সৌম্য মণ্ডল
“কেউ যদি বেশি খাও, খাবার হিসেব নাও/কেননা অনেক লোক ভাল করে খায় না” – গেয়েছিলেন কবীর সুমন। সে অনেকদিন আগেকার কথা। অবশ্যই ভাল করে না খাওয়া আজও চলছে। কিন্তু অন্যের বেশি খাওয়ার সঙ্গে কারো না খাওয়ার কোনো সম্পর্ক আজ আর কেউ দেখতে পায় না। একটা সময় ছিল যখন সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতিতে বন্যা, খরা, মারাঠা দস্যু বা অন্য দস্যুদের লুঠপাটের জন্য মানুষ খেতে পেত না। কিন্তু পুঁজিবাদের যুগে সেটা আর সমস্যা নয়। অতিরিক্ত উৎপাদনের মাল গুদামে পচে, তবুও মানুষ খেতে পায় না। কারণ তাদের হাতে গান্ধী ছাপ কাগজগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট প্রকাশিত গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই) শূন্য থেকে ১০০ পর্যন্ত নম্বর দিয়ে থাকে। কম নম্বর মানে ভাল পরিস্থিতি, নম্বর যত বেশি হয় পরিস্থিতি ততই খারাপ বোঝায়। তাদের মাপকাঠিতে ভারতের পরিস্থিতি গভীর বা ‘সিরিয়াস’। ২০২১ সালের তুলনায় ছ ধাপ নিচে নেমে ভারত এখন ওই ইনডেক্সে ১০৭তম স্থানে, ২০২১ সালে ছিল ১০১তম স্থানে। ২০২১ সালে ভারত ২০২০ সালের তুলনায় সাত ধাপ নেমেছিল। ২০২০ সালে ছিল ৯৪তম স্থানে, ২০১৯ সালে ১০২, ২০১৮ সালে ১০৩, ২০০০ সালে ৮৩। দেখা যাচ্ছে ২০০০ সালে ভারতের নম্বর ছিল ৩৮.৮, ২০০৭ সালে ৩৬.৩, ২০১৪ সালে ২৮.২, ২০২২ সালে ২৯.১। ২০২১ সালে ভারতের নম্বর ছিল ২৭.৫। ভারতের থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা গরীব দেশ বলে মনে করা হয় যাদের, সেই নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, আফগানিস্তান লাগাতার গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ভারতের আগেই থেকেছে বা পিছনে থেকে ভারতের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলেছে। যেমন এ বছর ১০৯তম স্থানে রয়েছে মার্কিন ডাকাতিতে বিধ্বস্ত আফগানিস্তান। যদিও প্রত্যেক বছর প্রতিযোগী দেশের সংখ্যার তারতম্য হয়েছে, তবুও নম্বর দেখলে বোঝা যায় অবস্থার খুব বেশি হেরফের হচ্ছে না। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের দেওয়া রেখচিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে ভারতের অবস্থার সামান্য উন্নতি হলেও সামগ্রিকভাবে হতাশাজনকই রয়ে গেছে।
অন্যদিকে ২০০০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভালো নম্বর বজায় রেখে এবছর পাঁচের কম নম্বর তোলা ১৭ দেশের মধ্যে প্রথম নামটা হল বেলারুশ। ওই ১৭ দেশের মধ্যে ১১ হল পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দেশগুলো। এছাড়াও আছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ চীন।
স্বাভাবিকভাবেই ভারত সরকার এই বিশ্রী ফলাফল মানতে নারাজ। যদিও জিএইচআই স্কোর দেখলে বোঝা যাচ্ছে কংগ্রেস, বিজেপি দুই দলের সরকারই খারাপ নম্বরের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। ভারত সরকারের তথ্যের সাথে এই আন্তর্জাতিক নমুনা সমীক্ষার তথ্যের অনেকে অমিল দেখেছেন। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন সমীক্ষার পদ্ধতি নিয়েই। মাপকাঠিকে প্রশ্ন করা যায় ঠিকই, কিন্তু একই মাপকাঠিতে তো বাকি দেশগুলোরও বিচার হয়েছে। তাতে ভারতের থেকে বেশী জনসংখ্যার দেশ চীন বা ছোট দেশ বেলারুশ খুব ভাল ফল করেছে। ফলে এই ব্যর্থতা অস্বীকার করার উপায় নেই, করলে এগোনোও সম্ভব নয়।
জিএইচআই অবস্থান অবশ্যই একথা প্রমাণ করে না যে ভারতের বেশিরভাগ মানুষ খেতে পায় না। কিন্তু যা বোঝায় তাও কম মারাত্মক নয়। যে চারটে মাপকাঠিতে এই ইনডেক্স তৈরি করেছে তা হল পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার, শিশুদের বয়সের তুলনায় ওজন কম হওয়া, উচ্চতার তুলনায় ওজন কম হওয়া এবং বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম হওয়া। প্রত্যেক পরিবারই তার শিশুদের জন্য সাধ্যমত সেরা প্রতিপালনের ব্যবস্থা করে থাকে। সুতরাং এই সমীক্ষা সামগ্রিকভাবে ভারতের জনগণের অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে না বলে শাসক দলের পক্ষ থেকে যে দাবি করা হয়েছে তা কি সম্পূর্ণ ঠিক বলা যায়?
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো মানুষ দিনে ৮০০ ক্যালোরির কম খাবার খেলে ধরা হয় সে প্রয়োজন অনুযায়ী যথেষ্ট খাবার খেতে পারছে না বা সে ক্ষুধার্ত। এটা মূলত নির্ভর করে ধান, গম ইত্যাদি খাদ্যশস্য গ্রহণের উপর। কারণ এই খাদ্যশস্যই কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাটের মূল যোগানদার, যা থেকে শরীর বেশিরভাগ ক্যালরি পেয়ে থাকে। কিন্তু পেট পুরে খেলেই হল না। সুস্থভাবে বাঁচার জন্য চাই প্রয়োজনীয় পুষ্টি। অন্যদিকে অপুষ্টি শুধুমাত্র ক্যালোরির উপর নির্ভর করে না। অপুষ্টি শব্দটা ক্যালোরির সঙ্গে প্রোটিন, আয়রন, ভিটামিন বা বিভিন্ন মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের অভাবকে নির্দেশ করে। সেসবের উৎস মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ডাল, সবজি ইত্যাদি। কেউ পেট ভরে মুড়ি খেলে বা ফাস্ট ফুড খেলে সে ক্ষুধার্ত থাকল না, কিন্তু প্রয়োজনীয় পুষ্টিও পেল না। এতে বিভিন্ন এমন অনেক রোগ হতে পারে যার কারণ অপুষ্টি, বৃদ্ধির সমস্যা হতে পারে। আমাদের দেশের খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী আমরা মূলত কার্বোহাইড্রেট খেয়ে পেট ভরাই, প্রোটিনের পরিমাণ খুব কম থাকে। এই অভ্যাস যদি অপরিবর্তনীয় হয় তাহলে ভারত বা অনুরূপ খাদ্যাভ্যাসের দেশগুলো কখনোই ভাল ফল করতে পারবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল এই খাদ্যাভ্যাসের সংস্কৃতি অর্থনীতির পশ্চাৎপরতা থেকে জন্ম নিয়েছে কি? দেশের অর্থনীতি সবচেয়ে দরিদ্র মানুষটার ক্রয়ক্ষমতায় মাছ, মাংস, ডিম, দুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছে দিতে পারছে কি? নাকি তাকে অপুষ্টি নিয়েই বাঁচতে হচ্ছে?
আরো পড়ুন ‘১৯৯১ থেকে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের পথ ত্যাগ করার ফল গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ১০১তম স্থান’
ভারতে খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় প্রায় ৮০ কোটি মানুষকে রেশনে দু টাকা কিলো চাল দেওয়া হয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ভারতে মাথাপিছু প্রতিদিন ২০১৮-১৯ সালে পাওয়া যেত ৪৮২.২ গ্রাম (চাল ১৮৬.৩ গ্রাম, গম ১৭৮.২ গ্রাম, ডাল ৪২.৬ গ্রাম) খাদ্যশস্য। ২০১৯-২০ সালে পাওয়া যেত ৫০১.৮ গ্রাম (১৯৭.৩ গ্রাম চাল, ১৭৬.৯ গ্রাম গম, ৪৩.৮ গ্রাম ডাল)। ২০২০-২১ সালের তথ্য অনুযায়ী মোট খাদ্যশস্য পাওয়া যেত ৫০৭.৮ গ্রাম (১৯৭ গ্রাম চাল, ১৮৩.৪ গ্রাম গম, ৪৫ গ্রাম ডাল)। সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্রত্যেক বছর দেশে খাদ্যের জোগান বেড়েছে। এদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভ্যাসের তারতম্য আছে। কোনো অঞ্চলের মানুষ শুধু চাল খান, কোনো অঞ্চলের মানুষ শুধু গম, কোনো অঞ্চল আবার দুটোই। লেখকের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী দুবেলা ভাত খেলে একজন বাঙালি গড়ে ২৬০ গ্রাম মত চাল খান সারাদিনে। সুতরাং মাথাপিছু খাদ্যের জোগান প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু সমস্যা হল পর্যাপ্ত খাদ্য সংগ্রহের জন্য গান্ধী ছাপ কাগজগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষের কাছে নেই। হাঙ্গার ইনডেক্সে লাগাতার করুণ নম্বর সেটাই প্রমাণ করে। দেশের মানুষের কর্মহীনতা, কর্মসুরক্ষাহীনতা, কাজের পরিবেশের অবনতি, মুদ্রাস্ফীতি রোধে সরকারি ব্যর্থতার প্রভাব সামগ্রিকভাবে মানুষের খাদ্য গ্রহণের উপর পড়বেই। প্রায় ৮০ কোটি মানুষকে দু টাকা কিলো চাল দেওয়া কি এটাই প্রমাণ করে না, যে এই দেশে অন্তত ৮০ কোটি মানুষের বাজার মূল্য চাল কিনে খাওয়ার ক্ষমতা নেই? মানুষ শুধু চাল খেয়েও বাঁচতে পারে না। ক্রয়ক্ষমতাৎ অভাব কি চাল ছাড়া অন্যান্য খাদ্য গ্রহণের উপর প্রভাব ফেলে না? রেশনে দু টাকা কিলো চাল দেওয়া বা ওই জাতীয় বিভিন্ন প্রকল্প কিছু তাপ্পি মেরে দায় সারতে পারে। কিন্তু সংবেদনশীল জনদরদী রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কখনোই দেশের মানুষের অপুষ্টি আটকানো সম্ভব নয়।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।