নীলগিরি পর্বতারণ্যে এলিফ্যান্ট করিডর দখল করে গড়ে ওঠা ৩৯টি হোটেল-রিসর্ট সিল করে দেবার আদেশ দেয় আদালত ২০১৮ সালে, যা সিগুর মালভূমি করিডর বলেও পরিচিত। এলিফ্যান্ট করিডর হল সোজা কথায় হাতিদের যাতায়াতের নির্দিষ্ট পথের সীমানা, যে রাস্তা হাতিরাই খুঁজে নিয়েছে বহু সময় ধরে। বর্ষার আগমনের ওপর নির্ভর করে প্রতি বছর খাবার এবং জলের অন্বেষণে হাতির পাল পাড়ি দেয় প্রায় ৩৫০-৫০০ কিলোমিটার পথ। সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একশোরও বেশি এমন করিডর রয়েছে। যার সামান্য কিছু বাদ দিলে বেশিরভাগ পথই হাতিরা ব্যবহার করে প্রতি বছর। যেমন পশ্চিমবঙ্গে ১১টি করিডর রয়েছে। ঝাড়খন্ডের দলমা পাহাড়ের অরণ্য থেকে নেমে হাতির দলের এ রাজ্যে ঢোকার কথা আমরা জানি। একাধারে উদগ্র মুনাফার তাগিদ, মাইলের পর মাইল অরণ্য ধ্বংস করে ওপেন কাট কপার মাইনিং-এর মতো অজস্র খনন, বিস্তৃত হাইওয়ে, হোটেল-রেস্তোরাঁর নরক গুলজার, জঙ্গলে নাইট সাফারি, বৈদ্যুতিন কাঁটাতারের বেড়ায় মুড়ে দেওয়া দখলিকৃত অঞ্চল ক্রমে হাতিদের পরিযায়ী-পথ সংকীর্ণ করছে রোজ, তাদের স্বাধীন যাতায়াতে তৈরি হয়েছে মনুষ্য-সৃষ্ট তুমুল উৎপাত। অন্য দিকে ক্রমশ জঙ্গল কমে আসায় দেখা দিয়েছে বনের পশু-প্রাণের তীব্র খাদ্যাভাব। নানা দিকে আগল গড়ে ওঠায় দিগভ্রষ্ট হয়ে তারা এসে পড়ছে লোকালয় সংলগ্ন জঙ্গলগুলিতে। সেখান থেকে ঢুকে পড়ছে নানাবিধ ফসলের ক্ষেতে, চা বাগান, কফি বাগানে। পশ্চিম মেদিনীপুরের নদী-জঙ্গল ঘেঁষা গ্রামগুলিতে প্রতি বছর বিপুল হারে ফসলের ক্ষতিসাধন গরিব চাষীদের পরিস্থিতি করে তুলেছে উদ্বেগজনক। তৈরি করেছে ‘ম্যান ভার্সাস ওয়াইল্ড’-এর ধারণা, বন্যপ্রাণ এবং অরণ্যনির্ভর মানুষের মুখোমুখি সংঘাত। এই রণদামামার সাক্ষী থেকেছি কিছু ক্ষেত্রে।
হাতির গল্প না হলেও পরিচালক অমিত মাসুরকর তাঁর ছবিতে সংকটকে ধরেন এভাবেই। অরণ্য তাঁর প্রিয় সাবজেক্ট। সে ছত্তিশগড়ের অরণ্যে ভোটপ্রক্রিয়ার বর্ণনা হোক (নিউটন) অথবা মধ্যপ্রদেশের অরণ্য প্রান্তে দিগভ্রষ্ট এক বাঘিনীর এসে পড়া (শেরনি), বন-জঙ্গল এককভাবেই একটি চরিত্র হয়ে ওঠে তাঁর ছবিতে, নিবিড়, নিশ্চুপ এক চরিত্র যার সংলাপ নেই, অন্তরপ্রবাহে আছে তুমুল এক আকুতি। এই সময়ের গল্প-উপন্যাস, অন্যান্য শিল্পমাধ্যম প্রকৃতি-পরিবেশের সংকটকে আর একপাশে সরিয়ে রাখতে পারবে না। প্রকৃতি জগতের কেবল রূপবিন্যাস এখন আর বিষয় হতে পারে না, বিপর্যস্ত নদী-পাহাড়-অরণ্য-বন্যপ্রাণের অস্তিত্ব রক্ষার গল্পই আজকের শিল্পচর্চার দাবি।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
শেরনি ছবির গল্পটি ঠিক এভাবেই অনাড়ম্বর এগোয়। খাবারের খোঁজে একটি ‘টি-১২’ বাঘিনীর লোকালয়ে ঢুকে পড়া তার দুটি শাবক নিয়ে। জঙ্গল-নির্ভর দুঃস্থ কিছু মানুষের বাঘের মুখোমুখি হয়ে প্রাণ যাওয়া ক্রমে একটি জটিল আবর্তের দিকে নিয়ে যায় কাহিনিকে। জাঁতাকলে পড়া বাঘটির নিষ্ক্রমণ হয়ে পড়ে কঠিনতর। এক দিকে হাইওয়ে অপর দিকে তামার খনির মাঝে পড়ে সে দিগভ্রান্তের মত এদিক ওদিক ছুটে চলে তার সন্তানদের নিয়ে।
আমাদের মনে আছে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে পশ্চিম মেদিনীপুরের লালগড়ের অরণ্যে ঢুকে পড়া সেই বিশাল পুরুষ বাঘটির কথা। না জানি কত মাইল পাড়ি দিয়ে পথ হারিয়ে সে এসে পড়েছিল এমন একটি স্থানে যেখানে বিগত একশো বছরে কেউ বাঘ দেখেনি। বনবিভাগের কাছেও এই বাঘ বিস্ময়, কারণ বাঘটির ‘স্ট্রাইপ প্যাটার্ন’ একেবারে অপরিচিত, যার কোনরকম তথ্য তাদের ডেটাবেসে ছিল না। ফলে সেটি ওড়িশা নাকি ছত্তিশগড় অরণ্য থেকে এসেছিল তার কোনও সন্ধান নেই। কয়েক দিন অদ্ভুত দড়ি টানাটানি খেলা, মিডিয়ার টিআরপি, সাধারণ্যের প্রভূত বিনোদন। তারপর অপদার্থ বনবিভাগ এবং জঙ্গলের আদিমনিবাসী মানুষদের শিকার উৎসবের সময় অসচেতন মানুষদের হাতে বাঘটির নির্মম হনন। প্রায় ৫০০ জন ঘিরে ধরে বাঘটিকে মারে অথচ বনবিভাগের কাছে কোনওরকম খবর ছিল না!
কেন সেদিন এ প্রশ্নের কোনও জবাব ছিল না তার কিছুটা উত্তর রেখেছেন অমিত তাঁর এই ছবিতে। যদিও এটি লালগড় নয়, মধ্যপ্রদেশের অরণ্যের গল্প। কিন্তু বনবিভাগের অভ্যন্তরেও যে ঘুঘুদের বাসা, সেই ভেতরকার ছবিও আমরা দেখতে পাই। এ গল্প ডিএফও হয়ে আসা বিদ্যা ভিন্সেন্টেরও (বিদ্যা বালান)। ন বছর কোনও প্রমোশন না পেয়ে চাকরি ছেড়ে দিতে চাওয়া বিদ্যা কীভাবে ক্রমে অরণ্যের আকুতিকে নিজের করে নেয় এ গল্প তারও। এক দিকে যেমন বনবিভাগের দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসার, উদ্ভূত লোকাল পলিটিকসের মিলিত চক্রে বাঘটিকে হত্যার পরিকল্পনা, অন্য দিকে এই অনমনীয় অফিসার বিদ্যা, যিনি জুলজির এক অধ্যাপক হাসান নুরানিকে (বিজয় রাজ) সঙ্গে নিয়ে বাঘটিকে বাঁচানোর অসম লড়াইয়ে সামিল হন। একেক সময় মনে হয় বাঘটির মতই তিনিও পড়েছেন সিস্টেম চালিত এক কিম্ভূত ঘেরাটোপে। এমন এক সংকটের দ্বন্দ্বে কাহিনিকে এনে ফেলতে পারেন অমিত।
ছবি এগিয়েছে ধীর গতিতে। এটি ছবির দুর্বলতা মনে হয়নি বরং ঢিমে লয়ে পরতের পর পরত খোলা এবং আমাদের নিঃসাড়ে এক প্রশ্নচিহ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া সামগ্রিকভাবেই এক দক্ষ পরিকল্পনা। পর্দা জুড়ে অপার সবুজ ধরেছেন অমিত (ক্যামেরায় রাকেশ হরিদাস, সিনেমাটোগ্রাফি এবং সাউন্ড ডিজাইনে অনীশ জন)। গাছেদের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যালোক, জংলি ঝরনার কুলকুল, লক্ষ কীট-পতঙ্গ নিয়ে অরণ্যের নিভৃত ডাক, আমাদের অসাড় মনের দরজায় এসে করাঘাত করে, এদের রক্ষা করো, রক্ষা করো।
তবু কেবল বাঘিনীকে কেন্দ্র করেই কাহিনি সীমায়িত থেকেছে । অরণ্যনির্ভর মানুষদেরও যে ব্যাঘ্রসম বিপন্নতা তা ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে সামান্যই। বন্যপ্রাণের মতোই জল-জঙ্গলের অধিকার যে তাদের কাছ থেকেও ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে বাঘ শিকারের উত্তেজনার আবর্তে, সে গল্প কোথাও পথ ভুল করেছে। গ্রামবাসীদের ভূমিকার মধ্যে জ্যোতি চরিত্রের অভিনয়ে শম্পা মন্ডল অসামান্য।
ছবিটি শেষ করে দীর্ঘক্ষণ কানে বেজেছে অরণ্যের ঝিঁঝিঁ। আর তার মধ্য থেকে উঠে আসা অধ্যাপক নুরানির স্বর —“শের হ্যায় তো জঙ্গল হ্যায়, জঙ্গল হ্যায় তো বারিষ হ্যায়, বারিষ হ্যায় তো পানি হ্যায় অউর পানি হ্যায় তো হাম হ্যাঁয়।’
বাঘ আছে তো অরণ্য আছে, অরণ্য আছে তো আছে বৃষ্টিধারা, তাই আছি আমরা, আমরা।
শেরনি (২০২১) চলচ্চিত্রের পোস্টার ও অন্যান্য দৃশ্য – IMDB ওয়েবসাইট থেকে
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।