গত ১৯মে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ২,০০০ টাকার নোট বাতিল করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। একে অনেকে নোটবন্দী-২ বলে আখ্যায়িত করেছে এবং স্বাভাবিকভাবেই অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, এর ফলে আবার সাধারণ মানুষের হয়রানি হবে কিনা। কারণ ২০১৬ সালের নোটবন্দিতে সেরকমই হয়েছিল। সোজাসুজিই বলা যায়, সেরকম হওয়ার বিশেষ কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ ২০১৬ সালে এক ধাক্কায় দেশের মোট মুদ্রার প্রায় ৮৬% বাতিল করা হয়েছিল, কিন্তু এখন শুধু ২০০০ টাকার নোটই বাতিল করা হয়েছে, যা দেশের মোট মুদ্রার ১১ শতাংশেরও কম। স্বভাবতই একইরকম প্রভাব পড়ার কোনো কারণ নেই। দ্বিতীয়ত ২০১৬ সালে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সমস্ত ৫০০ ও ১,০০০ টাকার নোটের আইনি বৈধতা বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং কিছু নির্দিষ্ট পথে সেগুলো বদল করতে বা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা দিতে বলা হয়েছিল। অবশ্য নির্দিষ্ট কিছু লেনদেনে সেগুলো ব্যবহার করার ছাড় দেওয়া হয়েছিল। এবারে কিন্তু চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০০০ টাকার নোট বৈধ থাকবে, অর্থাৎ সেদিন পর্যন্ত বিভিন্ন লেনদেনে ২,০০০ টাকার নোট ব্যবহারে কোন অসুবিধা নেই।
প্রায় চার বছর আগে থেকেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ২,০০০ টাকার নোট ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছে এবং উচ্চ মূল্যের কিছু নগদ লেনদেন ছাড়া ২,০০০ টাকার নোটের ব্যবহার প্রায় হয় না বললেই চলে। তাই সাধারণ মানুষের খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কোনো কারণই নেই। অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে, ২০১৬ সালে সাধারণ মানুষ খুচরো লেনদেনে খুব বেশি ৫০০ ও ১,০০০ টাকার নোট ব্যবহার করত এমন তো নয়, তবুও তো সমস্যা হয়েছিল। আসলে যারা কিছুটা উচ্চ মূল্যের লেনদেন করত তাদের জন্যেও ৫০০ ও ১,০০০ টাকার নোট উপলব্ধ না হওয়ায়, তারাও ১০০ টাকা বা তার কম মূল্যের নোট ব্যবহার করতে শুরু করেছিল এবং তাদের ক্ষমতা ও যোগাযোগ বেশি থাকায়, সেইসব নোট যতটুকু পাওয়া যাচ্ছিল তার বেশিরভাগটাই তারাই তুলে নিচ্ছিল। এখন সেরকম হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ২০১৬ সালে সাধারণ মানুষের হয়রানি ছাড়াও দেশের অর্থব্যবস্থারও কিছুটা ক্ষতি হয়েছিল। এবারেও কি সেরকম হবে? সেরকম হওয়ার সম্ভাবনাও খুবই কম। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় লেনদেন বা বিনিময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই টাকার অভাবে যদি বিনিময় ব্যবস্থায় সমস্যা তৈরি হয়, তাহলে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ব্যাহত হয় এবং অর্থব্যবস্থার ক্ষতি হয়। ফলে অন্তত স্বল্পমেয়াদে দেশের আয় কিছুটা কমে যাওয়াই স্বাভাবিক। ২০১৬ সালে ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় প্রচলিত মুদ্রার পরিমাণ ছিল দেশের মোট উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১২%। বর্তমানে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩%। বর্তমানে প্রচলিত মুদ্রার প্রায় ১১% (সমস্ত ২,০০০ টাকার নোট) বাতিল হওয়ার পরেও প্রচলিত মুদ্রার পরিমাণ দাঁড়াবে জিডিপির প্রায় ১২%। তাছাড়া ২০১৬ সালে যেখানে ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় সমস্ত লেনদেনের প্রায় ৯০ শতাংশই সংঘটিত হত নগদে, বর্তমানে সেটা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০%। তাই ২,০০০ টাকার নোট বাতিলের ফলে অর্থব্যবস্থায় ধাক্কা লাগার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
এখন আর একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে এবারের ২০০০ টাকার নোট বাতিল করার উদ্দেশ্যটা কী? রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে ব্যাপারটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কোনো কারণ নেই। কয়েক বছর পরেই নোটের গুণগত মান খারাপ হয়ে যায় এবং যেহেতু ২,০০০ টাকার নোটের বয়স চার বছরের বেশি, তাই অপরিচ্ছন্ন নোট বাতিল করাই এর অন্যতম কারণ এবং এরকম আগেও হয়েছে। তাছাড়া রিজার্ভ ব্যাঙ্ক চাইছে কম মূল্যের টাকাই চালু রাখতে। কারণ ২,০০০ টাকার নোট ছাপানো হয়েছিল ২০১৬ সালের নোটবন্দির পরে যথাসম্ভব কম সময় বেশি মূল্যের টাকা বাজারে চালু রাখতে। এখন যেহেতু ৫০০ টাকা ও তার কম মূল্যের অনেক নোট বাজারে চলে এসেছে এবং ২,০০০ টাকার নোটের ব্যবহারিক মূল্য অনেক কম বলে প্রমাণিত হয়েছে, সেহেতু এটা চালু রাখার বিশেষ উপযোগিতা নেই।
আরো পড়ুন ইনডেক্স অস্বীকার করে অপুষ্টি চেপে রাখা যাবে না
কিন্তু শুধুমাত্র এই কারণগুলোর জন্যই তড়িঘড়ি এরকম একটা পদক্ষেপ কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ সমস্ত ২,০০০ টাকার নোট ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠেছে এমন নয়। দু হাজার টাকার নোটের গতি (একটা নির্দিষ্ট সময়ে একটা নোট গড়ে যতটা হাত বদল করে) অন্য নোটের গতির তুলনায় অনেক কম এবং অবশ্যই উচ্চমূল্যের জন্য ব্যবহারকারীরা এই টাকা ব্যবহার বা রাখার ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে।
অনেকেই বলতে শুরু করেছে, এর অন্যতম কারণ হল, এর ফলে বেশ কিছু কালো টাকা ধরা পড়বে এবং অনেক জাল টাকাও বাতিল হয়ে যাবে। কালো টাকা বলার অবশ্য কিছু সমস্যা আছে। বাংলায় টাকা বলতে মুদ্রা এবং অর্থ দুইই বোঝানো হয়। অর্থশাস্ত্রেও অর্থ (money) আর মুদ্রা (currency) এক নয়। তবে প্রকৃতপক্ষে হিন্দিতে ব্যবহৃত ‘কালা ধন’ (কালো সম্পদ) কথাটাই বেশি উপযুক্ত শব্দ। সম্পদ যে শুধুমাত্র টাকার রূপে থাকে তা নয়। অনেকানেক রূপে, যেমন বাড়ি, জমি, মূল্যবান ধাতু বা পাথর ইত্যাদি রূপেও থাকতে পারে। তাই টাকার রূপে থাকা কালো সম্পদ মোট কালো সম্পদের এক ভগ্নাংশ মাত্র।
এই প্রসঙ্গে এটা মনে রাখা দরকার, কালো বা সমান্তরাল অর্থব্যবস্থা বলে যেটা বলা হয়, তার পুরোটাই বেআইনি এমন নয়। অসংগঠিত, এমনকি সংগঠিত ক্ষেত্রের অনেক সংস্থা বা ব্যক্তিও হিসাবের কারচুপি করে সরকারের কর ফাঁকি দেয় এবং কালো সম্পদ অর্জন করে। অথচ এইসব সংস্থার বেশিরভাগ কাজকর্মই আইনত বৈধ এবং এইসব সংস্থার বা কাজকর্মের সাথে যুক্ত বেশিরভাগ মানুষই সৎভাবেই কাজ করে এবং সরকারকে প্রদেয় সমস্তরকম করই দিয়ে থাকে। যেমন আমাদের দেশের কালো সম্পদের একটা বড় অংশই বিদেশে গচ্ছিত। এর অন্যতম পথ হল আমদানিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো এবং রপ্তানিকে কম করে দেখানো। অথচ যে সমস্ত সংস্থা এসব করে, তাদের কর্মীদের মধ্যে দু-চারজন ছাড়া কেউই এসব জানে না। তাই সরকারকে কর ফাঁকি দেয় এরকম কাজকর্ম সব বন্ধ হয়ে গেলে অনেক লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তার ফলে সরকারের করও কমে যেতে পারে।
যা-ই হোক, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে পাওয়া অন্য কিছু তথ্য এই কালো সম্পদের জল্পনাকে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে। এখন পর্যন্ত ৩৭০ কোটি ২,০০০ টাকার নোট ছাপানো হয়েছে, যার মূল্য ৭ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি। এর মধ্যে ১০২ কোটি নোট খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এখন ২৬৮ কোটি নোট অর্থাৎ ৫ লক্ষ ৩৬ হাজার কোটি মূল্যের ২,০০০ টাকার নোট বাজারে চালু থাকার কথা। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এক হিসাব অনুযায়ী এর মধ্যে ৫৪ কোটি নোট, অর্থাৎ এক লক্ষ আট হাজার কোটি মূল্যের ২,০০০ টাকার নোট বাজারে চালু না থেকে কোথাও না কোথাও থিতু হয়ে গেছে। এর থেকে কারো কারো মনে হতে পারে যে এই নোটগুলো কালো সম্পদ হিসাবে কোথাও গচ্ছিত আছে। এর কিছু অংশ সেরকম হলেও পুরো টাকাটাই কালো সম্পদ হিসাবে গচ্ছিত আছে এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই।
২০১৬ সালে বেআইনি ঘোষিত মুদ্রার প্রায় ৯৯.৩ শতাংশই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে ফেরত এসেছিল। যা ফেরত আসেনি তার পুরোটাই যে বেআইনিভাবে অর্জিত সেরকম মনে করার কোনো কারণ নেই। অনেকেই ৫০০ ও ১,০০০ টাকার নোট কোথাও না কোথাও রেখে ভুলে গিয়েছিল। অনেকে সেই টাকা অনেক পরে খুঁজে পেয়েছিল এবং অনেকেই হয়ত সেই টাকা এখনো খুঁজে পায়নি। এছাড়া নেপালে একটা বড় অঙ্কের বেআইনি ঘোষিত টাকা রয়ে গেছে। তাই ২০১৬ সালের নোটবন্দি যে তার প্রধান ঘোষিত উদ্দেশ্য কালো সম্পদ উদ্ধারে বিশেষ সফল হয়নি তা বলাই যায়। এবারের তুলনায় ২০১৬ সালের ব্যবস্থা ছিল অনেক বেশি শক্তপোক্ত, আর তাতেও যদি কালো সম্পদ উদ্ধার হওয়া সম্ভব না হয়ে থাকে, তাহলে এবারের এই পদক্ষেপ যে সে কাজে বিন্দুমাত্র সফল হবে না তা অনায়াসে বলে দেওয়া যায়।
এছাড়াও এর পিছনে দুটো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে বলেও জল্পনা চলছে। এর ফলে বিরোধী দলের হাতে গচ্ছিত সম্পদের একটা বড় অংশই নাকি বেআইনি হয়ে যাবে এবং খরচ করা যাবে না। ২০১৬ সালে বেআইনি ঘোষিত টাকার প্রায় পুরোটাই ফেরত এসেছিল এবং এবারও যদি সেরকম হয়, তাহলে বিরোধী দলের হাতে গচ্ছিত টাকার বেশিরভাগটাই আবার তাদের হাতে ফেরত আসবে এবং তাদের বিশেষ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। হয়ত এর জন্য কিছুটা খরচ হয়ে যাবে। এছাড়াও বলা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে কালো সম্পদ উদ্ধার হোক বা না হোক, কিছু মানুষ বিশ্বাস করে এসব করলে কালো সম্পদ উদ্ধার হয় এবং এর ফলে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি কিছুটা উজ্জ্বল হবে। এটা কতটা সত্যি সেটাও তর্কসাপেক্ষ এবং এই প্রাবন্ধিকের সে ব্যাপারে কিছু বলার মত দক্ষতা নেই। তবে সার্বিক বিচারে মনে হয় ২,০০০ টাকার নোট বাতিলের প্রভাব মানুষ হয়ত বুঝতেই পারবে না, তাই এই নিয়ে ঘুম নষ্ট করারও কোনো কারণ নেই।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।