দিন দুনিয়ায় নীরব শ্রোতার সংখ্যাই বুঝি বেশি। তারা মঞ্চ থেকে, উচ্চকিত দর্শক থেকে একপাশে, এককোণে বসে থাকে। হলঘরের ভরা আসনের থেকে তফাতে এগজিটের মুখে ভিড় করে দাঁড়ায় নিশ্চুপে। তারা কেবল শোনে। তারা রাগ বোঝে না, সুরের রকমফের জানে না, তালের কদর নিয়ে মাথাব্যথা কম, মাত্রাজ্ঞান নেই। কিন্তু গান তাদের ভালো লাগে। টিকিটসেল নাইটে বহুদূর হেঁটে গিয়ে তারা সারারাত জেগে গান শুনে যায় মন্ত্রমুগ্ধের মত। টিকিট না পেয়ে হিম রাতে বাইরে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনে শিল্পীকে। তারা কেবল মনে মনে হাততালি দিতে জানে।
এই মানুষদের দেখেছি জীবনভর। রোজের শ্রমে ঘাম মাখে, ভোঁতা চেহারার, সুরহীন মানুষ সন্ধে হলে একটা রেডিও হাতে জমির আলের দিকে হেঁটে যায়। তখন হরেক শস্তা রেডিওতে সন্ধ্যা গাইছেন তাঁর অদ্ভুত সুরেলা কণ্ঠে — “মধুমালতী ডাকে আয়, ফুল ফাগুনের এ খেলায়”। অন্ধকার বিস্তৃত জমি। তারই কোনো তলদেশ থেকে উঠে আসা সুর, শরীর ঝম ঝম করা স্বর। গরিব মানুষ নীরবে জুড়িয়ে নিচ্ছে তার দেহমনের শ্রান্তি।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
সেই আশি-নব্বইয়ের দশকে আমার শৈশব। গ্রাম-গঞ্জ হলেও তখন কিছুটা সচ্ছল পরিবারগুলিতে সাধারণভাবে গানের চর্চা ছিল। বিবাহযোগ্য মেয়ের অতিরিক্ত গুণ গান জানা। প্রায় প্রতি বাড়িতে হারমোনিয়াম। হারমোনিয়ামের ওপর রাখা গানের খাতা, হ্যারিকেনের আলো পড়েছে স্বরলিপিতে। গানের মাস্টার সাইকেল চেপে আসে ঘন্টি বাজিয়ে। সন্ধেবেলা লন্ঠন হাতে মুদির দোকানে যেতে যেতে শুনতে পাই রিডের খটখট, বেলোর প্যাঁ-পোঁ, বেসুরো গলার, ভুল উচ্চারণে কিশোরী কণ্ঠের রবীন্দ্র-নজরুল গানের সান্ধ্য আয়োজন। তার মধ্যে কেউ কেউ বিপ্লব ঘটিয়ে আধুনিক গান তুলে ফেলত, “হয়ত কিছুই নাহি পাব, তবুও তোমায় আমি দূর হতে ভালোবেসে যাব।” গানের মাস্টারের সঙ্গে মেয়েরা পালিয়ে বিয়ে করতেও ভালোবাসত! বুঝি বা এই আশায়,জীবন তার ভরে থাকবে অফুরান সুরে।
দারিদ্র্য-জর্জর সেই সময়ে আমাদের পরিবারে গান শেখা বিলাসিতা মাত্র। অভাবের বিরাট সংসার, প্রত্যহ কলহ, অশান্তি। একদিন বাবা কীভাবে কষ্টার্জিত সঞ্চয়ে একটি নতুন রেডিও নিয়ে হাজির, সঙ্গে নতুন এভারেডি ব্যাটারি। ঘরে এক দানা চাল নেই। মা কলাপাতার টুকরো ডাঁটায় সামান্য তেল মাখিয়ে তাবায় বুলিয়ে জলে গোলা আটার চকলি ভাজছে আর কাকা-পিসি সমেত সাত আটটি জুলজুলে লোভী চোখ চেয়ে আছে সেইদিকে। বাবা পুকুরঘাটের ক্ষয়ে যাওয়া ধাপে বসে রেডিও চালায়। সন্ধ্যা মুখার্জি মধুক্ষরা গাইছেন “ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত, আসেনি তো কভু আর, জীবনে আমার।” সদর পুকুরের ওই পারের আকাশে তখন আধখানি চাঁদ, তার আলোর সুর জলে পড়ে ঝিলমিল করছে। এই মহাবিশ্বে তখন ক্ষুধা নেই, খিদের কাতরতা নেই।
তাঁর বেসিক রেকর্ড আর ছায়াছবির গানই জীবনভর বেজে গেছে আমাদের কানে। সেই গানের অন্তরালে তাঁর রাগসঙ্গীতের গভীর সাধনা সুপ্ত থেকেছে। সতেরোটি হিন্দি ছবিতে গান গেয়েছেন এ কথা জেনেছি কত পরে! সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের একটি হিন্দি গান চেষ্টা করলেও মনে পড়বে না। যেন প্রকৃতভাবে একটি নিখাদ বাঙালি কণ্ঠ সুরে, স্বরে প্রতিটি বাংলা শব্দ ঘষে, চেঁছে, মেজে মসৃণ করেছেন, শব্দগুলির গায়ে ফুলের রেণুর মত মিহি সুর বুলিয়ে দিচ্ছেন, জন্ম নিচ্ছে এক আবেশ। তাই, “কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে” গাওয়ার সময় ‘কিছু-ক্ষণ’ উচ্চারণের ম্যানারিজম কানের ভেতর প্রজাপতির পাখা মেলার মত খিলখিল হেসে ওঠে।। সুরকার, গীতিকাররা সাজিয়ে দিয়েছেন, আর তিনি ঢেলে দিয়েছেন গান। যার যেখানে যত নীরব অভাববোধ, মালিন্য, মুখ বুজে থাকা, এক অত্যাশ্চর্য প্রফুল্ল গায়কীতে ক্ষণিকের জন্য মুখ তুলে তাকায়। প্রেম ভাঙা মন কতবার গুনগুনিয়েছে “চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কী হবে, জীবনে তোমায় যদি পেলাম না।”
এভাবেই তো আমার শৈশব ছাড়ায়, কৈশোর আসে, আসে তারুণ্য, যৌবন। আর বাবা এই সময়কালের মধ্যে একটা একটা রেডিও বদলায়। পাড়ার মাইকে রেকর্ড প্লেয়ারে ঘোরা লং প্লে থেকে প্লাস্টিকের খাপে ভরা ম্যাগনেটিক টেপের ক্যাসেটের রাজত্ব, টেপ রেকর্ডারের রমরমা, বাড়ি বাড়ি কুলুঙ্গির থাকে থাকে ক্যাসেট সজ্জা ছাড়িয়ে সিডি এবং পেন ড্রাইভের সময় পেরিয়ে ইউটিউবের গানের সাম্রাজ্য, প্রতিটি ধাপ পেরিয়েছি মোহগ্রস্তের মত। সন্ধ্যা প্রতিটি ডিভাইস আলো করে গেয়ে চলেছেন, বাবা রেডিও ছাড়েননি আজও। প্রতিটি বদলে যাওয়া রেডিওতে সন্ধ্যার গান নতুন হয়েছে আরও। “আমায় চিরদিনের সেই গান বলে দাও, আমায় চিরদিনের সেই সুর বলে দাও।”
আরো পড়ুন লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণ: বিষাদসুর
সুর তো এমনই। যার মূর্ত ব্যাখ্যা নেই, কেবল অনুভব আছে। যে সুর গান-বোদ্ধার মস্তিষ্ক থেকে চাষির হাতের রেডিওতে ছড়িয়ে যায়। আর যিনি সেই সুর অপার্থিব কণ্ঠে ধারণ করে পাঠান আমাদের কাছে, তাঁকে নীরবে গ্রহণ করতে হয়, নিরুচ্চারে, বিনত শ্রদ্ধায়। নব্বই বছর বয়সের এক পূর্ণ জীবনের চলে যাওয়া শোক ডেকে আনে না। বরং এক বিষণ্ণ সন্ধ্যাতারা আকাশে জ্বলজ্বল করে। বাবা অনেকদিন পর আবার রেডিও চালায়। এই স্বর, এই সুরের তো ক্ষয় নেই।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।