শিবনাথ শাস্ত্রী আমাদের ভারতের নবযুগের ঊষাপুরুষ রামমোহন রায়ের ব‍্যাপারে বলতে গিয়ে লিখেছেন, “নিজের গূঢ় আত্মশক্তিতে এতদূর বিশ্বাস ছিল যে, কিছুতেই তাঁহাকে দমাইতে পারিত না, কোনও বিঘ্ন বা বাধা তাঁহাকে স্বকার্য সাধনে বিমুখ বা নিরুদ‍্যম করিতে পারিত না। যাহা একবার করণীয় বলে অনুভব করিতেন, বজ্রমুষ্টিতে তাহাকে ধরিতেন, এবং পূর্ণ মাত্রায় তাহা না করিয়া নিরস্ত হইতেন না।”

আমরা যদি আমাদের ভারতীয় চলচ্চিত্রের ঊষাপুরুষ সত‍্যজিৎ রায়ের দিকে তাকাই, তাঁর মানসিক গঠনের দিকে তাকাই, তাহলে আমরা তাঁর মধ‍্যেও এই ধরনের মনোভাব দেখতে পাব। তিনি অসংখ্য ছবি পর্যবেক্ষণ করে, বিশ্ব চলচ্চিত্রের আত্মাকে স্পর্শ করে বুঝতে পেরেছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রে কিসের অভাব। কিন্তু এই অভাবের কথা বুঝতে পেরে, তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রের একজন সর্বজ্ঞানী সমালোচক হয়েই বসে থাকেন নি। থাকতেই পারতেন। যেমন সব জেনে শুনে বহুসংখ্যক মানুষ হাত গুটিয়ে বসে থাকেন এবং বলেন “কিছুই হল না। এ দেশের কিছুই হবে না। বিদেশের দিকে তাকাও। এ দেশে কিছুই হবার নয়।” কিন্তু তিনি একবার যখন বুঝতে পারলেন ভারতীয় ছবিতে সমস্যা কোথায়, নিজে এগিয়ে এলেন। অলস কথা এবং সমালোচনার জগৎ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন নির্মম ছায়াছবির জগতে। যেখানে পদে পদে ছড়িয়ে রয়েছে প্রত্যাখ্যান। যেখানে সিনেমার বাজার শুধু লাভ লোকসান বোঝে। সেইখানে তিনি নামলেন। একেবারে কাদাজলে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন — বলে হবে না, করে দেখাতে হবে। সত‍্যজিৎ নিজের সৃজনশীলতার ব‍্যাপারে ভীষণ সচেতন ছিলেন কিন্তু তাঁর মনেও দোলাচল ছিল। বিজয়া রায় আমাদের কথা বইতে লিখেছেন সত‍্যজিতের এই দোলাচলের কথা। বিজয়াকে তিনি বারবার জিজ্ঞেস করেছেন “আমি কি পারব?” ক্রমে স্থির হয়েছেন। আত্মবিশ্বাস জড়ো করেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি কী ধরনের কাজ করতে চান এবং একবার মনস্থির করার পর সেই কাজে নিজের সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছেন। এ যেন শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাষায় “যাহা একবার করণীয় বলে অনুভব করিতেন, বজ্রমুষ্টিতে তাহাকে ধরিতেন, এবং পূর্ণমাত্রায় তাহা না করিয়া নিরস্ত হইতেন না।”

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

সত‍্যজিৎ চরিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল শিল্পের ব‍্যাপারে স্পষ্ট কিছু মতামত এবং কিছু ক্ষেত্রে অনমনীয়তা। একটি আপোষহীন মনোভাব। তিনি যেটায় বিশ্বাস করেছেন, তিনি সেটার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। এর ফল যে সবসময় ভালো হয়নি, তা তিনি করুণাশঙ্কর রায়কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন “প্রথম (চিত্রনাট্য) ছিল ঘরে বাইরে — ফর্টি সেভেনে করেছিলাম। আমরা তখন ফিল্ম সোসাইটি স্টার্ট করেছি, হরিসাধন দাশগুপ্ত হলিউড থেকে ফিরেছেন, উনি মেম্বার হলেন। আমরা তার আগেই ঘরে বাইরের ফিল্ম স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা করেছি অল্পবিস্তর। রাধামোহনবাবুর যাতায়াত ছিল ফিল্ম সোসাইটিতে, উনি বলেছিলেন নিখিলেশ অভিনয় করবেন। তা হরিসাধন আমাকে বললেন, আপনি একটি সিনারিও লিখুন। দুম করে হরিসাধন সেই ফাঁকে কোন সময়ে যেন ঘরে বাইরের ডাবল রাইটস কিনে ফেলল বিশ হাজার টাকা খরচ করে। আমি চিত্রনাট্য লিখব, ও পরিচালনা করবে এবং বংশী আর্ট ডিরেক্টর হবে। ক‍্যামেরার কথা বোধহয় অজয় করকে বলা হয়েছিল।” . . . এরপর প্রোডিউসারের সঙ্গে কনট্র‍্যাক্ট হয় তাঁদের। কিন্তু তারপর? সত‍্যজিৎ বলছেন, “এমন সময় হঠাৎ একদিন প্রোডিউসার — তাঁর নাম মজুমদার ছিল — ডেকে পাঠালেন; বললেন শুনুন আপনার চিত্রনাট্য তো শুনলাম, ওটা আমার এক বন্ধুকে শোনাতে চাই। . . . যাই হোক তিনি শুনলেন।” এরপর প্রোডিউসার এবং তাঁর বন্ধুর মনে হয় যে চিত্রনাট‍্যে অল্পবিস্তর পরিবর্তন করা দরকার। সত‍্যজিৎ জানাচ্ছেন, “আমি হরিসাধনকে বললাম, দেখুন, এ বাগড়া দিচ্ছে। আমি কিন্তু পারব না, আমি ওসব পরিবর্তনের মধ্যে নেই। হরিসাধন বলল, কেন মশাই, আপনি প্রথম ছবি করছেন, একটু চেঞ্জ-টেঞ্জ করে দিন না। আমি বললাম, না, আমি পারব না। তারপর এই খবর যখন মজুমদারের কাছে পৌঁছল, তখন তিনি আমাকে চিঠি লিখলেন, তোমার কনট্র‍্যাক্ট নাল এন্ড ভয়েড হয়ে গেল, তুমি আমার কথা শোনোনি‌। হরিসাধন বোধহয় তারপর মাস ছয়েক কথা বলেনি আমার সঙ্গে কেননা সঙ্গে সঙ্গে ওর কনট্র‍্যাক্টটাও গেল। তারপরে এই ধরুন বছর চারেক আগে, এই সেদিন আমি সে চিত্রনাট্য খুলে পড়লাম। দেখলাম খুব কাঁচা। ভগবান বাঁচিয়েছেন — যদি ভগবান থাকেন।”

এখানে দেখার বিষয় এই যে সত‍্যজিতের এই আপোষহীন মনোভাবই কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁকে পথের পাঁচালীর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। তাঁকে করে তুলেছিল বেপরোয়া, বিদ্রোহী। তিনি যখন পথের পাঁচালীর কাজ করতে শুরু করলেন, তখন থেকেই আর্থিক সমস্যা ও নানা ধরনের অন্যান্য সমস্যাও তাঁকে ঘিরে ধরেছিল― একথা আমরা সকলেই কম বেশি জানি। প্রায় আড়াই বছর ধরে একটা ছবি তৈরি হয়েছে, এ প্রায় ভাবাই যায় না। কিন্তু এই আড়াই বছর ধরে সত‍্যজিৎ টানটান করে রেখেছিলেন তাঁর ধনুকের ছিলা। হতাশা আসেনি তাঁর? যখন বুঝলেন যে পথের পাঁচালী শেষ করতে পারবেন না, তখন তছনছ হয়ে যায়নি তাঁর ভেতরটা? আজ আমরা তাঁকে নিয়ে কত কিছুই না করছি, কত কিছুই না বলছি, কিন্তু সেদিন তিনি ছিলেন একাকী নক্ষত্রের মতো, এক বিপুল হতাশার মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছিল তাঁকে। তাঁর লড়াইয়ের এই জায়গাটি আমার কাছে খুব প্রাসঙ্গিক।

একটি সাক্ষাৎকারে চিদানন্দ দাশগুপ্ত আমাদের জানাচ্ছেন যে “পথের পাঁচালী করা কালীন একটা সময়ে যখন সত‍্যজিৎ প্রায় চল্লিশ ভাগ কাজ করে ফেলেছে তখন প্রত‍্যেক প্রযোজক, প্রত‍্যেক পরিচালক, প্রত‍্যেক ডিসট্রিবিউটর দেখতে চেয়েছিল যে ও কী করেছে। এবং ওর কাজ দেখার পর তারা উড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, এ আবার কী! এ তো ডকুমেন্টারি। এটা ফিল্ম নয়। . . . একটা সময় ব্যাপারটা খুব খারাপ জায়গায় চলে গেল — ওর বউয়ের গয়না বন্ধক দিয়ে, নিজের লাইফ ইনশিওরেন্স বেচে দেওয়ার পরেও যখন ছবি শেষ করা গেল না, তখন ও ওর ছবির মেটিরিয়াল অন্য পরিচালককে বেচে দিতে চেয়েছিল। তাঁর নাম অর্ধেন্দু মুখার্জি অথবা চ‍্যাটার্জি হবে। সত‍্যজিৎ ফিল্মের ক‍্যানগুলো নিয়ে এই পরিচালকের অফিসে গিয়ে চুপ করে বসে থাকত। অপেক্ষা করত কখন এই মানুষটির ওই ছবি দেখার সময় হবে, যাতে তিনি ওই ছবিটি কিনে নিয়ে তাতে নাচ গান জুড়ে সেটা দিয়ে একটা ফিল্ম তৈরি করতে পারেন। সৌভাগ্যবশত, ওই ভদ্রলোকের সময় হল না ছবিটি দেখার। উনি এত ব্যস্ত ছিলেন যে পথের পাঁচালীর চল্লিশ শতাংশের কাজ উনি দেখতে পারেন নি।”

ঠিক এই জায়গাটার দিকে তাকাই আমরা একবার। হতাশ সত‍্যজিৎ। ভেঙে যাওয়া সত‍্যজিৎ। সর্বস্বান্ত হওয়া সত‍্যজিৎ। নিজের সাধের অসমাপ্ত ছবির ফুটেজ নিয়ে বিক্রি করতে এসেছেন। কোথায় তখন আলোকবিন্দু? কোথায় পুরস্কার? কোথায় স্বীকৃতি? চারপাশ তখন তমসাবৃত। রক্তাক্ত সত‍্যজিৎ। আমরা যাঁরা তাঁর কীর্তি নিয়ে লাফাই, আমরা যারা তাঁর পুরস্কারের তালিকা নিয়ে বড়াই করি, আমরা অনেকসময়ই এই মানুষ সত‍্যজিতের দিকে তাকাই না। কতখানি সহ‍্যশক্তি থাকলে এবং জেদ থাকলে তবে এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন একজন মানুষ! তাই শুধু সিনেমা নয়, সাহিত‍্য নয়, শিল্পকলা নয়, মানুষ সত‍্যজিতের কাছ থেকেও আমাদের জীবনের পাঠ নেওয়া দরকার বলে মনে হয়। তাঁর আলোকমণ্ডিত জয়টুকু দেখলেই চলবে না, সেই জয়ের পেছনে যে অজস্র পরাজয়ের পথ তিনি অতিক্রম করেছেন তার দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে, কারণ সেখানেই রয়েছে তাঁর সারাৎসার।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

3 মন্তব্য

  1. সহজ প্রাঞ্জল ভাষায় তাঁর জীবনের লড়াইটিকে দেখিয়ে দিলেন, কুর্নিশ আপনাকে৷ প্রণাম সত্যজিৎ রায়কে৷

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.