রাজদীপ বিশ্বাস রুদ্র

“‘আঙ্কেল, তোমরা আমার বাবাকে গুলি করে দিলে? মেরে ফেললে আমার বাবাকে?’ আমার প্রশ্ন শুনে ওরা অশ্লীলভাবে হেসে উঠলো আমার মুখের ওপর। আমি বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে রেসপন্ড করব!” সাক্ষাৎকারে বলছিলেন হায়দরপোরা এনকাউন্টারে সদ্য নিহত কাশ্মীরের বাসিন্দা আলতাফ আহমেদ ভাটের ১৪ বছরের কিশোরী কন্যা। চোখে মুখে আতঙ্ক।

অবশ্য কেবল আলতাফ ভাট নয়, পরশুর এনকাউন্টারে নিহত হয়েছেন আরও তিনজন। তাদের মধ্যে রয়েছেন দন্ত চিকিৎসক ডাঃ মুদাসির গুলও। কাশ্মীর পুলিশের আইজির দাবি অনুযায়ী ওই চারজন বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন। একজন পাকিস্তানের নাগরিক। অন্যদিকে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে উঠে আসছে অন্য তথ্য।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

তাঁরা জানাচ্ছেন, এনকাউন্টারে নিহতদের প্রথমে একটি শোরুমের কাছে জড়ো করা হয়। তারপর তাদের গুলির লড়াইয়ের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। কাশ্মীরওয়ালার রিপোর্ট অনুযায়ী বানিহালের নিহত যুবকও সাধারণ নাগরিকই। তিনি ডাঃ গুলের অফিসে কর্মচারী হিসাবে কাজ করতেন। তাঁর নাম আমির। বানিহালের বাসিন্দা আমিরের হত্যার ঘটনায় বিক্ষোভের আশঙ্কায় এদিন রামবান এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ জন পুলিশের দাবি মত পাকিস্তানের নাগরিক হায়দর। তাঁকে স্থানীয় মানুষ চেনেন না। কাশ্মীরওয়ালা চারজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ওঁরা ঘটনার সময়ে হায়দরপোরার ওই শপিং কমপ্লেক্সের সামনে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের বক্তব্য চারজনের মধ্যে তিনজনই সাধারণ নাগরিক এবং তাঁরা রোজকার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আলতাফ ভাটের আত্মীয়রা জানিয়েছেন, তথাকথিত গুলির লড়াইয়ের আগে বাহিনীর কিছু লোক ‘ফেরান’ পরা মজুত ছিল শপিং কমপ্লেক্সের কাছে। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ কর্ডন করার পরে তল্লাশি অভিযান শুরু হয়। ‘ফেরান’ পরা জওয়ানরা এরপর তল্লাশির দলে যোগ দেয়।

অন্য আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী দোকানদার জানান, তিনি দেখেছেন শপিং কমপ্লেক্সের দিকে যখন বাহিনী যাচ্ছিল, সেই সময়ে আমির নিচে নেমে আসে। তখনই তাঁকে ধরে বাহিনী তল্লাশি শুরু করে, তাঁর ফোন দিতে বলা হয়। আমির জানান, তিনি ফোন সাথে করে নিচে আসেননি। তল্লাশির পর আমিরকে কাছের হাসপাতালের দিকে যেতে দেখেছেন তিনি। গন্ডগোল বাড়ছে দেখে আলতাফ তাঁর ভাইপোকে দোকান বন্ধ করতে বলেন। দোকান বন্ধ করতে দেখে আলতাফকে নিয়ে তল্লাশি করতে যেতে চায় পুলিশ। আলতাফ তা এককথাতেই মেনে নেন। প্রথমবার তল্লাশির পরে আলতাফ এবং মুদাসিরকে নীচে নিয়ে আসা হয়। বাহিনী যখন গোটা এলাকা তল্লাশি করে, তখন সমস্ত দোকানদার এবং কর্মীদের কাছের টু-হুইলার শোরুমের সামনের ফাঁকা জায়গায় জড়ো হতে বলে। ভাট এবং মুদাসিরকেও সেখানে নিয়ে আসা হয়। ওই প্রত্যক্ষদর্শীর মতে সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করলেই এসবের সত্যতা প্রমাণ হয়ে যাবে। এর আধঘন্টা পরে বাহিনী ফের ভাটকে ডেকে পাঠায় এবং দোকান বন্ধ করতে বলে। দোকানটি তখনো পর্যন্ত খোলা পড়েছিল। ভাটকে নিয়ে বাহিনী শপিং কমপ্লেক্সে ঢোকে, তারপর ফের তাঁকে ছেড়ে দেয়। তৃতীয়বার ভাটকে ফের নিয়ে যায়। এবার সঙ্গে ডাঃ মুদাসিরকেও নিয়ে যায়। তারপর আর তাঁরা ফেরেননি বলে জানিয়েছেন এক প্রত্যক্ষদর্শী।

ওই প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, তৃতীয়বার নিয়ে যাওয়ার পরে শপিং কমপ্লেক্সের ভেতর থেকে প্রচণ্ড গুলির আওয়াজ আসতে থাকে। গুলির আওয়াজ বন্ধ হলে ওঁরা পুলিশের কাছে ভাট এবং মুদাসির সম্পর্কে জানতে চান। পুলিশ তাঁদের জানায়, ওরা দুজন ঠিক আছে। আরেক দোকানদার জানিয়েছেন রাত সাড়ে এগারোটার সময়ে তাঁদের শপিং কমপ্লেক্স থেকে বেরনোর অনুমতি দেওয়া হয়। তখন তাঁরা জানতে পারেন দুজনই নিহত।

হায়দর বলে পরিচয় দিয়ে পুলিশ যাকে পাকিস্তানের নাগরিক বলছে, তার মৃত্যু নিয়েও রহস্য তৈরি হয়েছে। দোকানদাররা বলছেন, এনকাউন্টার শুরুর আগে তাকে কেউ ওই শপিং কমপ্লেক্সে কেউ দেখেননি।

পুলিশ কি তাহলে মিথ্যা কথা বলছে? ক্রস ফায়ার হয়ে থাকলে মৃতদেহ পরিবারের হাতে তুলে দিতে কিসের আপত্তি পুলিশের? – এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর পাননি নিহতের পরিজনেরা। দেহ ফেরত এবং ন্যায় বিচারের দাবিতে তাঁরা শ্রীনগরের প্রেস এনক্লেভে অবস্থানে বসেছিলেন। উপত্যকায় অসন্তোষ এত তীব্র যে শেষপর্যন্ত চাপের মুখে লেফটেন্যান্ট জেনারেল মনোজ সিনহা ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে হায়দরপোরা এনকাউন্টারের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

আঠারো মাস বয়সের সদ্য পিতৃহারা বাচ্চা মেয়েটি এখনও জানে না যে তার বাবা আর কখনও বাড়ি ফিরবেন না। আর কখনো তাকে কোলে নেবেন না। বাবা ন্যাওটা মেয়েটি পুরো একটা দিন বাবাকে দেখতে না পেয়ে কেঁদে চলেছে সমানে। মেয়েকে সাথে নিয়েই ন্যায়বিচারের দাবীতে পথে নেমেছেন ডঃ মুদাসিরের স্ত্রী হুমাইয়া। হুমাইয়া ক্যামেরার সামনে কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন “ওরা প্রমাণ করুক আমার স্বামী জঙ্গী ছিল। কেন খুন করল ওরা আমার স্বামীকে? আমার মেয়ে সমানে কেঁদে চলেছে ওর বাবা বাড়ি না আসায়। মেয়েকে কী করে বোঝাব?”

হুমাইয়া কী করে বোঝাবেন আমরা জানি না। এও জানি না, এই বাচ্চা মেয়েটি বা আলতাফ ভাটের কিশোরী মেয়েটি বড় হয়ে যখন আমাদের প্রশ্ন করবে কেন তাদের বাবাদের হত্যা করা হল, এবং আমরা যারা কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে দাবি করি, সেই ভারতীয় নাগরিকরা এই নির্মম অমানবিক হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে কী অবস্থান নিয়েছিলাম, আমরা কেন চুপ ছিলাম, তখন কী জবাব দেব। সেদিন হয়ত বিজেপি থাকবে না, কিন্তু আমরা থাকব। এই ফ্যাসিবাদীদের কৃতকর্মের দায় বহন করতে হবে আমাদের। বছর তিনেক আগে জার্মানির তৎকালীন চ্যান্সেলার অ্যাঞ্জেলা মার্কেল পোল্যান্ড সফরে গিয়েছিলেন। তাঁকেও একইরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। পোল্যান্ডের আউসভিৎজ ডেথ ক্যাম্প, যেখানে নাজিরা খুন করেছিল কয়েক লক্ষ পোলিশ নাগরিককে, মার্কেল সেখানে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। ক্ষমা চেয়েছিলেন নাজি জার্মানির কৃতকর্মের জন্য। একদিন আমাদেরও হয়ত কাশ্মীরিদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে বিজেপি সরকারের কৃতকর্মের জন্য। কিন্তু আমরা কি ক্ষমা পাব? ওই বাচ্চা মেয়েগুলি কি কখনও ক্ষমা করতে পারবে আমাদের? জানি না।

মতামত ব্যক্তিগত।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.