তেমনটাই প্রত্যাশিত। তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রটি তাই হয়ত অনিবার্যই ছিল। ব্যক্তিজীবনে তিনি কোনো ভুল করেননি। সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থানের ক্ষেত্রে হয়ত তিনি বেশ কিছু ভুল করেছিলেন, তার সমালোচনাও জরুরি, কিন্তু সেটা হয়ত এইভাবে নয়। আরেকটু মননশীল, আরেকটু মেধাবী সমালোচনা করা যেত হয়ত। আরও তীব্র সমালোচনা হলেও আমার আপত্তি নেই। কিন্তু শাঁওলী মিত্রের সমালোচনা যদি মেধাবর্জিত উচ্চারণের সমষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে তার কোনো মানে থাকে না। কোথাও আঘাতও করতে পারে না সেই উচ্চারণ।

মতামত ব্যক্তিগত।

আরো পড়ুন:

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।