একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পর উত্তরবঙ্গ নাম দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু সংখ্যক জেলা নিয়ে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বা আলাদা রাজ্যের দাবি তুলেছেন মুখ্যত আলিপুরদুয়ারের সাংসদ বিজেপির জন বার্লা। সুচতুরভাবে এই দাবিকে সমর্থন করে কোচবিহারের বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামাণিকের অনুগামীরা ভার্চুয়ালি সক্রিয় হয়ে উঠেছেন বছর দুয়েক ধরে। জন বার্লার দাবিনিশীথ অনুগামীদের প্রচার ব্যক্তিগত মতামত বলে চালাবার চেষ্টা করলেও  এই দাবিতে দল হিসাবে বিজেপির প্রচ্ছন্ন মদত আছে । ২০১৯-এর নির্বাচনের পর থেকেই উত্তরবঙ্গ বলে চিহ্নিত অঞ্চলের রাজনীতি সচেতন প্রতিটি মানুষই জানতেন যে একুশের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতা না পেলেএই অঞ্চল নিয়ে আলাদা রাজ্যের তাস বিজেপি খেলবেই। সুতরাং বিজেপির এই উত্তরবঙ্গ নামে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বা রাজ্যের দাবি উসকে দেওয়া খুবই প্রত্যাশিত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত অঞ্চল বাদ দিয়ে এই অঞ্চলটিকে ঘিরে ‘বিচ্ছিন্নতা’র দাবিকে যুক্তির মোড়কে ন্যায্য অধিকার বলে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব, যা অবশ্যই বিজেপি কাজে লাগাতে চাইবে। এই লেখা এই অঞ্চলের ‘বিচ্ছিন্নতার’ দাবির যুক্তিযুক্তির মোড়ক ও সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার একটা চেষ্টা মাত্র।

মালদা থেকে দার্জিলিং অবধি যে ভূখণ্ড উত্তরবঙ্গ নামে চিহ্নিত সেখানকার রাজনৈতিক ইতিহাস খেয়াল করলেই দেখা যাবে বিচ্ছিন্নতার দাবি সেইখানে দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজকের সময় অবধি আলাদা রাজ্যের তিনটি দাবি রয়েছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

প্রথম দাবি হল পুরো দার্জিলিংকালিম্পং এবং আলিপুরদুয়ারজলপাইগুড়ির খানিক অংশ নিয়ে গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি। গোর্খা পরিচিতি কোনো নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি নয়। প্রাথমিকভাবে দার্জিলিং পাহাড়ে ব্রিটিশদের চা-অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে নেপালের গোরখপুর থেকে আনা নেপালি, যাঁরা মূলত চা-শ্রমিক ও সৈনিক হিসাবে ব্যবহৃত হতেন, তাঁরাই গোর্খা। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই নেপালিলিম্বুরাইলেপচা এই পৃথক কৃষ্টি-পরিচিতিগুলি একত্রিত হয়ে গোর্খা পরিচিতি গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। পৃথক রাজ্যের দাবিতে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই বারবার সহিংস আন্দোলন দেখেছে পাহাড়।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের স্বাধীনতার পর তৎকালীন রাজশাসনে থাকা পৃথক রাষ্ট্র কোচবিহারকে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হলেকোচবিহারের সাধারণ মানুষের সংগঠন ‘হিতসাধনী সভা’ কোচবিহারি অস্মিতার পক্ষে সওয়াল করে কোচবিহারকে ভারতীয় ইউনিয়নে পৃথক রাজ্য হিসাবে যোগদানের দাবি জানায়। সেই দাবি মানা না গেলে কোচবিহারকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানায় এই সংগঠনএবং তাও মানা সম্ভব না হলে কৃষ্টিগত নৈকট্যের জন্য পশ্চিমবঙ্গের বদলে অসমের সঙ্গে কোচবিহারকে সংযুক্ত করার প্রস্তাব দেয়। এই দাবিই পরবর্তীকালে ‘গ্রেটার কোচবিহার’ রাজ্যের দাবিতে পরিণত হয় এবং সেই দাবি এখনো রয়েছে।

তৃতীয় দাবিটি কামতাপুর রাজ্যের দাবি। দেশভাগের আগেই ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে যোগেন মণ্ডল অধুনা বাংলাদেশের রংপুরদিনাজপুরের কিছু অংশস্বাধীন কোচবিহারঅসমের অন্তর্ভুক্ত গোয়ালপাড়াবাংলার অন্তর্ভুক্ত জলপাইগুড়ি ও বিহারের অন্তর্ভুক্ত পূর্ণিয়া জেলার কিছু অংশ নিয়ে দলিত রাজবংশী অস্মিতাকে মর্যাদা দিয়ে ‘রাজস্থান’ নামে একটা পৃথক রাজ্যের প্রস্তাব দেন যেখানে অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত রংপুরআংরাপোতাদহগ্রামপাটগ্রামের নমঃশূদ্ররাজলপাইগুড়ির মদেশীয়মেচরাভাটোটোওঁরাওরাজলপাইগুড়ি ও কোচবিহারের ইসলাম ধর্মাবলম্বী রাজবংশী নস্য শেখরা একত্রে বসবাস করবে। দলিতপ্রধান এই প্রস্তাবিত রাজ্যটি প্রকৃতপক্ষে দলিত পরিচিতির একটি কাঙ্খিত সনদের নিদর্শন, যেখানে দলিত পরিচিতি নৃতাত্ত্বিকসাংস্কৃতিকধর্মীয় ও ভাষা পরিচিতিকে অতিক্রম করে দলিত যোগসূত্রে গাঁথার পরিকল্পনা যোগেন মণ্ডলের ছিল। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের শুরু থেকে প্রাথমিকভাবে এই অঞ্চলের রাজবংশী মানুষের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করে উত্তরাখন্ড দল ও উত্তরবঙ্গ তপশীলি ও আদিবাসী ছাত্র সংগঠন। এঁরা সরকারি চাকরিতে এই অঞ্চলের রাজবংশীমদেশীয়রাভামেচটোটোগোর্খা এই জাতিদের সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্ব দাবি করেনবাঙালি বর্ণহিন্দুর দ্বারা এই অঞ্চলের দলিত ও আদিবাসী ছাত্রছাত্রীর উপর ঘটা বর্ণবৈষম্যের বিচার চানবাংলার পরিবর্তে রাজবংশীসাদ্রীরাভাওঁরাও ইত্যাদি ভাষায় স্কুলস্তরে পাঠদান দাবি করেন। এই সংগঠনগুলি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি জানায়। এই অঞ্চলের রাজবংশীদের সঙ্গে কোচবিহারি পরিচিতি প্রায় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যাওয়ায় বাকি জনজাতিগুলি আন্দোলন থেকে সরে আসতে পারে, এই আশঙ্কা থেকেই কামতাপুর পরিচিতির জন্ম। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে উপরোক্ত সংগঠনগুলি কামতাপুর পিপলস পার্টি নাম নিয়ে একটি ছাতার তলায় আসে। ষোড়শ শতাব্দীতে কোচবিহার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে কামতাপুর নামে যে রাজ্য ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীর থেকে হিমালয়ের তরাই-ডুয়ার্স অবধি বিস্তৃত ছিল বলে কথিত রয়েছেযে রাজ্যের পতন বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের হাতে হয় বলে কথিতসেই খানিক ঐতিহাসিক ও খানিক মিথনির্ভর আখ্যানের উপর ভর করে কামতাপুরি পরিচিতির জন্ম দেওয়া হয়। রাজবংশীমেচখেনরাভাকৈবর্ত — সকলেই কামতাপুরি নামক বৃহত্তর জাতি পরিচিতির অন্তর্ভুক্ত। যোগেন মণ্ডলের প্রস্তাবিত রাজ্যের মডেলেই উত্তরবঙ্গের সমস্ত জেলা এবং অসমের গোয়ালপাড়া নিয়ে একটি পৃথক কামতাপুর রাজ্যের দাবি কামতাপুর পিপলস পার্টি তখন থেকেই করে আসছে। এই দাবি অনুযায়ী এই অঞ্চলে বাঙালি সংস্কৃতির আগ্রাসন হেতু কামতাপুরি সংস্কৃতি বিপন্নবাঙালি উদ্বাস্ত হেতু কামতাপুরিদের জমি ও অর্থনীতি বিপন্নএই অঞ্চলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোনো ধরণের উন্নয়নমূলক কাজ করে না দশকের পর দশক। ভূমিপুত্রকন্যাদের অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য এবং এই অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য এই অঞ্চলকে পৃথক রাজ্যে পরিণত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই তিনটি দাবির একটিও ধর্মকে পরিচিতির সূচক হিসাবে ধরেনি। এই তিনটি দাবির কোথাও ‘বঙ্গ’ শব্দটি নেই।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে লক্ষ করার মতো বিষয় হল এই তিনটি আলাদা রাজ্যের দাবিতে এই অঞ্চলে বসবাসকারী আরো দুইটি প্রধান জনজাতির কোনো অংশীদারি নেই: মদেশীয় ও বাঙালি, যারা নদীর নিম্নগতির অঞ্চলের মানুষ হওয়ায় ‘ভাটিয়া’ নামে পরিচিত এই অঞ্চলে। এই ভাটিয়াদের সিংহভাগ পূর্ব পাকিস্তানঅসম ও বাংলাদেশ থেকে প্রাণের ভয়েজমি হারিয়ে চলে আসা নমঃশূদ্র উদ্বাস্তু। ভৌগোলিকভাবে এদের অধিকাংশই অধুনা বাংলাদেশের উত্তর দিকের অংশ থেকে এসেছিলেন। ফলত সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবে এরা যোগেন মণ্ডল প্রস্তাবিত অঞ্চলটিরই বাসিন্দা। এঁদের একাংশ আবার দুবারের উদ্বাস্তু। প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুসলিমদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে অসমে বসবাস করে পাঁচ-দশ বছর, তারপর ছয়ের ও সাতের দশকে অসমের হিন্দুদের দ্বারা পুনরায় বিতাড়িত হয়ে এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। উল্লেখ করার মতো বিষয়টি হল পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বা আলাদা রাজ্য দাবি করলেন বিজেপির যে দুই নেতা, জন বার্লা ও নিশীথ প্রামাণিক, তাঁরা যথাক্রমে মদেশীয় ও ভাটিয়া নমঃশূদ্র, যাঁরা কেউ এই অঞ্চলের ভূমিপুত্র নন। আরো মজার ব্যাপার এই, যে উপরোক্ত তিনটি দাবির প্রত্যেকটিতেই বঙ্গ’ জনিত আগ্রাসনের জন্যই বিচ্ছিন্নতার দাবি উঠেছেঅথচ বার্লা ও নিশীথের এখনকার দাবির নাম দেওয়া হল উত্তরবঙ্গ, যা নিজের নাম দিয়েই স্বীকার করতে চাইছে যে এটি ঐতিহাসিকভাবে বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাহলে এই নাম নিয়ে বিচ্ছিন্ন হতে চাওয়ার বীজ রুয়া হল কীভাবেউত্তরবঙ্গ নামে যদি কোনো আলাদা রাজ্য কোনোদিন হয়, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব অবশ্যই পাবে কলকাতাকেন্দ্রিক আমলাতন্ত্র। কলকাতাকেন্দ্রিক আমলাতন্ত্রের জন্যই উত্তরবঙ্গ নামে একটি কাল্পনিক অঞ্চল গঠিত হয়েছে। মালদা থেকে শুরু করে দার্জিলিং অবধি অঞ্চলকে একই ব্র্যাকেটে দেখার প্রবণতাপূর্বতন জলপাইগুড়ি ডিভিশন নামক একটি আমলাতান্ত্রিক অঞ্চলকে উত্তরবঙ্গ নামে চিহ্নিত করা এবং শুধুই শাস্তিমূলক বদলির জায়গা হিসাবেই এই অঞ্চলকে দেখে যাওয়ার প্রবণতা আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে উত্তরবঙ্গ নামক বিচ্ছিন্নতার বীজতলা। চুয়াত্তর বছর ধরে চলতে থাকা বাঙালি বর্ণহিন্দু আধিপত্য প্রধান কলকাতা-কলোনিয়ালিজম উত্তরবঙ্গ নামক বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিয়েছে। এই বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিয়ে এই সময়ে বিজেপি নির্মিত স্লোগান উত্তরবঙ্গ আলাদা রাজ্য চাই একই সঙ্গে আগ্রহব্যঞ্জক এবং তার চেয়েও বেশি ভঙ্গুর।

গোর্খাল্যান্ডগ্রেটার কোচবিহারকামতাপুর — এই তিনটি দাবির মূল সুরই হল বাঙালি কৃষ্টির থেকে পৃথক সত্তা এবং ভূমিপুত্রকন্যাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রাধিকার সুনিশ্চিত করা। তিনটি দাবিই যে ভৌগোলিক অঞ্চলগুটিকে নিজ সীমানার ভিতর রাখতে চায় তা হল তরাই ও ডুয়ার্স। যদি জনসংখ্যার বিন্যাসে ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তার সহাবস্থানের দিকে আমরা খেয়াল করি তাহলে মালদাউত্তর দিনাজপুরের সমভূমি মূলত বাঙালি কৃষ্টিরকোচবিহারদক্ষিণ দিনাজপুর সমভূমি মূলত রাজবংশী/কামতাপুরি কৃষ্টিরপার্বত্য দার্জিলিং ও কালিম্পং গোর্খা কৃষ্টির। এই সমস্ত ভৌগোলিক অঞ্চল যে ভৌগোলিক অঞ্চলে এসে মিশছে তা হল তরাই ও ডুয়ার্স। আজকের সময়ের প্রেক্ষিতে এই অঞ্চল মোটামুটিভাবে বিধাননগর-বাগডোগরা-নকশালবাড়ি থেকে শুরু করে শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি-মালবাজার-আলিপুরদুয়ার অবধি বিস্তৃত। এই অংশের কৃষ্টিজনসংখ্যায় বিবিধ জাতিসত্তার অনুপাতভাষা — কোনোটিই একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির প্রাধান্য সূচিত করে না। তিনটি দাবিই তাই এই অঞ্চলকে নিজেদের বলে দাবি করে। এই অঞ্চলের ভূমিপুত্রকন্যাদের বঞ্চনার কথা বারংবার সামনে এনে বিচ্ছিন্নতার দাবিকে যৌক্তিক বলা হয়। সুচতুরভাবে রাজবংশী জোতদারদের হাতে রাজবংশী কৃষকের নিপীড়নের ইতিহাস বিচ্ছিন্নতার দাবি তোলার সময় ভুলে যাওয়া হয়। গোটা ব্যাপারটিকে দাঁড় করাতে চাওয়া হয় বাঙালি উদ্বাস্তু দ্বারা নিপীড়নের ফলে ভূমিপুত্রকন্যাদের প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতর হয়ে চলার ইতিহাস হিসাবে।

এই ভূমির ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখা যায় যে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি চা-বাগান পত্তনের আগে তরাই ও ডুয়ার্স কখনো সিকিমেরকখনো ভুটানেরকখনো নেপালেরকখনো কোচবিহারেরআবার কখনো কথিত কামতাপুর রাজ্যের ছিল। সুতরাং যে ভূমি বারংবার রাজনৈতিকভাবে এক হাত থেকে অন্য হাতে গেছেসেই অঞ্চলের ভূমিপুত্রকন্যা ব্যাপারটি অনেকাংশেই একটি নির্মাণবিশেষ। তরাই ও ডুয়ার্সের ভূমিপুত্রকন্যার ধারণা নির্মাণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে এখানকার অর্থনীতি বিকাশে বিবিধ জনজাতির ভূমিকা।

জন বার্লা এই অঞ্চলেরই ঐতিহাসিকভাবে ‘বহিরাগত’ মদেশীয় জনজাতির মানুষ। চা-বাগান পত্তনের সময় যাদের ছোটনাগপুর ও ছত্তিশগড় থেকে জোর করে তুলে এনেছিল ইংরেজরা। এই অঞ্চলের অর্থনীতির বিকাশে মদেশীয়দের ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে আজকে এই অঞ্চলের প্রেক্ষিতে মদেশীয়রা ভূমিপুত্রকন্যা। একই কথা প্রযোজ্য গোর্খাদের ক্ষেত্রেও। মজার ব্যাপার এই যে জন বার্লা গোর্খাবিহারিমাড়োয়ারি কাউকে এই অঞ্চলের ‘বহিরাগত’ বলে দেগে দেননিতিনি সুনির্দিষ্টভাবে ‘বাংলাদেশি’ শব্দটি ব্যবহার করে বাঙালি উদ্বাস্তুদেরই চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। ১৯৬০-এর আগে এই অঞ্চলের তিস্তাতোর্সাজলঢাকা অববাহিকার গ্রামগুলির বিন্যাস ও এখনকার গ্রামগুলির বিন্যাস দেখলে কিছু লক্ষণীয় পরিবর্তন চোখে পড়ে। ধানি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়াআলু চাষের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়াবিবিধ তরিতরকারী চাষের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়াছোটো চা-বাগানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াপেয়ারা বাগানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া। প্রতিটি ক্ষেত্র সূচিত করে এই অঞ্চলে উদ্বাস্তু বাঙালি ভাটিয়াদের শ্রম। এই শ্রমের অর্থনৈতিক অবদান অনস্বীকার্য। আবার চাষের জমির জন্য এই অঞ্চলে বিবাদও গত পঞ্চাশষাট বছর ধরে হয়েই আসছে। স্বাভাবিকভাবেই চাষের জমির দখলদারিতে সংঘর্ষ হয়েছে মূলত ভাটিয়া ও রাজবংশীদের ভিতর, কারণ ধানি জমিতে স্বার্থ এই দুই গোষ্ঠীর যতটা ছিলগোর্খামদেশীয়দের ততটা ছিল না । ফলত পারস্পরিক অবিশ্বাস ও হিংসা রাজবংশী ও ভাটিয়া গোষ্ঠীর মধ্যে অনেক বেশি প্রবল।

এই প্রেক্ষিত থেকেই নিশীথ প্রামাণিক খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিশীথ একজন ভাটিয়া নমঃশূদ্র যিনি পোষাকেআচারে নিজেকে কোচবিহারি রাজবংশী হিসাবে দেখাতে চান। নিশীথের এই নির্মাণই আজকের উত্তরবঙ্গ আলাদা রাজ্য চাই-এর কাঠামো। মজার ব্যাপারটি হল এই কাঠামো খুব একটা বাস্তব ভিত্তির উপর নির্মিত হয়নি । মূলত সোশাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে ২০১৯ পরবর্তী সময়ে “উত্তরবঙ্গ বঞ্চিত”, “উত্তরবঙ্গ আলাদা রাজ্য চাই” ইত্যাদি ‘ক্লোজ গ্রুপ’ তৈরি করে সেই গ্রুপগুলি থেকে বাছাই করা এমন সব কনটেন্ট ছড়ানো হয়েছে, যার ফলে নিশীথকে এই অঞ্চলের বাইরের মানুষের কাছে রাজবংশী অস্মিতার সঙ্গে জুড়ে দিতে সুবিধা হয়েছে বিজেপির। একইসঙ্গে নিশীথ নমঃশূদ্র হওয়ায় এই অঞ্চলের নমঃশূদ্রদের কাছে এই বার্তা দেওয়া গেছে, যে প্রস্তাবিত উত্তরবঙ্গের মুখ একজন নমঃশূদ্র হলে গ্রেটার কোচবিহারকামতাপুরে যে সিএএ বাদ দিয়ে এনআরসি ও বাঙাল খ্যাদাও অলিখিত কর্মসূচী রয়েছে তা সম্ভ হবে না। ফলত উত্তরবঙ্গ নামক এক আজব ধারণার জন্ম হয়েছে, যেখানে একজন ভাটিয়া নমঃশূদ্র রাজবংশী অস্মিতার মুখ। ভার্চুয়ালি নিশীথকে এক অতীব শক্তিশালী জননেতা হিসাবে বারবার তুলে ধরা হয়েছে বিজেপির তরফ থেকে। এমন শক্তিশালী জননেতা নিজের বাড়ির বিধানসভা কেন্দ্রে একুশের নির্বাচনে ব্যালট ভোটে পিছিয়ে ছিলেন পাঁচশোর উপর ভোটেপোস্টাল ব্যালটের কল্যাণে সাতান্ন ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। যে বিচ্ছিন্নতার দাবি নিশীথকে প্রতীক করে গড়ে উঠেছেতার বাস্ত ভিত্তির আন্দাজ এই তথ্য থেকেই পাওয়া সম্ভব। বিজেপি নিজেও এই দাবির কার্যকারিতা নিয়ে খুব আশাবাদী না হওয়ায় এই দাবিগুলিকে ব্যক্তিগত মতামত বলে চালিয়ে দিয়ে তৃণমূলকে প্রচ্ছন্ন চাপে রেখেছে। যে চাপ স্পষ্ট হয়ে উঠছে কামতাপুরের এখনকার মুখ অনন্ত মহারাজের সঙ্গে রাজ্য সরকারের বিবিধ বোঝাপড়ার চেষ্টায়। ইউএপিএতে গ্রেপ্তার হওয়া কেএলও কর্মীদের মুক্তি দেওয়া এবং একই আইনে আটক দক্ষিণবঙ্গের রাজনৈতিক কর্মীদের মুক্তি না দেওয়া দেখাচ্ছে রাজ্য সরকার পরিচিতি সত্তার রাজনীতির কাছে খানিক ব্যাকফুটে। এই অবস্থায় পরিচিতির রাজনীতিকে গুরুত্ব না দিয়ে উন্নয়ন না হওয়া ইস্যুতে উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্য করতে চাওয়া বিজেপির বাঙালি হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক রক্ষার একটা মরিয়া প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টা সফল না হলে বিজেপি ‘গ্রেটার কোচবিহার’ নামটিতে ঝুঁকতে পারে, যার ইঙ্গিত অমিত শাহ কোচবিহারে একুশের নির্বাচনী সভাগুলোয় বারবার দিয়েছেন।

শেষে আসে সেই অবধারিত প্রশ্ন: উত্তরবঙ্গ আলাদা রাজ্য হলে কার লাভউত্তরবঙ্গ নাম নিয়ে আলাদা রাজ্য হলে ‘বঙ্গ’ নামক হেজিমনিকে কাজে লাগিয়ে সবচেয়ে বেশি লাভ হবে নিঃসন্দেহে বাঙালি বর্ণহিন্দুকামরূপী ও মৈথিলি ব্রাহ্মণদেরবাঙালি হতে চাওয়া এলিট রাজবংশীগোর্খা ও মদেশীয়দের। উত্তরবঙ্গ নাম নিয়ে রাজ্য হলে তা বাঙালি কৃষ্টিকেই বৃহত্তর চেহারায় সমৃদ্ধ করবে। এই নাম নিয়ে রাজ্য হলে একই সাথে এই অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়ে যে তিনটি ঐতিহাসিক ও যৌক্তিক দাবি রয়েছে তা অবলুপ্ত হবে। একই সঙ্গে অবলুপ্ত হবে গোর্খাকোচবিহারি রাজবংশী ও কামতাপুরি অস্মিতার স্বাতন্ত্র্য থাকার ইতিহাস ও লড়াই।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.