ইনি বলছেন ৭৯টা ছায়া প্রকাশনীর মডেল, উনি বললেন ১০০ শতাংশ পাশ যে, সকলেই কি বিদ্যাসাগর? ইনি বললেন বন্যাত্রাণের মত নম্বর, তো উনি চশমা চোখে, ভারী বিজ্ঞ মুখে এবং স্বর নামিয়ে: ‘এর ফলে শিক্ষায় মানের অবনমন ঘটবে’। সোজা কথা: এ বারের মাধ্যমিক রেজাল্ট প্রকাশিত হতেই বাঙালির পেটে দস্তুরমত খিল, কোথাও ঈষৎ ভ্রূ-কুঞ্চন, ‘মেধার সঙ্গে আপস হল যে’-মর্মে ঈষৎ বিশ্রম্ভালাপ, আর নেটে পরীক্ষার্থীদের অবিরল সইতে হল গঞ্জনা, লাঞ্ছনা, এবং কিছু আমুদে কাতুকুতু।

বিষয়টা বিস্ময়কর নয়, কেন না বাঙালি একটি বর্ণবাদী জাতি। তফাতের মধ্যে হল এই যে, উত্তর ভারতে যেখানে পদবি দেখে কিংবা পেশা দেখে ছায়া না-মাড়ানোর চল, বাঙালি সেখানে খোঁজে নম্বর, যদিও মুখে বলে ‘মেধা’। সকলেই জানে যে মাধ্যমিকের নম্বরে বাকি জীবনে এসে যায় বস্তুত ঘণ্টা, কিন্তু বেচারা বাঙালির কাছে ওটি সর্বরোগহর কৌলীন্যমাপক। এ বারের দুর্যোগপূর্ণ মহামারী-তাড়িত পরিস্থিতি সেই বর্ণবাদী ঘা-দগদগে উৎসমুখ হাট করে খুলে দিয়েছে। কারুর অত ভাবার সময় নেই যে কী পরিস্থিতিতে এই মূল্যায়ন হল, এবং এত কাল সরকারি নীতিটিতি নিয়েও কাউকে বিশেষ মাথা ঘামাতে দেখা যায় নি। কিন্তু আজ যখন রেজাল্ট বেরোল, তার গায়ে লেগেছে ভীষণ, যার মোদ্দা জায়গাটা অসূয়ার। মাধ্যমিক-উত্তর, বহু বছর ধরেই শিক্ষার সাংঘাতিক অবনমন-বিষয়ক বাৎসরিক চিলচিৎকার চলে, যার আপ্তবাক্য: অমুকে বাঁকুড়ার ছেলে হয়েও ফার্স্ট হতে পারে? ইদানীং সেই অনুযোগ গা-সওয়া হয়ে আসছিল। এ বারের সদ্যোজাত, নবতম ধামাকা: ৭৯ জন প্রথম, ১০০ শতাংশ পাশ। নেটমাধ্যমে কৌতুকী খিলখিল, হা হা হি হি রব।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

সত্যিই জানি না, ভারতের বাকি রাজ্যগুলিতে যেখানে এমনধারা মূল্যায়ন-পদ্ধতি গৃহীত হল এ বছর, সেখানেও এ রকম সাংঘাতিক দুশ্চিন্তাস্রোত বয়ে গেছে কি। সম্ভবত, যায় নি। কারণ স্বভাবকেরানি (ওই নির্দিষ্ট পেশাটিকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলছি না) বঙ্গপুঙ্গবের, সত্যি সত্যিই, পরীক্ষার নম্বর ছাড়া হারানোর কিছু নেই। তার চার পাশে হা-ধ্বস্ত অবস্থা, মড়কের বিষছোবল, অর্থনীতি যায়-যায়, পঙ্গু ও ভঙ্গুর সমকাল। এ সব তো দু’ দিনের খোকা, এমনিও, বাঙালির কলার ঝাঁকানোর মত খুচরো কিছুই নেই সাম্প্রতিকে– এতটাই জঙ্গম ও জড়দ্গব জাতিতে পর্যবসিত সে। চরাচরব্যাপী এত অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনার ভেতর, বিধাতার অনিঃশেষ করুণায় তার জীবনে এসেছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্টারনেট। সে ঘুম থেকে ওঠে গুড মর্নিং-সহ গোলাপফুল বিতরণ করে, সন্ধ্যায় পাঠায় আশ্চর্য সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত ও মধ্যাহ্নভোজের পর পাঠায় মাধ্যমিক-বিষয়ক কমিক রিলিফ। কারণ বাঙালি সাংঘাতিক বর্ণবাদী। পরীক্ষার নম্বরে তার যায়-আসে।

খেয়াল করে দেখবেন, চিন্তাশীল বিদ্দ্বজ্জন যাঁরা আজ হঠাৎ মুখ খুলছেন, তাঁদের রকমসকম দেখে মনে হচ্ছে, বিদগ্ধ বামুনের হাত থেকে গোটা সমাজটা বেরিয়ে গেছে, এসেছে এমন ঘোর কলি যেখানে হাভাতে কিছু ছোটলোক প্রাপ্যের চাইতেও বেশি হাসিল করে নিচ্ছে– যাদের হয়তো এমনিতে তলানির শুদ্দুর হিসেবে থাকার কথা ছিল, সে পাচ্ছে একশোয় পঁচানব্বই। এই যে গলগল করে টিপ্পনী, আলগা খোঁচা, কিংবা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কনসার্ন উথলে উথলে উঠছে, তা সবই ধাতে ব্রাহ্মণ্যবাদী অনুযোগ। সকলেই জানে যে ওই মাধ্যমিকের নম্বর ধুয়ে গাধাও জল খাবে না, কিন্তু ওইটেই তো টুলো বাঙালি পাঁড়-পণ্ডিতের শেষ ফ্রন্টিয়ার। বচনবাগীশ ও ইউটিউব-সিদ্ধ তরুণ সিপিএম নেতা এত সহজে পরীক্ষার্থীদের ব্যঙ্গ করে ঘণ্টাপিছু দেড় হাজার লাইক আদায় করে নিতে পারেন, কারণ উনিও ওই বৃহত্তর ব্রাহ্মণ্যবাদী সলিডারিটির অংশবিশেষ। দিকে দিকে, ‘শিক্ষাবিদ’ তকমার চোগা-চাপকান পরে যাঁরা বিতরণ করছেন বাণী, গম্ভীর মুখ করে ক্ষয়ক্ষতির হিসেব বিলোচ্ছেন, তাঁরাও বস্তুত ব্রাহ্মণগোত্রীয়, যে ঠিক করে দেবে মেধার আদত ঠিকেদার কে।

তা হলে কি এই রেজাল্টে কিছু যাবে-আসবে না? অবশ্যই আসবে। এই দুরপনেয় ক্ষত, পরীক্ষা-অন্তে দুঃসহ ট্রোল পরীক্ষার্থীদের জীবনব্যাপী ট্রমা হয়ে থেকে যাবে। ঠিক যেমন, ভেবে আশঙ্কিত লাগছে, সমাজে যে ভাবে উত্তরোত্তর বাড়ছে কম্পিটিশন, যাঁরা দু’ চুল কম নম্বর পেলেন, তাঁদের ঠিকানা হবে কোন গাড্ডায়? সমাজটা এতটাই উল্লম্ব, এতটাই বিষম ও খাড়াখাড়ি যে, নম্বরের সামান্য চুল-পরিমাণ হেরফের সাংঘাতিক অনিশ্চিতের সামনে ফেলে দেবে এই পড়ুয়াদের। আমি জানি না, সেখান থেকে তাঁরা কী করে উদ্ধার পাবেন। হয়তো পপুলিস্ট সরকারের এ-ই এক সমস্যা, সে কোনও দীর্ঘমেয়াদি এবং স্ট্রাকচারাল উপকার করতে পারে না– কেবল, ঘায়ের ওপর বিক্ষিপ্ত কিছু মলম লাগায়। বাঙালি অবশ্য পাবলিক পলিসির নিন্দেমন্দ করতে ভুলে গেছে। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের নিয়ে মিম শেয়ার করাটা অপেক্ষাকৃত সহজ, কারণ ওতে সরকার-প্রণোদিত পাবলিক পলিসি নিয়ে টুঁ শব্দ করার পরিশ্রম বইতে হয় না।

কিন্তু সমালোচনার জায়গাটা আরও মৌলিক ও মোদ্দা। উবেরমেনশ হতে-চাওয়া বর্ণকুলীন, ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ বাঙালি চির কালই ন্যায় নয়, বরং বৈষম্যে বিমলানন্দ পায়। যেমন ধরুন, স্কুলগুলিতে অনলাইন ক্লাস চলছে বিগত দেড় বছরকাল। নেহাতই নামকাওয়াস্তে। কাউকে চার পাশে বলতে শুনছি না, এই ব্যবস্থাটার কোনও বিকল্প প্রয়োজন। একটিও সংগঠন, একটিও রাজনৈতিক দল এই সর্বনেশে ও উৎকট ফরমানের বিরুদ্ধে দৃশ্যগ্রাহ্য কোনও প্রতিবাদ জানাতে পারে নি। জনমত সংগ্রহের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। ইতিউতি কিছু সার্ভে হয়েছে টুকটাক। যে ছাত্রছাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের কোনও ওরাল আর্কাইভ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। খবরের কাগজেও, বিক্ষিপ্ত কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, অনলাইন ক্লাসের মত এ-হেন নিঃশব্দ বিপ্লব পাদপ্রদীপের আলোয় আসে নি। সিস্টেম শুরু হওয়ার তিন-চার মাসের মধ্যে গোটা দেশে অন্তত কুড়ি জন পড়ুয়া আত্মহত্যা করেছেন, তাই নিয়েও বিশেষ হইচই হয় নি। আসলে আমাদের রক্ত শীতল, চামড়া মোটা ও গা-গতর ঠাণ্ডা, বস্তুত আমরা সকলেই সেঁধিয়ে রয়েছি অনিঃশেষ গর্তে। আজকের আনন্দবাজারের কলকাতা সংস্করণেই রয়েছে বিমানবন্দরের কাছে একটি ক্লাস ফোরের শিশুর ড্রপ-আউট হয়ে টফি বিক্রি করার মর্মন্তুদ উপাখ্যান। না, এই বিষয়ক কোনও হোয়াটসঅ্যাপ ভাইরাল হবে না। কোনও সরকারের চোখেও পড়বে না বিশেষ। কোনও কূপমণ্ডুক বামপন্থী নেতা অথবা স্ব-বিশেষিত পাণিনিপ্রতিম বিদ্দ্বজ্জন এই নিয়ে কথা বলবেন না। কেন-না আমরা সকলেই বর্ণবাদী। এত ড্রপ আউট, শিক্ষার এই সাংঘাতিক বৈষম্য আমাদের বর্ণচৈতন্যের সঙ্গে চমৎকার সঙ্গতিপূর্ণ। ঈষৎ সংবেদী যাঁরা, তাঁদের মনখারাপ হবে বড়জোর। বাকিরা স্নিগ্ধ ই-আবহে ভাসতে ভাসতে চুটকি ফরওয়ার্ড করবেন। এবং, অবরে-সবরে, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী দেখলে যথাসম্ভব ইট, পাথর এবং গালি।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

2 মন্তব্য

  1. এটা বাস্তব সত্য। এ সমাজ কক্ষনো প্রশ্ন করবে না কি শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরী করলাম যে MA পাশ করেও আমি চাকরি পাই না। আমাকে আবার টুইশান নিতে হবে লোন নিয়ে ইন্টারভিউ পাশ করতে। প্রশ্ন করবে না কি এই assessments যা pen and paper ছাড়া হয় না। কেন সারা পৃথিবীর মতো সেমিস্টার ও অনলাইন assessments প্রথায় grade দেয়া হয় না। প্রশ্ন করবে না কেন প্রফেসর এর notes এর কৌলিন্য প্রথায় বছরের পর বছর ধরে সতীদাহ হয়। কেননা এ সমাজ বিবেকহীন।

  2. আজকের দুর্দিনে বাচ্চাদের ওপর এইধরনের আক্রমণ সহ্য করা যায় না আর নিন্দা করাই যথেষ্ট না। আমাদের দেশে শিক্ষার ব্যাপারটা অনেক আগে থেকেই প্রশ্নময়। করোনাকালের আগেও যা চলছিল সে নিয়ে কম আপত্তি নেই। শিক্ষাভাবনা কিছু লিখবে?

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.