কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণের একটি বিবৃতি নিয়ে অনেক মশকরা হয়েছে, বিশেষ করে সোশাল মিডিয়ায়। আমরা জানি, ভারতীয় মুদ্রার দাম অনেক কমে গিয়ে এখন এক ডলার কিনতে ৮৩ টাকার মত লাগছে। তাই আপাতভাবে এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে ভারতীয় মুদ্রা সাম্প্রতিককালে বেশ দুর্বল হয়েছে। আবার মুদ্রার দর নির্ধারণ যেহেতু হয় আপেক্ষিকভাবে এবং বর্তমানে ডলারের মূল্যের নিরিখে, তাই এটাই স্বাভাবিক যে ভারতীয় টাকা দুর্বল হওয়ার অর্থ ডলার শক্তিশালী হওয়া। তাই অর্থমন্ত্রী যখন বললেন ভারতীয় মুদ্রা দুর্বল হয়নি ডলার শক্তিশালী হয়েছে, তখন সকলের মনে হল অর্থমন্ত্রী বোধহয় প্রলাপ বকছেন। কিন্তু বাস্তব হল অর্থমন্ত্রী যা বলেছেন, কিছুটা হলেও তার সত্যতা আছে। কারণ ডলারের নিরিখে শুধু যে ভারতীয় টাকার দাম কমেছে তা নয়, আরও অনেক দেশের মুদ্রারই দাম কমেছে। বস্তুত, প্রায় সমস্ত বড় দেশের মুদ্রার দামই কমেছে। যদি এমন হত যে ডলারের নিরিখে প্রায় সমস্ত দেশের মুদ্রার মূল্য একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আর ভারতীয় মুদ্রার দাম কমে গেছে, তাহলে অর্থমন্ত্রীর এমন বক্তব্য নিয়ে মশকরা করার সঙ্গত কারণ থাকত।

ডলারের নিরিখে গত এক বছরে ভারতীয় টাকার অবনয়ন হয়েছে প্রায় ১০% মত। কিন্তু চীনের ইউয়ানের হয়েছে প্রায় ১৩% এবং ইউরোর প্রায় ১৬%। ইন্দোনেশিয়ার রুপাইয়ার অবনয়ন হয়েছে ভারতীয় মুদ্রার সমতুল্য। সেই হিসাবে দাবি করা যেতেই পারে যে ভারতীয় মুদ্রা অন্য অনেক দেশের মুদ্রার তুলনায় কিছুটা হলেও শক্তিশালী হয়েছে। তবে এটাও ঠিক যে গত এক বছরে ডলারের নিরিখে ভিয়েতনামী ডংয়ের অবনয়ন হয়েছে ভারতীয় মুদ্রার তুলনায় কিছুটা কম। আবার ডলারের নিরিখেই মেক্সিকোর পেসো, ব্রাজিলের রিয়্যাল ও রাশিয়ার রুবলের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে যথাক্রমে প্রায় ৩%, ৫% ও ১৩%। তাই কয়েকটা দেশের তুলনায় অবনয়ন কিছুটা কম হয়েছে বলে ভারতের উল্লসিত হওয়ারও কিছু নেই। তাছাড়া এটাও ঠিক যে ভারতীয় মুদ্রার মান যাতে খুব বেশি নিচে নেমে না যায় তার জন্য ভারত তার বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডার থেকে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে ফেলেছে। নাহলে নিঃসন্দেহে ভারতীয় মুদ্রার মান আরও কিছুটা নেমে যেত।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

তবে ডলারের নিরিখে কোনো দেশের মুদ্রার মানের হ্রাস-বৃদ্ধিকে যদি গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করা হয়, তাহলে শুধু এক বছরে কী হয়েছে টা দেখলে হবে না। গত পাঁচ বছরের হিসাব করলে দেখা যাবে, ডলারের নিরিখে ভারতীয় টাকার অবনয়ন হয়েছে প্রায় ২৭%। এত বেশি অবনয়ন কিন্তু খুব কম মুদ্রারই হয়েছে। একই সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার ওয়ানের অবনয়ন হয়েছে ভারতীয় মুদ্রার সমতুল্য। দক্ষিণ আফ্রিকার রান্ড এবং জাপানের ইয়েনের অবনয়ন হয়েছে কিছুটা বেশি – যথাক্রমে প্রায় ২৯% ও ৩০%। ব্রাজিলের রিয়্যাল ও পাকিস্তানের রুপীর অবনয়ন হয়েছে অনেক বেশি। এছাড়া প্রায় সমস্ত দেশের মুদ্রার অবনয়ন হয়েছে ভারতীয় মুদ্রার তুলনায় অনেক কম। চীনের ইউয়ান ও ভিয়েতনামের ডংয়ের অবনয়ন হয়েছে ৯% মত। ইউরোর অবনয়ন হয়েছে ১৭%। থাই বাট ও ইন্দোনেশিয়ার রুপাইয়ার অবনয়ন হয়েছে ১৪%। মালয়েশিয়ার রিংগিটের অবনয়ন হয়েছে ১১%। মেক্সিকোর পেসো ও রাশিয়ান রুবলের অবনয়ন হয়েছে ৬%-এরও কম। এমনকি বাংলাদেশের টাকার অবনয়নও ভারতীয় টাকার তুলনায় কিছুটা কম।

এখন প্রশ্ন হল, কোনো দেশের মুদ্রার মানের ওঠানামার সাথে কি সেই দেশের অর্থব্যবস্থার ওঠানামার স্পষ্ট এবং সরাসরি সম্পর্ক আছে? সোজা উত্তর হল – না। সাধারণভাবে ধরা হয়, একটা দেশ কতটা রপ্তানি করতে পারছে এবং সেই তুলনায় কতটা আমদানি করছে সেই হিসাবে বিচার করা হবে সেই দেশের অর্থব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী। আবার এও বলা হয়, যে কোনো দেশ আমদানির তুলনায় রপ্তানি বেশি করলে বা বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত হলে সেই দেশের মুদ্রার মান বাড়বে। সেই হিসাবে কোনো দেশের মুদ্রার মান হতে পারে সেই দেশের অর্থব্যবস্থার মাপকাঠি। কিন্তু বাস্তব অনেকটাই আলাদা। গত দুই দশকে চীন কখনোই বাণিজ্য ঘাটতির মুখ দেখেনি। অথচ চীনের মুদ্রারও অবনয়ন হয়েছে। এই সময়ে আমেরিকা সবসময় বাণিজ্যে ঘাটতি বজায় রেখে চলেছে, তবুও প্রায় সব মুদ্রার নিরিখেই ডলারের উত্থান হয়েছে। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না।

আরো পড়ুন ভর্তুকি উন্নয়নের পরিপন্থী: বাজার মৌলবাদীদের কুসংস্কার

আসলে ডলার আন্তর্জাতিক লেনদেনের মুদ্রা হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ায় এবং প্রায় সমস্ত দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে ডলারকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ায় ডলার অস্বাভাবিক গুরুত্ব পায়। অর্থাৎ আমেরিকার অর্থব্যবস্থার শক্তির তুলনায় ডলারের মান অনেকটাই বেশি। তাই এইরকম একটা মুদ্রা যা সবসময় অতিমূল্যায়িত, তার নিরিখে কোনো মুদ্রার মূল্যায়ন এবং তার দ্বারা সেই দেশের অর্থব্যবস্থার মূল্যায়ন করা ঠিক নয়।

তবে এটাও ঠিক যে গত দুই দশকে সবসময়েই ভারতকে বাণিজ্য ঘাটতি দেখতে হয়েছে। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তি থেকে প্রভূত আয় এবং অনাবাসী ভারতীয়দের আয়ের আগমন দিয়েও ভারত তার আন্তর্জাতিক লেনদেনে সমতা আনতে পারেনি, ঘাটতি রয়েই গেছে। সেদিক থেকে দেখলে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা কোনোদিনই শক্তিশালী ছিল না। যদিও এর একটা বড় কারণ, ভারতের অর্থব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতা, যার কোনো সহজ প্রতিবিধান নেই এবং তা মেনে নিয়েই চলতে হবে। ভারতকে প্রতি বছর প্রভূত পরিমাণ খনিজ তেল আমদানি করতে হয়, যার কারণ ভারতের প্রতি প্রকৃতির কার্পণ্য।

এখন একটা প্রশ্ন আসে, যে এত লম্বা সময় ধরে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ঘাটতি নিয়ে ভারত চলতে পারল কী করে? অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দিল না কেন, যেমন হয়েছিল ১৯৯০-৯১ সালে? এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ প্রচুর পরিমাণ বিদেশি পুঁজি ক্রমাগত ভারতে আসতে থেকেছে। এতটাই এসেছে যে ভারতের বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার ফুলেফেঁপে উঠেছে। এমননকি এই বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার এতটা বাড়তে না দিলে হয়ত ভারতীয় মুদ্রার যতটা অবমূল্যায়ন হয়েছে তা হত না। তবে কিছুটা অবমূল্যায়ন হতে দেওয়া হয় এই আশায়, যে এতে বিদেশিদের কাছে দেশের রপ্তানি দ্রব্যের দাম কমবে এবং দেশি গ্রাহকদের কাছে বিদেশি দ্রব্যের দাম বাড়বে। তাতে আমদানি কিছুটা কমবে এবং রপ্তানি কিছুটা বাড়বে। সেটা যে খুব একটা হয়নি তা বলাই যায়। এর কারণও সেই প্রকৃতির কার্পণ্য। তেলের দাম বাড়লেও আমরা তেলের ব্যবহার কমাতে পারি না। আবার তেলের বাড়তি দামের কারণে রপ্তানি দ্রব্যের দামও সেভাবে কমতে পারে না। অবশ্য সামান্য দাম কমা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রপ্তানি বা আমদানি বাড়া কমা করবে সবসময় এমনটা হয় না, কারণ বাস্তব পরিস্থিতি অনেক জটিল।

যা-ই হোক, বর্তমানে ভারতীয় মুদ্রার অবনয়নের মূল কারণ নানাবিধ। দেশের রপ্তানি বৃদ্ধির অপারগতা, তেলের দাম বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি যে বিদেশি পুঁজি দেশিয় পুঁজির বাজারে অনেকদিন ধরে বসে আছে তার একটা অংশের বিদেশে, বিশেষ করে আমেরিকায়, চলে যাওয়া। কারণ আমেরিকা এখন নিজের দেশের মূল্যস্ফীতি কমতে পারে এই আশায় সেখানে সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়াও ইউরোপ বা অন্য অনেক দেশ ইউক্রেন যুদ্ধজনিত সমস্যায় তেলের দাম বাড়ার ফলে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আমেরিকা সেভাবে হয়নি, কারণ আমেরিকার এই ব্যাপারে বিদেশ নির্ভরতা অনেক কম। এই কারণেও অন্যান্য দেশের মুদ্রার মূল্য ডলারের তুলনায় কিছুটা কমেছে।

তাহলে ভবিষ্যতে কি ভারতীয় টাকার দাম আরও কমতে পারে? সেই সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। তবে বিশ্বপুঁজির চরিত্র বোঝা খুব কঠিন। এদের এমন ক্ষমতা যে এরা যে দেশের অর্থব্যবস্থা খুব ভাল নয়, সেখানেও পুঁজির বাজার থেকে ভালরকম কামিয়ে নিতে পারে। তাই এদের আগমন মানেই দেশের অর্থব্যবস্থা খুব ভাল, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। একটা বড় পুঁজির বাজার থাকাটাই এদের জন্য অনেক। তবে এরা আবার কখন কোথা থেকে কেন চলে যায় সেটাও বোঝা খুব মুশকিল। এরা কেউ দয়া করে আসেনি এবং অন্য কোথাও সামান্যতম বেশি লাভের আশা দেখলেই চলে যাবে। সবটাই নির্ভর করে এদের ‘মনে হওয়া’-র উপর। ভারতের পুঁজির বাজার নিয়ন্ত্রণহীন নয়, ফলে একসঙ্গে সমস্ত পুঁজি চলে যাবে এমন নয়। তবে পুঁজির চলে যাওয়ার দীর্ঘস্থায়ী প্রবণতা দেশের জন্য মারাত্মক হতে পারে। তাই যদি দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ঘাটতি চলে এবং বিদেশি পুঁজির আগমন দিয়ে তা পূরণ হয়, যা দেশের ‘মাটির উপর’ না হয়ে পুঁজির বাজারে হয়, তাহলে একটা বড় রকমের ঝুঁকি থেকেই যায়।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

  1. […] কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণের একটি বিবৃতি নিয়ে অনেক মশকরা হয়েছে, বিশেষ করে সোশাল মিডিয়ায়। আমরা জানি, ভারতীয় মুদ্রার দাম অনেক কমে গিয়ে এখন এক ডলার কিনতে ৮৩ টাকার মত লাগছে। তাই আপাতভাবে এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে ভারতীয় মুদ্রা সাম্প্রতিককালে বেশ দুর্বল হয়েছে। আবার মুদ্রার দর নির্ধারণ যেহেতু হয় আপেক্ষিকভাবে এবং বর্তমানে ডলারের মূল্যের নিরিখে, তাই এটাই স্বাভাবিক যে ভারতীয় টাকা দুর্বল হওয়ার অর্থ ডলার শক্তিশালী হওয়া। তাই অর্থমন্ত্রী যখন বললেন ভারতীয় মুদ্রা দুর্বল হয়নি ডলার শক্তিশালী হয়েছে, তখন সকলের মনে হল অর্থমন্ত্রী বোধহয় প্রলাপ বকছেন। কিন্তু বাস্তব হল অর্থমন্ত্রী যা বলেছেন, কিছুটা হলেও তার সত্যতা আছে। কারণ ডলারের নিরিখে শুধু যে ভারতীয় টাকার দাম কমেছে তা নয়, আরও অনেক দেশের মুদ্রারই দাম কমেছে। বস্তুত, প্রায় সমস্ত বড় দেশের মুদ্রার দামই কমেছে। যদি এমন হত যে ডলারের নিরিখে প্রায় সমস্ত দেশের মুদ্রার মূল্য একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আর ভারতীয় মুদ্রার দাম কমে গেছে, তাহলে অর্থমন্ত্রীর এমন বক্তব্য নিয়ে মশকরা করার সঙ্গত কারণ থাকত।Read More […]

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.