সায়ক ঘোষ চৌধুরী

সদ্য আয়োজিত হল বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট (BGBS) ২০২২। রাজারহাট-নিউটাউনের ৩,২০০ আসন বিশিষ্ট বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারে ২০-২১ এপ্রিল হল এই সম্মেলন। করোনার জন্যে দুবছর বন্ধ থাকার পর আবার এই শিল্প সম্মেলনের আয়োজন করা হল। মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল সরকার পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই নিয়ে এটি ষষ্ঠ সম্মেলন। দুদিনের সম্মেলনের শেষে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, ষষ্ঠ শিল্প সম্মেলন থেকে লগ্নির সমঝোতাপত্র সই হয়েছে মোট ১৩৭টি। মোট প্রস্তাবিত বিনিয়োগ ৩,৪২,৩৭৫ কোটি টাকা, সম্ভাব্য কর্মসংস্থান ৪০ লক্ষ। প্রস্তাবগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

(ক) আদানি শিল্পগোষ্ঠীর কলকাতা বন্দরের জন্যে ১০,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার প্রস্তাব

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

(খ) ফ্লিপকার্ট লজিস্টিক সংস্থার ওয়্যারহাউস, যেখানে প্রায় ১১,০০০ মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে

(গ) স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ৩,৭৩০ কোটি টাকা, হাওড়া শিল্পতালুকে ৫০০ কোটি টাকা, উত্তর ২৪ পরগণা শিল্পতালুকে ৭০০ কোটি টাকা, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে ১০০ কোটি টাকা (যেখানে ১,৩০০ কর্মীর কর্মসংস্থান হওয়ার সম্ভাবনা), মুর্শিদাবাদে ২,৫০০-৩,০০০ কোটি টাকায় ১৫০০ বিদ্যুৎচালিত বাস।

এখন প্রথম কথা হল, পশ্চিমবঙ্গে যে ধরনের বিনিয়োগই আসুক, তাকে স্বাগত জানাতেই হবে। পুঁজি বিনিয়োগ হলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হবেই। কিন্তু এরপর কিছু প্রশ্নও থেকে যায় এই ধরনের শিল্প সম্মেলন বা ‘ইনভেস্টরস মিট’ নিয়ে এবং প্রস্তাবিত বিনিয়োগ আর প্রকৃত বিনিয়োগের হিসাব নিয়ে।

ভারতে এই ধরনের রাজ্যওয়াড়ি শিল্প সম্মেলন জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ২০০৩ সালে তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী এবং বর্তমানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদীর ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাট’ আয়োজিত হওয়ার পর থেকে। যদিও তার আগে বিভিন্ন রাজ্যে শিল্প সম্মেলন হত, পশ্চিমবঙ্গেও বাম আমলে হয়েছে। কিন্তু সেটিকে বাৎসরিক উৎসবে পরিণত করে সম্ভাব্য লগ্নির হিসাব দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া অন্য অনেক উদ্ভাবনীমূলক প্রচারের মতই মোদীর আবিষ্কার। বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতেই এই ধরনের শিল্প সম্মেলনের জনপ্রিয়তা বেশি। কংগ্রেসশাসিত রাজ্যগুলি এই ধরনের বার্ষিক ‘ভরসাপূর্তি’ উৎসবের দিকে যায় না। কিন্তু এই ধরনের শিল্প সম্মেলন উদযাপন এবং প্রকৃত বিনিয়োগের মধ্যে বিরাট ফারাক আছে।

ভাইব্র্যান্ট গুজরাট দিয়েই নরেন্দ্র মোদী তাঁর শিল্পবান্ধব ভাবমূর্তি তৈরি করেছিলেন। ২০১৯ সালে করোনার আগে পর্যন্ত তার নটি সংস্করণে মোট ১.১ লক্ষ মৌ (প্রস্তাবিত বিনিয়োগ) স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে গুজরাট সরকার দাবি করেছিল, যার ৭০% নাকি প্রকল্প রূপায়ণের স্তরে আছে। কিন্তু দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস একটি প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, ২০০৩ থেকে বিকল্প শক্তির ক্ষেত্রে যে ৫.৪৮ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছিল, তার মাত্র ৭.৩৫% এসেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা ছিল ১.৯২ লক্ষ, হয়েছে ১২,৩৪৩। মাত্র একটি উদাহরণ দিলাম, বাকি প্রস্তাবগুলির অবস্থাও তথৈবচ। প্রস্তাবিত বিনিয়োগ মানেই যে প্রকৃত বিনিয়োগ নয়, এ থেকেই পরিষ্কার।

যেসব রাজ্য এমন বাৎসরিক বা দ্বি-বাৎসরিক শিল্প সম্মেলন ডাকে না, যেমন মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, দিল্লি; সেই সব রাজ্যে বিনিয়োগের ইতিহাস গুজরাটের চেয়ে ভাল। ২০১১ সালে প্রস্তাবিত এইচসিসির ৪০,০০০ কোটি টাকার ঢোলেরা স্মার্ট সিটি বা ২০০৯ সালে প্রস্তাবিত নন্দীগ্রাম খ্যাত প্রসূন মুখার্জির ইউনিভার্সাল সাকসেসের ৮০,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব গুজরাটে রূপায়িত হয়নি। বিদেশি বিনিয়োগ টানার ব্যাপারেও ভাইব্র্যান্ট গুজরাট বহু যোজন পিছিয়ে শিল্প সম্মেলন না করা মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক এবং দিল্লির চেয়ে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর ২০২১-২২ কর্ণাটকে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ১,০২,৮৬৬ কোটি টাকা, মহারাষ্ট্রে ৪৮,৬৩৩ কোটি টাকা, দিল্লি-এনসিআরে ৩৭,৪০২ কোটি টাকা। আর গুজরাটে? মাত্র ১১,১৪৫ কোটি টাকা।

কাজেই শিল্প সম্মেলন করা রাজ্যে প্রস্তাবিত বিনিয়োগ এবং প্রকৃত বিনিয়োগ, প্রস্তাবিত কর্মসংস্থান এবং প্রকৃত কর্মসংস্থানের মধ্যে পার্থক্য চোখে পড়ার মত।

পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা কী?

এখানে ২০১৯ পর্যন্ত পাঁচটি শিল্প সম্মেলনে বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে ১২,৩৫,৫৭৮ কোটি টাকা। শেষ চারটি শিল্প সম্মেলনে লগ্নির প্রস্তাবের হিসাব এইরকম:

২০১৯ – ২,৮৪,২৮৮.৩৩ কোটি টাকা

২০১৭ – ২,৩৫,২৯০.০৩ কোটি টাকা

২০১৬ – ২, ৫০, ২৫৩.৭৪ কোটি টাকা

২০১৫ – ২,৪৩,১০০ কোটি টাকা

যদি কেউ বিনিয়োগ প্রস্তাবের গভীরে যান, তাহলে দেখতে পাবেন প্রায় একই ধরনের সংস্থা প্রতিবার একই ধরনের প্রস্তাব দেয়, যার ৯০ শতাংশই শিল্প সম্মেলন না করেও দেওয়া যেত। উদাহরণ, মেডিকা হাসপাতাল ৩০০ শয্যা বাড়াবে – এটি বলার জন্যে শিল্প সম্মেলন করার দরকার পড়ে না। একে বিনিয়োগ হিসাবে দেখানো চলে কি?

পশ্চিমবঙ্গের মোট অর্থনীতি ২০২১-২২ আর্থিক বর্ষে ছিল ১৫.৩৬ লক্ষ কোটি টাকার মত। যদি আগের পাঁচটি শিল্প সম্মেলনের প্রস্তাবিত বিনিয়োগ পশ্চিমবঙ্গে হত (১২.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা) এবং প্রস্তাবিত কর্মসংস্থান (দু কোটি) হত, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের এই দৈন্য দশা হত? মুখ্যমন্ত্রীকে কোষাগারের হাল নিয়ে প্রতিদিন এত আক্ষেপ করতে হত?

উপরে দেওয়া হিসাবের মধ্যে নির্মল হাস্যরসের জায়গাও রয়েছে। দেখা যাবে, ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে লগ্নির প্রস্তাব আগের কয়েকবারের তুলনায় হঠাৎ করে কমে গেছিল। কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছিল, মোদীর সরকারের সঙ্গে মমতার সরকারের ঝগড়া। শিল্পপতিদের অনেকে কলকাতায় আসেননি। এর অর্থ কী? বর্তমানে কি মোদী-মমতার সখ্য চলছে? তাই কি রাজ্যপাল জগদীশ ধনকরকে পাশে বসাচ্ছেন মমতা? যে রাজ্যে বিনিয়োগের অঙ্ক বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য লাগে এবং বিনিয়োগের বিরাট অংশ জুড়ে থাকেন বিতর্কিত গৌতম আদানি, সেখানকার শিল্প সম্মেলন নিয়ে কি খুব বেশি আশা করা উচিত ?

এমনিতে পরিসংখ্যানে অনেককিছু ঢাকা পড়ে যায়, কিন্তু আবার অনেককিছু প্রকাশও পায়। পশ্চিমবঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগ কত, তা দেখে ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পের অবস্থান বোঝা যাবে। কারণ বিদেশি বিনিয়োগ দেশি বিনিয়োগ না থাকলে আসে না।

ভারত সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে (আর্থিক বর্ষ নয়) ভারতে ৩.৭৫ লক্ষ কোটি টাকার মত বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। তার মধ্যে ২৫০০ কোটি টাকা এসেছে পশ্চিমবঙ্গে। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে কেরল (২২০০ কোটি টাকা) আর রাজস্থানের (৪৫২০ কোটি টাকা) মাঝামাঝি। প্রথম স্থানে কর্ণাটক (১.৩৫ লক্ষ কোটি), দ্বিতীয় মহারাষ্ট্র (প্রায় ৯০,০০০ কোটি)। গুজরাট আছে তালিকার মাঝামাঝি (২০,০০০ কোটি), হরিয়ানার ঠিক উপরে (১৮,৮০০ কোটি)।

এবার বোঝা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের প্রকৃত বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের অবস্থা কেমন?

কিন্তু যদি প্রস্তাবিত এবং প্রকৃত বিনিয়োগের মধ্যে এত তফাত থাকে, তাহলে বছর বছর এত টাকা খরচ করে শিল্প সম্মেলন করার কী দরকার?

আসলে মমতা ব্যানার্জির শিল্প বিরোধী ভাবমূর্তি বদলানোর জন্যই এত আয়োজন। টাটাকে সিঙ্গুর থেকে তাড়ানোর পর হাজার চেষ্টাতেও সেই ভাবমূর্তি বদলায়নি। দেশি এবং বিদেশি – দুই ধরনের বিনিয়োগ আনতেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার ব্যর্থ। নির্ভর করতে হচ্ছে মুকেশ আম্বানি, আদানি এবং মোদী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার উপর।

আদানির দেওয়া প্রস্তাবটি একটু তলিয়ে দেখা যাক। তিনি নাকি কলকাতা বন্দরে বিনিয়োগ করবেন। বন্দর তো কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন। ওখানে বিনিয়োগ মানে কি জলের দরে কলকাতা বন্দর কিনে নেওয়া? মুর্শিদাবাদে বাস নামানোই বা কী ধরনের বিনিয়োগ? যাঁরা বাসগুলি কিনবেন তাঁরা কি টাকা দেবেন না?

এই ধরনের নিপাতনে সিদ্ধ প্রস্তাব অনেক। এগুলি পশ্চিমবঙ্গের যে জ্বলন্ত সমস্যা – কর্মসংস্থানের অভাব, তার সমাধানে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারবে না। মমতা তাঁর তৃণমূলী সমাজের কাছে কিছু সুখানুভূতি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেন শিল্প হচ্ছে ভান করে। আদতে এই শিল্প সম্মেলন পশ্চিমবঙ্গের বাকি সব সরকারি অনুষ্ঠানের মতই একটি একাঙ্ক নাটক।

সে নাটকের একটিই চরিত্র – মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। বাকিদের খুব একটা অভিনয়ের জায়গা নেই।

মতামত ব্যক্তিগত

রুগ্ন জুটমিল: চাই শ্রমিক, কৃষকের যৌথ লড়াই

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.