মানবাধিকারের মত গোলমেলে সংজ্ঞা বিরল। মানবাধিকার শব্দটি নিছক মানবিক নয়, তার থেকে অনেক বেশি রাজনৈতিক। কারণ মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের চেয়ে বড় রাজনৈতিক বিষয় আর কিচ্ছুটি নেই। মানবজাতির এ যাবৎ ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাবহ বিষয় এটিই যে, সভ্যতার বহু স্তর জয় করেও তাকে নিজের অধিকার অর্জনের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে, তাও আবার অপর মানুষের বিরুদ্ধে। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ভিনগ্রহে বসতি খোঁজার অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সাফল্য অর্জন করেছে মানুষ। কিন্তু এই গ্রহের সিংহভাগ মানুষকে এখনও যৎসামান্য অধিকারটুকুর জন্যে লড়তে হচ্ছে, হারতে হচ্ছে, অপমানিত হতে হচ্ছে এবং মরে যেতে হচ্ছে। একুশ শতকে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ সহজতম। কত সহজেই অন্য মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে সোশাল মিডিয়ায়। তবু এই শতকেই নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হাঁফিয়ে মরছে মানুষ, জাতীয়তাবাদের উগ্রতায় বিচ্ছেদের শোকে পাথর হয়ে যাচ্ছে। আপাতত এমন এক সময়, যখন ব্যক্তির মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নজরদারি তুঙ্গে। বহু শতাব্দী আগে যারা বর্ণ-তকমায় মানুষের স্তরভেদ করে দিয়েছিল, তারাই এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে; তারাই ঠিক করে দিচ্ছে কোন বর্ণের মানুষের কতটা অধিকার। এখনো এমন সময় যখন নিপীড়িত শব্দটি প্রবলভাবে টিকে আছে এবং উপমহাদেশে রাষ্ট্রীয় তৎপরতায় মানুষের হারিয়ে যাওয়া হেমন্তের পাতা ঝরার মতই সহজ স্বাভাবিক। যন্ত্রসভ্যতার অত্যাধুনিক পর্যায়ে নিজেদের স্থানাঙ্ক খুঁজে পেতে পেতে জেনে নিতে হচ্ছে ভিন ধর্মে/ভিন জাতে বিয়ে করার জন্য খুন হয়ে যাচ্ছে কত মানুষ। সমলিঙ্গের মানুষের বিয়ে করা নিয়ে এখনো কুঁচকে যাচ্ছে অনেকের ভুরু। অথচ, এই সবকটি বিষয়ই মানবাধিকারের স্বাভাবিক শর্তে অন্তর্ভুক্ত। মানবাধিকার – একটি আশ্চর্য শব্দ। যা অভিধানে রয়েছে, যা সংবিধানে রয়েছে, যার দিবস-মাপা উদযাপন রয়েছে, যার জন্যে বহু ‘আর্টিকল’ সাজিয়ে রেখেছে বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা, অথচ সেই শব্দটি অনেক উঁচুতে কাটা ঘুড়ির মতো উড়তে থাকে, তাকে ছোঁয়া যায় না। তার বাস্তবিক অভিঘাতে রাষ্ট্র অসুখে পড়ে বারবার। মানবাধিকার – এমন একটি রাজনৈতিক শব্দকে ঘিরে বিতর্ক স্বাভাবিক।
#
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
“All human beings are born free and equal in dignity and rights. They are endowed with reason and conscience and should act towards one another in a spirit of brotherhood… Everyone is entitled to all the rights and freedoms set forth in this Declaration, without distinction of any kind, such as race, colour, sex, language, religion, political or other opinion, national or social origin, property, birth or other status.”
ভারতীয় সমাজে পৌঁছে এই বাক্যগুলি বহুমাত্রিক গভীরতা পায়। প্রত্যেকদিন সংবাদমাধ্যমে ভেসে ওঠে বর্ণ আর ধর্মগত বিভেদের খবর। দলিত ছাত্রকে বাধ্য করা হচ্ছে প্রস্রাবাগার পরিষ্কার করতে, দলিত বালককে তার জন্মগত পরিচয়ের জন্য পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, দলিত নারী ধর্ষিতা হওয়ার পরে উঁচু জাতের লোকেদের রক্ষা করতে উঁচু জাতের মিছিল হচ্ছে। পরধর্মদ্বেষী সংখ্যাগুরু অনায়াসে নাগরিকদের ভোটে জিতে যায়। সংখ্যাগুরুর ধর্মের পুরুষ সংখ্যালঘু নারীকে ধর্ষণ করার পরে তাকে ‘সংস্কারী’ বলে নৈতিক শংসাপত্র প্রদান করেন জনপ্রতিনিধি। গণহত্যা যারা সংগঠিত করেছিল, তারা সোল্লাসে দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে নেয়। লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য সামাজিক পরিসর ছেয়ে রয়েছে। ক্রিকেটের মত বহুল প্রচারিত এবং জনতোষী খেলাতেও লিঙ্গবৈষম্যের ছায়া মোছেনি পুরোপুরি। বহু বছর পুরুষ ক্রিকেটারদের সমান আর্থিক বন্দোবস্ত পেতে লড়াই করলেন মহিলা ক্রিকেটাররা। অন্যান্য আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে, বিশেষত দৈনিক শ্রমভিত্তিক রোজগারের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য এখনো সাংঘাতিক। লিঙ্গভিত্তিক শোষণের শুধুমাত্র সরকারি নথিবদ্ধ পরিসংখ্যান মানবাধিকারের শর্তাবলীকে লজ্জায় ফেলে দিতে পারে।
মানবাধিকারের আরেক অলঙ্ঘ্য শর্ত নাগরিকত্বের অধিকার। বিগত তিন বছরে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সবথেকে আলোচ্য বিষয় নাগরিকত্ব আইন এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কোটি কোটি মানুষের অনিশ্চয় ভবিষ্যতের প্রশ্ন। সরকারি উদ্যোগে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, ডিটেনশন ক্যাম্পও। উদ্বিগ্ন যাপনে প্রতিমুহূর্তে অবমানবিক পরিবেশে বেঁচে থাকা মানবাধিকার ক্ষয় করতে থাকে।
আরো পড়ুন মাওবাদী দমনের নামে মধ্য ভারতে ঠিক কী চলছে? অতি সাম্প্রতিক ঘটনার প্রিজমে
মানবাধিকার সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হয় দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিনিধিদের দ্বারা। রাষ্ট্র প্রদত্ত ক্ষমতাবলে অদ্ভুত নিপীড়কসুখ অনুভব করেন তাঁরা। লোকসভায় সরকার প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭-২০ সালে ৩৪৮ জন মারা গেছেন পুলিশ হেফাজতে। ২০১৭-১৯ সালের মধ্যে ১,১৮৯ জনকে হেফাজতে নির্যাতন করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। ২০২০ সালে সারা দেশে ২৩৬ জনকে পুলিসি হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। ২০১৯ সালে পুলিস হেফাজতে ১২৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা তথ্যভুক্ত করে জাতীয় নির্যাতনবিরোধী প্রচারাভিযান। এই সংস্থা প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী ২০১৯ সালে পুলিস লক আপে মৃত ১২৫ জনের মধ্যে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছে অত্যাচারের ফলে। বিগত বছরগুলোতে পুলিস হেফাজতে যাঁরা মারা গেছিলেন তাঁদের ৬০% আদিবাসী, দলিত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। কয়েকটা নাম পড়া যাক – নাগাম্ফো, লাংলুন, হকুপ, খানওয়াং, ইনজুং, সোমওয়াং, পেপন… মানবাধিকারের বিপন্নতায় এই নামগুলি অবশ্য উল্লেখ্য। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সেনাবাহিনী এঁদের গুলি করে হত্যা করে নাগাল্যান্ডের ওটিং গ্রামে। এঁরা প্রত্যেকেই খনি-শ্রমিক, সন্ধ্যায় কাজ শেষে ঘরে ফিরছিলেন। বিনা প্ররোচনায় কী অনায়াসে তাঁদের উপরে গুলি চালাল সেনাবাহিনী। আফস্পা (আর্মড ফোর্সেজ স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট) প্রযুক্ত ভূখণ্ডে ঘাড় নিচু করে বেঁচে থাকা সেখানকার মানুষের রোজকার যাপন – যখন তখন গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়া কিংবা গুলি খেয়ে মরে যাওয়া তাঁদের অধিকার রক্ষার পথে আরও কাঁটা বিছিয়ে দেয়।
#
“Everyone has the right to education. Education shall be free, at least in the elementary and fundamental stages. Elementary education shall be compulsory.”
শিক্ষা সকলের জন্য। শিক্ষা পণ্য নয়। শিক্ষা সুবিধাপ্রাপ্ত উচ্চবর্গের কুক্ষিগত ধন নয়। অথচ মানবাধিকারের এই ন্যূনতম শর্তটুকু পালন করতে রাষ্ট্রের বহু দ্বিধা। সরকারি মুঠো বন্ধ হয়ে আসে শিক্ষাখাতে ব্যয় করতে। শিক্ষাকাঠামোকে বিষিয়ে দিতে হাজারো দুর্নীতি। শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানবাধিকার। জাতীয় সুমারির তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩২ মিলিয়ন ভারতীয় বালক-বালিকা (১৩ বছর বয়স পর্যন্ত) কোনো ইস্কুলে যায়নি। ইস্কুলের পড়া শেষ করতে না পারা শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রতি ১০০ জনে ২৯ জন। অতিমারীর সময়ে সারা দেশের শিক্ষার্থীকুলের মাত্র ২০% শিক্ষার অধিকার পেয়েছিল। উচ্চ সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষা খরিদ করতে পারেনি বলে থেমে গেছে অনেকের পড়াশোনা। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বে ২৪৪ মিলিয়ন শিশু ও বালক বালিকা (৬-১৭ বছর বয়সী) ইস্কুলের মুখ দেখেনি। এগুলো সবই সরকারি পরিসংখ্যান। এর বাইরের বাস্তবতা আরও বেদনাদায়ক। রাষ্ট্র বহু মানুষের ন্যূনতম অধিকার সহজেই কেড়ে নিতে পারে, কারণ তাঁরা অনেকেই সেই অধিকারের ‘অ’-টুকু জানেন না; তাঁদের কখনো জানতে দেওয়া হয়নি। তাঁদের শিক্ষার সমস্ত ধাপ থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে ওই ‘অ’-টুকু কেড়ে নেওয়ার জন্য।
মানবাধিকার ভাঙা আর সময় বিশেষে মানবাধিকারের শুকনো পাঁউরুটি ছুঁড়ে দিয়ে জনগণকে ঠান্ডা রাখা রাষ্ট্রের প্রিয় একটি খেলা। এই খেলা খেলতে খেলতে রাষ্ট্র কত যুগ পার করে দিয়েছে। মানবাধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করতে গিয়ে জেলবন্দি হতে হয়। জেলবন্দি মানবাধিকার কর্মীর পারকিনসন্স রোগ আছে জেনেও তাঁকে সিপার দিতে চায় না কর্তৃপক্ষ, মানবাধিকার কর্মীর শরীরের ৮৫% প্রতিবন্ধকতাযুক্ত জেনেও ন্যূনতম সুবিধা দিতে চায় না কর্তৃপক্ষ, জেলবন্দি কোনো মানবাধিকার কর্মীর চশমা ভেঙে গেলে নতুন চশমা দিতে টালবাহানায় মাসাধিককাল অতিক্রান্ত হয়। তাঁদের ফের এইসব সামান্যতম অধিকার আদায়ের জন্য মানবাধিকারের শরণাপন্ন হতে হয়। তাঁরা মানবাধিকারের পাঠ দেন রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে। কিন্তু রাষ্ট্রের ওই প্রিয় খেলাটি চলতেই থাকে – প্রতি মুহূর্তে মানবাধিকার কেড়ে নিয়ে নাগরিককে বাধ্য করো নতজানু হতে। মানবাধিকারের শর্তগুলো পূরণ কোরো না, তাহলে নাগরিক বাধ্য হবে মানবাধিকারের জন্য হাত জোড় করে মাথা নিচু করতে। তারপর অবরেশবরে কিছু অধিকার ‘পাইয়ে দিয়ে’ রাষ্ট্র মহান সাজবে, সর্বশক্তিমান সাজবে। রাষ্ট্র সবসময় মনে করিয়ে দেবে মানুষ হয়ে টিকে থাকার যন্ত্রণার কথা, স্বাধীন না হয়ে রাষ্ট্রমুখাপেক্ষী হয়ে বেঁচে থাকার কথা এবং রাষ্ট্রের বানানো যাবতীয় মোড়লী নিয়ম চোখ না তুলে মেনে নেওয়ার কথা।
মানবাধিকারের প্রথম পাঠ স্বাধীনতা। মুক্ত চিন্তা। রাষ্ট্রের খবরদারি না মানার অবাধ্যতা। রাষ্ট্রের প্রতিটি মোড়লী নিয়মকে প্রশ্ন করার সাহস রাখা। মানবাধিকার একটি সাংঘাতিক অভিঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক শব্দ। সেই রাজনীতিকে ৩৬৫ দিন ধারণ করা ও তাকে রক্ষার জন্য সচেতন থাকা মানবাধিকারের প্রথম ও আবশ্যিক শর্ত। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ নোবেল প্রাপ্তির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইউরোপিয় পণ্ডিতদের এবং বাকি বিশ্বকে তেমনই কিছু কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। বেঁচে থাকা মানুষের শ্রেষ্ঠ অধিকার – অন্যকে বাঁচতে সাহায্য করা কিংবা অন্যের বাঁচাকে সুন্দর করে তোলা তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। বাঁচার প্রতিটি মুহূর্তকে সুন্দর করে তোলার চেষ্টার জন্যেই শেষপর্যন্ত মানব থেকে যায় –
“A new and sweeping utopia of life, where no one will be able to decide for others how they die, where love will prove true and happiness be possible, and where the races condemned to one hundred years of solitude will have, at last and forever, a second opportunity on earth.”
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।