“ওরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না” – সেই কবেকার কবিগুরুর গান। সুখ কী? শান্তি কী? প্রেমই বা কী? এসব বড় বড় দার্শনিক প্রশ্ন। এসব কি সত্যিই সংখ্যায় পরিমাপ করা যায়? সুখ শান্তির ব্যক্তি ও সমষ্টিগত বহিঃপ্রকাশই বা কী?কোনটা উত্তম, কোনটা অনুত্তম তা কে স্থির করে? এ অনেকটাই আগন্তুক ছবিতে উত্থাপিত সভ্যতা কী আর অসভ্যতা কী – সেই তর্কের মত।

তথাপি বস্তুবাদের নিজস্ব আঙ্গিকে সমাজতাত্ত্বিক ও অর্থনীতিবিদরা সুখ বিষয়টিকে পরিমাপ করার চেষ্টা করেছেন। আর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের এই পরিমাপ দণ্ডে বারবার উঠে এসেছে ফিনল্যান্ডের নাম। জাতিপুঞ্জ যে বিষয়গুলি মাথায় রেখে ফিনল্যান্ডকে পরপর ছবার পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশের তকমা দিয়েছে সেগুলিকে কষ্টিপাথরে যাচাই করে তার সত্যতা, অসত্যতা নির্ধারণ করা নয়; বরং প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণকে সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়াই এই লেখার উদ্দেশ্য।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এখানে মানুষ বড় কম। চারিদিক বড় ফাঁকা ফাঁকা। আকার আয়তনে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় তিনগুণ এই দেশটা, অথচ জনসংখ্যা ৫৫ লক্ষ মত। মানে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় কুড়ি ভাগের একভাগ। এ দেশের বেশিরভাগটাই বনজঙ্গলে ভরা। পৃথিবীর সবচেয়ে সবুজ দেশগুলোর অন্যতম, সঙ্গে আছে অগণিত হ্রদ ও দ্বীপপুঞ্জ।

এখানে মানুষ প্রকৃতিকে বড় ভালবাসে। প্রকৃতির কাছাকাছি প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমশে একাত্ম হয়ে থাকতে চায়। প্রকৃতির সাথে একাত্মতার কথা বললে ভারতের তপোবন বা পর্ণকুটীর হয়ত মানসপটে ভেসে ওঠে। কিন্তু ফিনল্যান্ডে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একেবারে শীর্ষস্থানীয়। নোকিয়ার জন্ম এখানেই হয়েছিল। লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমের উদ্গাতাও একজন ফিনিশ। রাজধানী হেলসিঙ্কি এবং তার আশপাশই শুধু নয়, এখানকার ছোট-বড় শহর, বন্দর, নগর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম – প্রায় প্রত্যেকটা জায়গাই অত্যাধুনিক। বনজ সম্পদ ও প্রযুক্তিগত সম্পদ – এই দুয়ের সমাহারে মাথাপিছু আয়ের বিচারে পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ ফিনল্যান্ড।

এখানে বাচ্চারা ৮-৯ মাস বয়সের পর থেকেই ডে কেয়ারে যাওয়া শুরু করে। ডে কেয়ারে তাদের দেখাশোনা, পরিচর্যা, খাবার-দাবার ও অন্যান্য আয়োজন চমকপ্রদ। এর ব্যয়ভারের একটা বড় অংশ সরকার বহন করে।

নারী, পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা –প্রায় সবকিছুই বিনামূল্যে পাওয়া সম্ভব। উচ্চতর গবেষণায় সরকার বহু অর্থ ব্যয় করে। ফলে ছোট দেশ হয়েও আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদের ক্ষেত্রে পৃথিবীর উন্নততম দেশগুলির পাশে স্থান করে নিয়েছে ফিনল্যান্ড।

স্বাস্থ্যব্যবস্থাও এখানে অতি উচ্চমানের, যার খরচের বিরাট অংশ সরকার বহন করে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রায় সবটাই। মানুষের গড় আয়ু এখানে অনেক বেশি। নারীর গড় আয়ু আবার পুরুষের চেয়ে বেশি, জনসংখ্যার দিক থেকেও নারীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অনেকের মতে, সমাজ ও সংসার জীবনে ফিনিশ নারী পুরুষের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী।

তা বলে কি এখানে কোনো সামাজিক সমস্যা নেই? বিলক্ষণ আছে। দেশের মানুষের গড় বয়স চল্লিশের উপর। অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে যে পরিমাণ মানবসম্পদ প্রয়োজন তার বিপুল ঘাটতি রয়েছে, আছে মদ্যপানজনিত সমস্যা। সাম্প্রতিককালে বাড়ছে পারিবারিক কলহ ও হিংসার ঘটনা। তবু সব মিলিয়ে উন্নত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও সামাজিক সুরক্ষা এবং লিঙ্গবৈষম্য ও জাতপাতের মত সামাজিক ব্যাধি না থাকায় ফিনল্যান্ড বারবার ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে শীর্ষস্থান দখল করে, জিতে নেয় সবচেয়ে সুখী দেশের তকমা।

তবে যুগপৎ মজার এবং বিড়ম্বনার ব্যাপারও আছে। ফিনল্যান্ডের বেশিরভাগ মানুষ চুপচাপ, অন্তর্মুখী এবং অভিব্যক্তিহীন। সুখ বা শান্তির, আনন্দের যে স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ প্রত্যাশিত, তা এখানকার জীবনচর্যায় প্রায় চোখেই পড়ে না। দৈনন্দিন জীবনের কিছু খণ্ডচিত্র আঁকলে মনে হবে বিশ্বের সব দুঃখের ভার বহনের অদৃশ্য দায় যেন এ দেশের মানুষের ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুখী মানুষের মনে হাসি কোথায়? নাকি অভিব্যক্তি বর্জিত চিরসুখীজন অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত আপন মনে হেসে চলেছে, কেউ টের পাচ্ছে না? এসবের কোনো সদুত্তর নেই।

এ তো গেল ওদের কথা। এবার আমাদের কথা বলা যাক। আমাদের মানে ভারতীয়দের কথা, যারা এদেশে আছে। আমাদের জন্য কি এ দেশ স্বর্গোদ্যান বা অন্তত আকর্ষণীয়? সত্যি বলতে এর কোনো সহজ উত্তর নেই। নানাভাবে নানাদিক থেকে এই প্রশ্নকে দেখা যেতে পারে এবং প্রত্যেকটা দিকের আলোচনাই হবে দীর্ঘ। সেসবের অবকাশ এখানে নেই। তবু বিক্ষিপ্তভাবে দু-একটা বিষয় আলোচনা করা যাক।

ভারতীয়দের একটা বড় অংশ এদেশে এসেছে পরিণত বয়সে। তাই স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের মেধা, বুদ্ধি ছাড়াও সাথে নিয়ে এসেছে পুরোনো স্বভাব, অভ্যাস ও ভাললাগা। যে নির্জনতা একজন ফিনিশের কাছে মহার্ঘ, তা বাক্যবাগীশ কোনো বাঙালির সাময়িকভাবে ভাল লাগলেও দীর্ঘকাল সহ্য করতে হলে হয়ে দাঁড়াতে পারে মাথাব্যথার কারণ। এছাড়া অসূর্যম্পশ্যা দীর্ঘ শীত, নাতিদীর্ঘ নিশিহীন গ্রীষ্ম অনেক ভারতীয়কে উন্মাদ করে তোলে।

তাছাড়া এখানে আসা বেশিরভাগ ভারতীয় নিজের দেশের উচ্চকোটির মানুষ। মানে শাসকশ্রেণির না হলেও শোষকশ্রেণির লোক তো বটেই। শোষকশ্রেণি বলতে আমি বোঝাচ্ছি ভারতীয় সমাজের যে অসাম্য, এরা তার সুবিধাভোগী শ্রেণি। অর্থাৎ শস্তায় গৃহপরিচারিকা বা গাড়ির চালক পেয়ে অভ্যস্ত। ফলে নিজের গাড়ি, বাড়ি পরিষ্কার করা ছাড়াও অনেক ব্যাপারে যে আত্মনির্ভরতা ফিনল্যান্ডের সমাজ দাবি করে, সেটা অনেকের মনঃপূত হয় না। গড় আয়ে সমাজের শীর্ষে থাকা সত্ত্বেও ফোন করে নিজের পরিচিতি কাজে লাগিয়ে এখনই একটা ভাল ডাক্তারের কাছে চলে যাওয়া ফিনল্যান্ডে সম্ভব নয়।

এসব বাদ দিলেও প্রবাসজীবনের কিছু অনিশ্চয়তা তো থাকেই। যেমন সম্প্রতি ক্ষমতায় এসেছে দক্ষিণপন্থী ফিন পার্টি। এদের বিদেশীবিদ্বেষ সর্বজনবিদিত। দেশি-বিদেশি, নাগরিক-অনাগরিক নির্বিশেষে যে ‘প্রায়-সমানাধিকার’ পরম্পরা গত কয়েক দশকে ফিনল্যান্ডের জীবনে চলেছে, ইদানীং কিছু প্রস্তাবিত নীতির ফলে তাতে বিঘ্ন ঘটার বিপুল আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। স্বল্পবাক, অভিব্যক্তিহীন ফিনিশদের ভারতীয়দের প্রতি সমষ্টিগত মনোভাব বোঝা বেশ কষ্টকর। তাছাড়া রাশিয়ার মত মহাশক্তিধর ও বৈরী রাষ্ট্রের প্রতিবেশী হওয়ার বিড়ম্বনা দেশি-বিদেশি নির্বিশেষে সকলের তো আছেই।

আরো পড়ুন অভিবাসী দমন করে বাঁচার রাজনীতি ফাঁপরে পড়েছে

এই ভালোমন্দের জোয়ার ভাঁটায় ছিন্নমূল ভারতীয়রা জল মাপতে থাকে। অতীতে আর্থিক সঙ্গতি ও সামাজিক সুরক্ষার পাল্লাই বেশি ভারি প্রতিপন্ন হয়েছে। সেই কারণে কেবলমাত্র সাতে পাঁচে না থাকা ভারতীয়রাই নয়, দিবারাত্র এদেশের মুণ্ডপাত করা সিংহভাগ ভারতীয়ই এদেশ ছেড়ে চলে যায়নি। কিন্তু ভবিষ্যৎ কে বা জানে!

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.