সুমিত সেনগুপ্ত
নারায়ণ দেবনাথকে ছোটবেলা থেকেই চিনি তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে — হাঁদা ভোঁদা, নন্টে আর ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেটের মাধ্যমে। সেই থেকে তাঁকে প্রায় পুজো করি। কিন্তু তাঁর সাথে ব্যক্তিগত আলাপ হয় ২০১৪ সাল নাগাদ, আমার বন্ধু শান্তনুর উদ্যোগে। দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম, অত জনপ্রিয় একজন শিল্পী কত নিরহঙ্কার। শান্তনু ঠিক করেছিল তাঁর সমস্ত কাজ যাতে বই হিসাবে পাওয়া যায় তার ব্যবস্থা করব। কোনো বাণিজ্যিক স্বার্থে নয়, একেবারেই নারায়ণবাবুর প্রতি শ্রদ্ধাবশত ও এই সংকল্প নিয়েছিল। আমাদের সৌভাগ্য, তাঁর জীবদ্দশায় শুধু যে অনেকগুলো বই করে কচিকাঁচাদের হাতে পৌঁছে দেওয়া গেছে তা-ই নয়, তাঁর কমিক্সসমগ্রও প্রকাশিত হয়েছে (লালমাটি প্রকাশন)। শান্তনু দুরু দুরু বক্ষে কমিক্সসমগ্র করার কাজে হাতে দিয়েছিল। ভয় ছিল, অত মোটা মোটা খণ্ডের বই, বিক্রি না হলে কী হবে? কিন্তু নারায়ণ দেবনাথের এমন জনপ্রিয়তা যে এই যুগেও সে বই রমরমিয়ে বিক্রি হয়েছে।
তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি কেবল তুলি হাতে নিয়ে নিজের কাজটুকু মন দিয়ে করে গেছেন। একেবারেই প্রচারবিমুখ, কে কী বলল না বলল সেদিক কোনো মন ছিল না। আর ভক্তদের, বিশেষ করে ছোটদের, অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। তাঁর বাড়িতে গেলে প্রত্যেকের সাথে গুরুত্ব দিয়ে কথা বলতেন। যদি ভেবে দেখি, নারায়ণ দেবনাথের সবচেয়ে বড় অবদান হল কমিক্সে বাঙালিয়ানা নিয়ে আসা। তাঁর আগে পর্যন্ত আমাদের এখানে কমিক্স বলতে ছিল ইন্দ্রজাল কমিক্স, মানে ফ্যান্টমের বাংলা অনুবাদ অরণ্যদেব বা ম্যানড্রেকের মত চরিত্র। টিনটিন, অ্যাসটেরিক্স যা-ই বলুন, সবই বিদেশি কমিক্সের অনুবাদ। অন্যান্য কমিক্সেও থাকতে বিদেশি কমিক্সগুলোর ছায়া। ওঁর গল্প, চরিত্র চিত্রণ কিন্তু খাঁটি বাঙালি। হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে, কেল্টুদা, খাঁদু, পিসেমশাই — এরা সবাই আমাদের আশপাশে ছড়িয়ে থাকা চরিত্র। তাদের কীর্তিকলাপও সব বাংলার জল মাটিতে, দুষ্টুমিগুলোও নিতান্ত বাঙালি দুষ্টুমি। আমাদের সময়ে বাঙালি ছেলেদের জীবনযাত্রা যেমন ছিল তারই প্রতিফলন পাওয়া যায় নারায়ণবাবুর কমিক্সে। চরিত্রগুলোর বেশভূষা লক্ষ্য করলে দেখা যায় নন্টে-ফন্টে, হাঁদা-ভোঁদাদের পায়ে থাকে চটি, জুতো নয়। বাঁটুল সর্বদা খালি পায়ে থাকে। ষাট, সত্তর বা আশির দশকে সাধারণ বাঙালি বাড়ির ছেলেরা ওভাবেই থাকত।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
আসলে মানুষটা ছিলেন একেবারে শিশুর মত। নব্বই পেরোবার পরেও কাটলেট, ফিশ ফ্রাই বা পরোটা আর আলুভাজা খাওয়ার সময়ে মুখে যে হাসিটা ফুটতে দেখেছি, সেটা একেবারে স্কুলপড়ুয়া ছেলের হাসি। মনটাকে ওরকম রাখতে পেরেছিলেন বলেই বোধহয় এতগুলো দশক ওরকম নির্মল আনন্দের কমিক্স সৃষ্টি করতে পারলেন। শেষ দু-এক বছর শরীরটা খুবই খারাপ গিয়েছে, তার আগে পর্যন্তও তুলি হাতে নিলেই সবচেয়ে সুস্থ, সবল দেখাত তাঁকে।
ছোটদের জন্য কাজগুলো এত জনপ্রিয় হয়েছে যে বড়দের জন্য করা কাজগুলো অনেকের মনেই নেই। উনি কিন্তু দীর্ঘকাল নবকল্লোলের মত বড়দের পত্রিকার প্রচ্ছদ, ইলাস্ট্রেশন ইত্যাদি কাজ করেছেন। এছাড়াও বহু বড়দের বইয়ের প্রচ্ছদ তাঁরই আঁকা। একসময় বিপুল জনপ্রিয় স্বপনকুমারের রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের বইগুলোর প্রচ্ছদও এঁকেছিলেন তিনিই। ছেলেবেলায় ওই প্রচ্ছদগুলোই পাঠকদের কাছে আলাদা করে আকর্ষণীয় ছিল।
এখন অডিও ভিজুয়াল মাধ্যমের রমরমা। শিশু, কিশোররাও সেদিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। তবে তার মধ্যেও কমিক্স আঁকা হচ্ছে, খবরের কাগজে কমিক স্ট্রিপ বেরোচ্ছে। সম্প্রতি আমরা শুধুমাত্র কমিক্সের বই কেনা যায় এমন একটা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম করেছি, যার পিছনে অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করেছেন নারায়ণ দেবনাথ। সেই প্ল্যাটফর্ম অল্প সময়েই বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এগুলোই তাঁর উত্তরাধিকার। আশা রাখি আমাদের ছোটবেলা যেভাবে তাঁর কমিক্স পড়ার আনন্দে কেটেছে, আগামী প্রজন্মেরও সেভাবে কাটবে।
নিবন্ধকার শিল্পী এবং প্রয়াত নারায়ণ দেবনাথের স্নেহভাজন। মতামত ব্যক্তিগত।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।