গত ২১ মে, ২০২২ (শনিবার) কলকাতার ন্যাশনাল মাইম ইনস্টিটিউটে হাতিবাগান সঙ্ঘারাম নাট্যদলের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রদত্ত এই বক্তৃতা পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত রূপে প্রকাশ করা হচ্ছে। আলোচনার বিষয় ছিল ‘আলো-অন্ধকারে আমাদের সময় – কী করণীয়, কী স্মরণীয়’। আজ প্রথম অংশ।

উপস্থিত সকলকে নমস্কার, হাতিবাগান সঙ্ঘারামকে জন্মোৎসবের শুভেচ্ছা। আজকাল ভাল কাজ করতে চায় এমন কোনো সঙ্ঘের সন্ধান পেলে ভারি আরাম হয়। আপনারা আরও অনেকদিন আমাদের মনের আরাম, প্রাণের আরাম দিন, সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণাও দিন – এই কামনা করি।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আমার কাছে যখন আজকের আলোচনায় অংশগ্রহণ করার প্রস্তাবটা এল, আলোচনার বিষয়টা শুনেই আমার যা মনে পড়ল সেটা বলি। করোনা অতিমারির শুরুর দিক পর্যন্ত আমি একটা খবরের কাগজে সম্পাদনার চাকরি করতাম। ওই চাকরিতে যেমন হয়, অফিস থেকে বেরোতাম মাঝরাত্তির নাগাদ; অফিসের গাড়ি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসত। আমরা রোজ বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের সামনে দিয়ে যেতাম। স্টেডিয়াম সমেত বাইপাসের অনেকটা জায়গায় অত রাতেও আলো চুঁইয়ে পড়ত। ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময়ে বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন নাটকটা প্রথম পড়ি। ওই নাটকের একটা দৃশ্য আমাদের পাঠ্য ছিল। সেই দৃশ্যে একটা বিয়েবাড়ির বর্ণনা আছে। লেখা হয়েছে, সেখানে আলো চুঁইয়ে পড়ছে। যে মাস্টারমশাই পড়িয়েছিলেন, তিনি খুব যত্ন করে আমাদের বুঝিয়েছিলেন যে কোনো জিনিস চুঁইয়ে পড়ে তখনই, যখন তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়ে যায়। তা ২০১৭ সালে যখন ভারতে অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল বিশ্বকাপের আসর বসেছিল, তখন থেকেই ওই এলাকা চুঁইয়ে পড়া আলোয় ভেসে যাচ্ছে। এখন মহাবিশ্ব তো নিত্যতার সূত্র মেনে চলে, যাকে ইংরেজিতে বলে ল অফ কনজারভেশন। তার মানে পৃথিবীর যেখানেই আলো চুঁইয়ে পড়ে, বুঝতে হবে সেখানেই অন্য কোনো জায়গার আলো এনে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। সেই জায়গাটাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে অন্ধকারে। আপনার চারপাশে তাকান, দেখবেন এরকম চুঁইয়ে পড়া আলোর জায়গা ২০-২৫ বছর ধরে ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। আর আমরা এই আলোর বৃত্তেই থাকি বলে খেয়াল করি না, যে অন্ধকার এলাকাগুলোও বাড়ছে আলোর গতিতে।

সেই কারণেই আমাদের সময়ের আলো, অন্ধকার নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন বোধ হচ্ছে। নইলে, শুধু আমাদের সময় কেন, যে কোনো সময়েই তো আলো আর অন্ধকার দুটোই থাকে। কিন্তু আমাদের সময়ে অন্ধকারের গভীরতা আর ব্যাপ্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যে অনেক প্রবীণ মানুষেরও অভূতপূর্ব বলে মনে হচ্ছে। এখানে সঞ্জয়দা (সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়) আছেন। পশ্চিমবঙ্গ ১৯৬০, ৭০-এর দশকে যে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে গেছে তাকে ওঁর মত করে কজন জানে? সঞ্জয়দা সে নিয়ে লিখলে বা বললে সেই অন্ধকার একেবারে জ্যান্ত মনে হয়। আর নৃসিংহবাবু (নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী) তো বললেনই, আলো আর অন্ধকার সৃষ্টির সমবয়সী। সুতরাং ইতিহাসে এমন কোনো যুগ ছিল না যা সম্পূর্ণ অন্ধকারমুক্ত। কিন্তু পরিমাণগত এবং গুণগত তফাত ঘটে। বিরাট তফাত। আমাদের সময়ের আলোচনায় যাওয়ার আগে এই কথাগুলো বলে নিতে হল, কারণ জীবনানন্দ দাশের ছিল একজন বনলতা সেন, আর আমরা হলাম অভ্যাসের দাস। আমাদের আছে হাজার হাজার বনলতা সেন। আপনি বর্তমানের কোনো অন্ধকারের দিকে আঙুল দেখালেই তাঁরা জম্বিদের মত দলে দলে তেড়ে আসবেন, বলবেন “এখন প্রতিবাদ করছেন? এতদিন কোথায় ছিলেন?”

মাঠে যেমন বাউন্ডারি না থাকলে খেলা যায় না, তেমনি আলোচনারও সীমা ঠিক করে না নিলে আলোচনা করা যায় না। আমি যেহেতু সাংবাদিকতা করি, তাই মূলত সাংবাদিকতার অন্ধকার নিয়েই আলোচনা করব, প্রসঙ্গক্রমে অন্য অন্ধকারের কথা এসে পড়বে।

আমি যদি আপনাদের জিজ্ঞেস করি, সাংবাদিক শব্দটা শুনলেই প্রথমে কার নাম মনে আসে? কোনো সন্দেহ নেই, অনেকেই বলবেন অর্ণব গোস্বামী। সকলেই যে লোকটাকে পছন্দ করেন বলে বলবেন তা নয়, যাঁরা অপছন্দ করেন তাঁদেরও প্রথমে ওই নামটাই মনে আসবে। লোকটি অন্ধকার এতটাই ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। কেউ কেউ হয়ত একেবারে বিপরীত মেরুর রবীশ কুমারের নাম করবেন। এছাড়া সুমন দে, মৌপিয়া নন্দী, অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি নামও উঠে আসতে পারে। পুরনো লোকেরা বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, বরুণ সেনগুপ্ত, গৌরকিশোর ঘোষ, কুলদীপ নায়ার, সি আর ইরানি ইত্যাদি নাম বলবেন। কিন্তু আজকে আমি আপনাদের সামনে একেবারে অন্য কতকগুলো নাম বলব। আজকের ভারতবর্ষে আসল সাংবাদিকতা এঁরাই করছেন। সৈনিকরা নিজের জীবন বাজি রেখে লড়েন, এই সাংবাদিকরা নিজের সর্বস্ব বাজি রেখে খবর তুলে আনছেন।

আরো পড়ুন রাজদীপের দ্বীপান্তর: নিরপেক্ষতার পুরস্কার?

প্রথম নামটা পবন জয়সোয়াল। উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুরের এই সাংবাদিক ২০১৯ সালে জনসন্দেশ টাইমস বলে একটা স্থানীয় কাগজে খবর করেন, যে একটা স্কুলে মি ডে মিলে স্রেফ রুটি আর নুন দেওয়া হচ্ছে। সে খবর ক্রমশ সারা দেশে হইচই ফেলে দেয়, যোগী সরকারের মুখ পোড়ে। উত্তরপ্রদেশ পুলিস তাঁর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক চক্রান্ত, কর্মরত সরকারি কর্মচারীর কাজে বাধা দেওয়া আর প্রতারণা – এই তিনটে অভিযোগে এফ আই আর দায়ের করে। যথারীতি শেষ অব্দি একটা অভিযোগও প্রমাণ করে উঠতে পারেনি। পবন ক্যান্সারে ভুগছিলেন, চিকিৎসা করার মত যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। গত ১১ এপ্রিল তিনি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ, বিরোধী নেতা অখিলেশ যাদব আর কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে ট্যাগ করে অর্থসাহায্য চেয়ে টুইট করেন। নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত তথ্যও দিয়ে দেন। ওঁরা কতটা সাহায্য করেছিলেন জানি না, কোনো কোনো সাধারণ মানুষ করেছিলেন। পবন গত ৫ মে মারা গেছেন।

দ্বিতীয় নাম যোগেন্দ্র সিং। তিনি কোনো স্থানীয় কাগজেও কাজ করতেন না, তাঁর ছিল ‘শাহজাহানপুর সমাচার’ নামে একটা ফেসবুক পেজ। ২০১৫ সালের ৩০ মে সেই পেজে তৎকালীন উত্তরপ্রদেশ সরকারের মন্ত্রী, সমাজবাদী পার্টির রামমূর্তি বর্মা এক অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে ধর্ষণ করেছেন এবং জোর করে জমি দখল করেছেন – এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয়। আপনাদের মধ্যে যারা সোশাল মিডিয়ায় খুব সক্রিয়, তাদের মনে পড়তে পারে একটা ভাইরাল ছবি – শরীরের বেশিরভাগটা পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া একটা মানুষ বুকে হেঁটে এগোবার চেষ্টা করছে। সেই মানুষটাই যোগেন্দ্র। কিছু মানবাধিকার সংগঠন ঘটনাটা নিয়ে চেঁচামেচি না করলে পুড়ে মরেও যোগেন্দ্রর ভাইরাল হওয়া হত না। মন্ত্রীমশাই আর কয়েকজন পুলিসকর্মীই যে যোগেন্দ্রকে জীবন্ত দাহ করেছেন সেটাও চাপা পড়ে যেত।

তৃতীয় নাম সিদ্দিক কাপ্পান। এই সাংবাদিক কয়েক বছর হয়ে গেল উত্তরপ্রদেশে হাজতবাস করছেন এমন এক প্রতিবেদনের জন্য, যা তিনি লিখতে পারতেন বলে উত্তরপ্রদেশ সরকারের ধারণা। এতদিন হয়ে গেল তাঁকে জামিন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। কাশ্মীরওয়ালা কাগজের সম্পাদক ফাহাদ শাহ আর ফ্রিলান্স সাংবাদিক সাজ্জাদ গুলের হাজতবাসও বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল। তবে কাশ্মীরের কথায় যাব না, কারণ ওখানকার সাংবাদিকদের উপর নির্যাতনের যত বড় তালিকাই তৈরি করি না কেন, সেটা অসম্পূর্ণ তালিকা হবে। বরং মধ্যপ্রদেশের কথা বলি।

সিধি জেলার সাংবাদিক কণিষ্ক তিওয়ারি। তিনি গিয়েছিলেন নাট্যশিল্পী নীরজ কুন্দেরের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানার বাইরে যে প্রতিবাদ কর্মসূচি চলছিল তা কভার করতে। পুলিস তাঁকে এবং কয়েকজন প্রতিবাদী থিয়েটার কর্মীকে থানার ভিতর টেনে নিয়ে যায়, ১৮ ঘন্টা মত লকআপে আটকে রাখে। তাঁর অভিযোগ, মারধরও করা হয় এবং জামাকাপড় খুলে ফেলতে বাধ্য করা হয়। শেষের অভিযোগটা যে মিথ্যে নয় তা আপনারা অনেকেই নিশ্চয়ই জানেন, কারণ শুধু অন্তর্বাস পরিহিত বন্দীরা জড়সড় হয়ে এক পুলিস অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, এ ছবিও ভাইরাল হয়েছিল।

একটা নামও পশ্চিমবঙ্গের নয় দেখে নিশ্চয়ই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন? ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৫০ নম্বরে নেমে যাওয়া এই দেশে আমাদের রাজ্যটাকে আমাদের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মত মরুদ্যান আখ্যা দেবেন ভাবছেন কি? তাহলে আরেকটা নাম বলি। বিপ্লব মন্ডল। ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজগুলো খুঁজে দেখুন। অধিকাংশ কাগজের প্রথম পাতায় পাবেন এঁর কথা। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার প্রক্রিয়াকে আঁতুড়েই মুখে ধান পুরে মেরে ফেলার যে চেষ্টা চলছিল সেদিন, তার ছবি তুলে ফেলার অপরাধে রাজনৈতিক গুন্ডারা চিত্রসাংবাদিক বিপ্লবকে মারধোর করে, জামাকাপড় খুলে নেয়, সে ছবি মোবাইলে তোলা হয় এবং হুমকি দেওয়া হয় “ভাইরাল করে দেব কিন্তু।” সৈনিকদের মত ‘জীবন’ বাজি রেখে কাজ করছেন না বলে কেন ‘সর্বস্ব’ বাজি রেখে বললাম বোঝা গেল তো?

এটা কিন্তু এক দিকের অন্ধকার। শুধু এই দিকে অন্ধকার থাকলে উল্টো দিকে আলো দেখা যেত। কিন্তু উল্টো দিকটা কীরকম? বিপ্লবের কথা অধিকাংশ কাগজে বেরিয়েছিল বলেছি, সব কাগজে বলিনি কিন্তু। যে কাগজগুলোতে বেরোয়নি, তার মধ্যে একটা হল সেই কাগজ, যাদের হয়ে উনি সেদিন ছবি তুলতে গিয়েছিলেন। এটাই আজকের সাংবাদিকতার বাস্তবতা। আমি যখন সাংবাদিকতায় আসি ২০০৫ সালে, তখন একেই পড়তে পড়তে চাকরি পেয়ে গেছি বলে ধরাকে সরা জ্ঞান করতাম। তার উপর সিনিয়ররা একেকজনকে দেখিয়ে বলতেন “ওই যে অমুকদাকে দেখছিস? ও কর্পোরেশনে ঢুকলে মেয়র পর্যন্ত থরথর করে কাঁপে। কখন কী খবর করে দেবে, মেয়রের চেয়ার নিয়েই টানাটানি পড়ে যাবে।” “তমুক দিদিকে দ্যাখ। পুলিস কমিশনারও ওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমতা করে।” আমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম, ওঁদের মত হতে হবে।

ওই সাংবাদিকদের কি রাবণের মত দশটা মাথা ছিল, নাকি দুটো করে অতিরিক্ত হাত-পা জামাপ্যান্টের ভিতর লুকনো থাকত? তা তো নয়। তাহলে সরকার, সরকারি দল, পুলিস, প্রশাসন, বিরোধী দল – সকলকে চটানোর মত খবর করার সাহস পেতেন কী করে? পেতেন, কারণ জানতেন আমার কাগজ আমার পিছনে আছে। আমার নামে যদি মামলা হয়, কাগজের উকিল বুঝে নেবে। আমাকে যদি গ্রেপ্তার করা হয়, আমার সম্পাদক জামিনের ব্যবস্থা করবেন, পরদিন কাগজে বিরাট করে খবর বেরোবে যে সরকার সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করছে। আর রাজনৈতিক গুন্ডারা যদি পেটায়, মিডিয়ার গাড়ি যদি ভাঙচুর হয়, তাহলে শুধু তাঁর কাগজ বা চ্যানেল নয়, গোটা সংবাদমাধ্যম সরকারের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগবে। শুধু পশ্চিমবঙ্গের কথা বলছি না, সারা দেশেই এরকম হত। আর এখন? সরকারের বিরুদ্ধে বা কোনো ক্ষমতাশালী, পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে খবর করতে গেলে প্রথমে আপনি আপনার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলবে “চেপে যা বাপু। কী দরকার?” যদি এমন হয় যে আপনার বসটির মেরুদণ্ড এখনো সোজা, তাহলে খবরটা হয়ত হয়ে গেল, কিন্তু পরদিন আপনি আর আপনার বস – দুজনের চাকরি নিয়েই টানাটানি হবে। এভাবে অসংখ্য ভাল সাংবাদিকের চাকরি গেছে গত এক দশকে। সারা দেশেই গেছে। প্রতিদিন যে আরও কত সরকারবিরোধী খবর এবং টাকার কুমিরদের কুকীর্তির খবর বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে বা লঘু করে ফেলা হচ্ছে ভারতবর্ষের নিউজরুমগুলোতে, তার হিসাব করার চেয়ে মাথার চুল গোনা সহজ।

কাদের অঙ্গুলিহেলনে হচ্ছে এরকম? কাগজ এবং চ্যানেলের মালিকদের। কেন তাঁরা এরকম হয়ে গেছেন গত এক দশকে? সবচেয়ে বড় কারণ – বিজ্ঞাপন।

সংবাদমাধ্যম বলতে কাদের বোঝায়? স্বাধীনতার পর থেকে ভারত যে আধা-সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নিয়ে চলছিল, তাতে যে দু-একটা শিল্পক্ষেত্রে সরকারি অংশগ্রহণ নগণ্য ছিল তার একটা হল মিডিয়া। গত সহস্রাব্দের প্রায় গোটাটাই মিডিয়া বলতে মোটের উপর প্রিন্ট মিডিয়াকেই বোঝাত, কারণ তার আগে অব্দি তো টিভির খবর মানে কেবল দূরদর্শনের বুলেটিন। কেবল টিভি তো ঘরে ঘরে থাকত না, কারণ সেটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ ছিল। তা তখনকার খবরের কাগজগুলো ১৯৯১ সালের অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর থেকে আমাদের কী বুঝিয়েছে? না, ভর্তুকি খুব খারাপ জিনিস। কোনোকিছুতে ভর্তুকি দেওয়া সরকারের উচিত নয়। সবকিছু খোলা বাজারে ছেড়ে দেওয়া উচিত, সেখান থেকে যার যা কেনার সামর্থ আছে সে সেটা কিনবে, যার সামর্থ নেই সে কিনবে না। অথচ এই যে তিরিশ বছর হয়ে গেল উদারীকরণের, সমস্ত সময়টা জুড়ে খবরের কাগজগুলো কিন্তু নিউজপ্রিন্ট কেনার সময়ে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পেয়ে এসেছে। মানে আপনি সকালবেলা আপনার বাড়ির কাগজটায় ভর্তুকির বিরুদ্ধে একশো যুক্তি পড়ে পাড়ার চায়ের দোকানে গিয়ে জমিয়ে তর্ক করে এসেছেন, কাগজের মাধ্যমে জনমত তৈরি হয়েছে, সরকার সেই জনমত শিরোধার্য করে ধীরে ধীরে সবেতেই ভর্তুকি কমিয়ে গেছে। কমাতে কমাতে ২০২২ সালে এসে আপনার রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম হয়ে গেছে হাজার টাকা। এদিকে আপনার কাগজের মালিক কিন্তু সরকারকে একবারও বলেনি, যে আমার নিউজপ্রিন্ট কিনতে ভর্তুকি লাগবে না। শুধু তা-ই নয়, সমস্ত সংবাদমাধ্যম গাছেরও খেয়েছে, তলারও কুড়িয়েছে। মানে কাগজ কেনার সময়ে একবার ভর্তুকি পেল, আবার সেই কাগজে খবর ছেপে যখন বার করবে তখন সরকারি বিজ্ঞাপনও পেল। তাহলে ডাবল সাবসিডি হল? এখানেও শেষ নয়। এর উপর আবার বেসরকারি বিজ্ঞাপন ছেপেছে। এখন তো বিজ্ঞাপন এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যে আপনি কাগজের প্রথম পাতা খুঁজে পাবেন না। যাঁরা খুব ভোরে ওঠেন তাঁরা শুরুর বিজ্ঞাপনের পাতাগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে ঘুমিয়েও পড়তে পারেন।

টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। তারাও অনেক টাকার সরকারি বিজ্ঞাপন পায়, সঙ্গে বেসরকারি বিজ্ঞাপনও চলে। সেটা মেনে নেওয়া যেত, যদি এরা দর্শকদের থেকে টাকা না নিত। ডিটিএইচ যুগের আগে যেমন চ্যানেলগুলো আপনার থেকে টাকা নিতে পারত না। তাহলে আয় করবে কোথা থেকে? সুতরাং বিজ্ঞাপন দরকার ছিল। আমি কূপমণ্ডূক, কিন্তু যাঁরা বিভিন্ন দেশে গেছেন তাঁরা জানেন, সাবস্ক্রিপশন মডেলে টিভি চললে কিন্তু এত বিজ্ঞাপন থাকে না। আমাদের এখানে তো এখন অনুষ্ঠানের মাঝে বা খবরের মাঝে বিজ্ঞাপন হয় না, বিজ্ঞাপনের মাঝে একটুখানি খবর হয়। ক্রিকেট খেলা দেখতে বসলে দেখবেন কোনো কোনো ওভারের একটা-দুটো বল হয়ে যাওয়ার পর বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়। আসলে চ্যানেল মালিক আর বড় কাগজের মালিকদের লোভের কোনো শেষ নেই। “এ জগতে হায় সে-ই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি।”

এই হল বড় কাগজ, বড় মিডিয়ার কাণ্ড। আর ছোট কাগজগুলোকে এই সরকারি বিজ্ঞাপনের জুজু দেখিয়েই যে যেখানে ক্ষমতাসীন সে সেখানে পকেটে পুরে রেখেছে। কারণ কাগজের ব্যবসায় একটা মৌলিক স্ববিরোধ আছে। আপনারা অনেকেই নিশ্চয়ই জানেন, যে কাগজটা আপনি পাঁচ টাকা দিয়ে কেনেন সেটা তৈরি করতে খরচ হয় ১০-১৫ টাকা। এটা অতিমারীর আগের হিসাব বললাম, এখন হয়ত আরও বেশি। তা এই খরচ পুষিয়ে তারপর লাভ করতে গেলে ছোট কাগজগুলোর পক্ষে সরকারি বিজ্ঞাপন বাদ দিয়ে চলা অসম্ভব। বড় কাগজ বলতে কী বোঝাচ্ছি? পাঁচ লক্ষের বেশি বিক্রি হয় যে কাগজগুলো। আর ছোট কাগজ মানে যারা মেরে কেটে এক-দু লক্ষ। পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে বড় কাগজ একটা কি দুটো। সেই কাগজগুলো এত বেসরকারি বিজ্ঞাপন পায়, যে ওই যে বললাম – প্রথম পাতা খুঁজতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন। ছোট কাগজ কিন্তু ওসব বিজ্ঞাপন পায় না সাধারণত। কেন পায় না? কারণ সেগুলো কম লোকের হাতে যায়। যিনি বিজ্ঞাপনদাতা, তিনি তো যত বেশি সম্ভব লোকের কাছে পৌঁছতে চান। ফলে যে কাগজের বিক্রি বেশি সেই কাগজই বেশি বিজ্ঞাপন পায়। মানে তেলা মাথাতেই তেল পড়ে। সরকারি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে কিন্তু নিয়মটা আলাদা। আপনার কাগজের বিক্রি যা-ই হোক, যদি নামটা ডিএভিপি (মানে ডিরেক্টোরেট অফ অ্যাডভার্টাইজিং অ্যান্ড ভিজুয়াল পাবলিসিটি)-র খাতায় থাকে, তাহলেই সরকার আপনাকে বিজ্ঞাপন দেবে। সরকার এই নিয়মটাকেই ব্যবহার করে। অমুক প্রতিবেদনে আমার দুর্নীতি দেখিয়েছ? যাও, তোমাকে বিজ্ঞাপন দেব না। তমুক সিদ্ধান্তের নিন্দে করেছ? আজ থেকে তোমার বিজ্ঞাপন বন্ধ।

পরবর্তী অংশ >>

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

2 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.