সারা দেশ জুড়ে এখন জাতীয়তাবাদী স্লোগানের চিৎকৃত আধিক্য — দেশপ্রেমের ভীমগর্জনে মুখরিত আকাশ বাতাস। আজ প্রজাতন্ত্র দিবস, আরও বেশি উচ্চকিত হবার আজ সুবর্ণ সুযোগ, উচ্চ আদালতের শব্দদূষণ সংক্রান্ত যাবতীয় নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আসমুদ্রহিমাচল কম্পিত করে তোলবার আজ পরম পবিত্র লগ্ন।
এমনই এক শুভদিনে আজ মুম্বাইয়ের মাটিতে মহিলাদের এশিয়ান কাপ ফুটবলে ভারতের মুখোমুখি হবার কথা ছিল চীনের জাতীয় দলের। তারা কেবল এশিয়ার নয়, বিশ্বের অন্যতম সেরা দল। ইতিমধ্যেই দুটি ম্যাচে এগারো গোল দিয়ে বসে আছে। অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন বড় ব্যবধানে হেরে যেতে পারে ভারত, ম্যাচটি প্রজাতন্ত্র দিবসের সন্ধ্যায় না রাখলেই কি চলছিল না, এমন প্রশ্নও তুলেছিলেন অনেকে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
কেউ কেউ অবশ্য বলেছিলেন, চিন্তার কারণ নেই, অভিজ্ঞতার অভাব থাকলেও দুরন্ত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করবে আমাদের মেয়েরা। শেষ অবধি কিন্তু আশা নিরাশার দোলায় দুলতে থাকা সমর্থকদের হতাশ হতে হল; ম্যাচটিই হল না, কারণ তার কদিন আগেই ভারতীয় দলের এক ডজন সদস্য করোনা আক্রান্ত হলেন, অবস্থা এতটাই খারাপ যে এগারোজনের টিম নামানো সম্ভব নয়, এমনটাই জানালেন টিম ম্যানেজমেন্ট। নিট ফল — টুর্নামেন্টের নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভারতকে প্রতিযোগিতা থেকে নাম প্রত্যাহার করতে বাধ্য করলেন এশীয় ফুটবল সংস্থা। এমন লাঞ্ছনা বিশ্বের ফুটবল ইতিহাসে কোনো আয়োজক দেশের কপালে এই প্রথম।
অথচ কি আশ্চর্য, দেখা গেল ঘটনাটি নিয়ে বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই কারোর। ইংরেজি সংবাদমাধ্যমে সামান্য কিছু লেখালিখি হলেও, বাংলার যাবতীয় সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল এই বিষয়ে নিরুত্তাপ। সারা দেশ থেকে জড়ো হওয়া সাধারণ ঘরের ২৩টি মেয়ে বছর দুয়েক ধরে প্রাণপাত অনুশীলন করবার পর যদি মূল প্রতিযোগিতা থেকে করোনার কারণে বিতাড়িত হয়, তবে কী-ই বা এসে গেল; এই ঘটনা নিয়ে বিশেষ নাড়াচাড়া করবার প্রয়োজন কী? কর্তারা কুপিত হবেন, এমন প্রশ্ন না তোলাই শ্রেয়।
তবু, মনের মধ্যে জড়ো হয় একগাদা প্রশ্ন, বিশেষ করে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের ভূমিকা নিয়ে। কোনোটিরই সঠিক জবাব পাওয়া মুশকিল, কারণ জবাব দেবার দায় যাঁদের, তাঁরা বেগতিক দেখে গা ঢাকা দিয়েছেন, ফেডারেশনের সভাপতি প্রফু্ল প্যাটেল জানিয়েছেন “কারুর দিকে আঙুল তোলবার প্রয়োজন নেই।” দুর্জনে বলছে প্যাটেল নাকি আদতে বলতে চাইছেন, আমার ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করে লাভ নেই।
ফেডারেশন সচিব আবার এককাঠি ওপর দিয়ে গেছেন। তাঁর যুক্তি, এমনটা তো যে কোনো দলের সঙ্গেই হতে পারত। ঠিক কথা, তবে আর কোনো দলের সঙ্গে এমনটা হয়নি, অন্তত এখন অবধি। চলতি এশিয়া কাপে খেলছে ১২টি দেশ, এদের মধ্যে স্থানীয় দল শুধু ভারত। বাকি ১১ দল এই প্রবল করোনার আবহের মধ্যেই নিজেদের দেশ থেকে উড়ে এসেছে, ভারতের কোভিড আইন মেনে নিজেদের সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে রেখেছে এবং নিয়মিত খেলছে। যত সমস্যা যেন ভারতের। আমাদের মেয়েরাও যথেষ্ট সুরক্ষিত আছে, এমনই দাবি করেছিলেন ফেডারেশনের কর্তারা, কিন্তু কার্যত দেখা গেল এক ধাক্কায় করোনা আক্রান্ত হল ১২টি মেয়ে, মাঠে দল নামানোর অবস্থায় রইল না ভারত।
“এমনটা তো হতেই পারে” বলে পার পেয়ে যাবার চেষ্টা করছেন ফেডারেশনের যে সব কর্মকর্তা, তাঁদের প্রতি একটাই প্রশ্ন, ঠিক কী ধরনের সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে রাখা হয়েছিল ভারতের মেয়েদের? শোনা যাচ্ছে ভারতের হোটেলে নাকি নিয়মকানুনের বিন্দুমাত্র কড়াকড়ি ছিল না, সেটাই নাকি এই দুর্ভোগের প্রধান কারণ। কথাটা কতটা সত্যি আর কতটা গুজব, তার জবাব দেবার জন্যও এই মুহূর্তে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।
মজার ব্যাপার হল মহিলাদের এশিয়ান কাপ চলছে মুম্বাই এবং পুনেতে — অর্থাৎ দেশের এমন একটি রাজ্যে, যেখানে করোনার বাড়াবাড়িতে বিপর্যস্ত মানুষের জীবনযাত্রা। তবে এক্ষেত্রে বলা যায় যে মহারাষ্ট্রে এশিয়ান কাপ হবে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে বহুদিন আগেই, ভেন্যু পাল্টানোর কোনো সুযোগ সংগঠকদের কাছে ছিল না।
কিন্তু ভারতীয় দলের শিবির কেন আয়োজন করা হল কেরালার মত একটি রাজ্যে, যেখানে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা রীতিমত ভীতিজনক? অনেকেরই ধারণা, ভারতীয় দলের সদস্যরা আসলে কেরালা থেকেই করোনার বীজ বহন করে নিয়ে এসেছিলেন, মুম্বাইয়ে তা পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে মাত্র। তাই অনেকেই বলছেন, কী প্রয়োজন ছিল কেরালায় জাতীয় শিবির আয়োজন করবার?
প্রয়োজনটা সম্ভবত অর্থের। এই শিবির আয়োজনের যাবতীয় ব্যয় অনেকটাই বহন করেছেন কেরালার রাজ্য সরকার; এমনকি মাস দুয়েক আগে মহিলাদের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছিল কালিকটে। সেখানেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিজয়ন-পরিচালিত রাজ্য সরকার। সাধু উদ্যোগ সন্দেহ নেই, কিন্তু দক্ষিণের এই রাজ্যে শিবিরের আয়োজন সম্ভবত কিছুটা হঠকারিতা হয়ে গেছে।
কর্তারা মুখে বলছেন জাতীয় দলের এই বহিষ্কারে তাঁরা ভগ্নমনোরথ, সেই শাজাহান নাটকের “আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে, জাহানারা” মার্কা সংলাপ এখন তাঁদের মুখে ঘনঘন শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আদতে তাঁরা সত্যি কতটা বিচলিত, তাই নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়। নইলে পুরো ব্যাপারটা তড়িঘড়ি ধামাচাপা দেবার প্রয়াস না করে, তাঁরা এই কেলেঙ্কারির জন্য দায়ী কে, সেটুকু খুঁজে বার করবার একটা বাহ্যিক চেষ্টা অন্তত করতেন।
সম্ভবত তেমন কিছুই হবে না। সম্ভবত কেন, কিছুই যে হবে না — একথা বেশ জোর দিয়েই বলা যেতে পারে। সুতরাং পথ এখন একটাই — কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রকের উচিত অবিলম্বে একটি কমিটি গঠন করে পুরো ঘটনাটির তদন্ত করা, এবং দোষীদের চিহ্নিত করা। আয়োজক দেশ হয়েও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে বহিষ্কৃত হতে হল, এমন কেলেঙ্কারির সম্মুখীন ভারতকে ইতিপূর্বে কোনোদিন হতে হয়নি। প্রফু্ল প্যাটেলের জমানায় ষোলকলা পূর্ণ হল বলা যায়।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।