নকুল সিং সাহনি

প্রিয়জন,

গত কয়েক দিনে সোশাল মিডিয়ায় অনেক পোস্ট দেখলাম যেখানে মানুষ রাকেশ টিকায়তকে ঘিরে এত উদ্দীপনা পছন্দ করছেন না, অনেকে রেগেও যাচ্ছেন। এই রাগের বেশিরভাগটাই ২০১৩ সালে মুজফফরনগর আর শামলি জেলায় যে সাম্প্রদায়িক হিংসা হয়েছিল, তাতে বিকেইউ-এর দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকার কারণে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের সেই সর্বগ্রাসী উন্মাদনার পর সাড়ে সাত বছর কেটে গেছে। আমরা বিকেইউ-কে ভাঙতে দেখেছি এবং একগুচ্ছ নতুন গোষ্ঠী তৈরি হতে দেখেছি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভাঙনটা ছিল গুলাম মহম্মদ জৌলার বেরিয়ে যাওয়া। উনি বিকেইউ-এর সবচেয়ে বড় মুসলমান নেতা ছিলেন এবং ওঁকে প্রয়াত বাবা টিকায়তের ডান হাত বলে মনে করা হত।

মজার কথা, অজিত সিং আর জয়ন্ত চৌধুরী ২০১৪-র নির্বাচনের নিজের নিজের কেন্দ্র থেকে হেরে যেতেই ঐ অঞ্চলের অনেক প্রবীণ জাঠ ভেঙে পড়েন। অনেকে কাঁদতে কাঁদতে বলেন “হামনে চৌধরী সাব কো হারা দিয়া” (আমরা চৌধুরীবাবুকে হারিয়ে দিলাম)। অনেক জাঠ (বিশেষ করে বয়স্করা) এমনিতেই তরুণ প্রজন্মের উপর ২০১৩-র হিংসায় যোগ দেওয়ার জন্য রুষ্ট ছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে প্রায়ই বলতেন “আশা করি বেশি দেরি হওয়ার আগেই আমাদের জোয়ানরা বুঝতে পারবে কী ভুল করেছে।”

এ কথা বলছি না যে বয়স্ক জাঠরা ঐ হিংসায় যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু বিকেইউ এবং আরএলডি-র সেরা সময় দেখেছেন যাঁরা, তাঁরা ঐ পাগলামির ক্ষতিটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁরা বুঝেছিলেন যে ঐ অঞ্চলের মুসলমানরা তাঁদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ (ওখানকার মুসলমানদের মধ্যেও আবার কাস্ট নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। কিন্তু সেটা অন্য আলোচনার বিষয়)।

আরো অনেকের সাথে মিলে বিপিন সিং বালিয়ানের মত কিছু স্থানীয় জাঠ নেতা হিন্দু-মুসলমান বিভাজন মেরামত করার চেষ্টা করেন। এই প্রয়াস প্রশংসনীয়, কিন্তু পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ ইতিমধ্যেই ঘৃণা এবং তিক্ততার সাগর হয়ে বসেছিল। সেই সাগরে এগুলো একটা ছোট্ট জলের ফোঁটার বেশি কিছু নয়।

দাঙ্গার প্রায় পাঁচ বছর পরে প্রথম হিন্দু-মুসলমানের যৌথ কিষাণ পঞ্চায়েত হয়। সেগুলোতে নেতৃত্ব দেন ঠাকুর পূরণ সিং, গোলাম মহম্মদ জৌলা প্রমুখ।

শেষমেশ ২০১৯ নির্বাচনের ঠিক আগে রাকেশ টিকায়তের নেতৃত্বে একটা বিশাল মিছিল দিল্লী যায় ১০ দফা দাবি নিয়ে। হিন্দু, মুসলমান — দুই সম্প্রদায়ের কৃষকই সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। দিল্লী অবরুদ্ধ হয়। আরো অনেক ইউনিয়ন সেই আন্দোলনকে সমর্থন করে। কিন্তু সবকটা দাবি মেনে না নেওয়া সত্ত্বেও সেই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অনেকেই অসন্তুষ্ট হয়, অনেকের ধারণা হয় বিজেপি রাকেশকে কিনে নিয়েছে।

২০১৯-এর পরে মুজফফরনগর আর শামলিতে বিকেইউ-এর নেতৃত্বে বহু প্রতিবাদ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এগুলোতে মুসলমান কৃষকদের উপস্থিতি। এঁদের অনেকেই আবার বিকেইউ-এর পদাধিকারী। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, রাকেশ টিকায়ত বিকেইউ-কে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন। নরেশ টিকায়ত স্পষ্টতই কোণঠাসা।

এমনকি ২০১৩-র মহাপঞ্চায়েত, যেখানে বিজেপি বিকেইউ-এর মঞ্চটা পুরোপুরি দখল করে নিয়েছিল, সেখানে নরেশকেই বিজেপি নেতাদের সাথে মঞ্চে দেখা গিয়েছিল। তিনি ২০১৩-র হিংসার পরেও উস্কানিমূলক বিবৃতি দিয়ে গেছেন। গত ২-৩ বছরে মনে হচ্ছে রাকেশ ইউনিয়নের লাগাম ধরে নিয়েছেন এবং নরেশকে কোণঠাসা করে দিয়েছেন। কারণ নরেশ আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। এটা দুই ভাইয়ের আদর্শগত সংঘাত নাকি কৌশল, তা অবশ্য তাঁরাই জানেন।

যখন কৃষি আইন বিরোধী প্রতিবাদীরা দিল্লীর সীমান্তে পৌঁছলেন, সবার নজর গাজিপুর সীমান্তেও ছিল। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষি আন্দোলন চিরকাল তার তীব্রতা এবং উদ্যমের জন্য প্রসিদ্ধ। অথচ সেখান থেকে সেরকম সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না কেন? সত্যি কথা বলতে বহু কৃষক এই আন্দোলনে যোগ দিতে খুব আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু রাকেশ টিকায়তকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। অনেকেরই সন্দেহ ছিল উনি আসলে বিজেপির এজেন্ট এবং যে কোন মুহূর্তে পালটি খাবেন।

২৭ তারিখ রাতে গাজিপুর সীমান্তে যা হল, তাতে এই ধারণা বদলে গেছে। বিরাট পুলিস বাহিনী প্রতিবাদী কৃষকদের সরিয়ে দিতে গাজিপুর সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। ভিডিও মেসেজে রাকেশ টিকায়তের কান্না এবং আবেগঘন আবেদন পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের জাগিয়ে তুলেছে। সেই মেসেজে তিনি যে যে উল্লেখযোগ্য কথা বলেছেন, তার মধ্যে ছিল একসময় বিজেপিকে সমর্থন করার অপরাধ স্বীকার করে নেওয়া, এবং বলা যে ঐ সিদ্ধান্তের জন্য তিনি চিরকাল আপশোস করবেন। সেই রাতেই কয়েক হাজার লোক মুজফফরনগর জেলার সিসৌলি গ্রামে টিকায়তের বাড়ির বাইরে গিয়ে হাজির হয়। দুদিন পরে, ২৯ জানুয়ারি ২০২১, সিসৌলিতে এক ঐতিহাসিক মহাপঞ্চায়েত বসে। সেখানে কয়েক হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

সেই পঞ্চায়েতের মুখ্য বক্তাদের মধ্যে ছিলে গোলাম মহম্মদ জৌলা। তিনি রেখে ঢেকে কথা বলেননি। জৌলা বলেন “আপনার যে দুটো বিরাট ভুল করেছেন সেগুলো হল এক, অজিত সিংকে হারিয়ে দিয়েছেন; আর দুই, মুসলমানদের খুন করেছেন।” লক্ষণীয়, তাঁকে কেউ আওয়াজ দেয়নি, কেউ চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি। ওখানে তখন পিন পড়লে শব্দ পাওয়া যেত। আত্মসমীক্ষার মুহূর্ত। অন্য বক্তারা বলেন “আমরা আর কখনো বিজেপির কথায় ভেসে যাব না।” ঐ ঐতিহাসিক পঞ্চায়েতের একটা বিরল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় — বিজেপিকে বয়কট করা হবে। কোন মহাপঞ্চায়েত কোন পার্টিকে প্রকাশ্যে নস্যাৎ করেছে, এরকম খুব কমই ঘটেছে।

আজ যখন গাজিপুর সীমান্তে বাগপত, মুজফফরনগর, শামলি, মিরাটের মত জেলা থেকে কৃষকদের আসা ক্রমশ বাড়ছে, সেখানেও আপনি একইরকম কথাবার্তা শুনতে পাবেন। “২০১৩ বিরাট ভুল ছিল”, “বিজেপি আমাদের রাগের অপব্যবহার করেছে, আর আমরা আবেগে ভেসে গেছি”, “২০১৩-র পরিস্থিতির জন্য বিজেপি আর সমাজবাদী পার্টি দায়ী” — এইসব শোনা যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি যা শোনা যাচ্ছে, তা হল “পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে ২০১৩-তে বিজেপির উত্থান হয়েছিল মুজফফরনগর দাঙ্গার জন্য। ওদের পতনও ঐ মুজফফরনগর থেকেই শুরু হবে।” বিকেইউ-র সবচেয়ে পরিচিত স্লোগান “হর হর মহাদেব” আর “আল্লাহু আকবর”, যা ১৯৮৮ সালে বোট ক্লাবের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অব্দি শোনা গিয়েছিল, শিগগির আবার শোনা যেতে পারে।

এত সহজে কি অতীত মুছে ফেলা যায়? এইসব করে কি ২০১৩-র ক্ষত সারানো যাবে?

২০১৩ মুজফফরনগর দাঙ্গা নিয়ে ছবি তৈরি করা এবং কতটা ট্রমা, ধ্বংস আর মেরুকরণ হয়েছে তা নিজের চোখে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এর কোন সঠিক উত্তর নেই।

ক্ষত সেরে যেতে পারে, আবার না-ও সারতে পারে। ষাট হাজার মানুষ, মূলত মুসলমান, উচ্ছেদ হয়েছিলেন এবং আর কোনদিন নিজেদের গ্রামে ফিরে যাবেন না। বহু মানুষ যারা ২০১৩-র হিংসার জন্য দায়ী কিন্তু আজ অনুতপ্ত, তাদের কার্যকলাপ কি ভুলে যাওয়া উচিৎ? তাতে কি সত্যিই সুবিচার হবে? আমি জানি না। যা জানি তা হল ২০১৩-র হিংসার জন্য পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ ভীষণ ভুগেছে। তার পরোক্ষ প্রভাবও মারাত্মক হয়েছে। অনেকে এখনো ভুগছে। ২০১৩ না ঘটলে যোগীর মুখ্যমন্ত্রী হওয়া হত না, হয়ত মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়াও হত না। আরো যা জানি তা হল পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সমস্যাসঙ্কুল এলাকাগুলোতে কিছুটা শান্তি ফিরিয়ে আনতে অনেকখানি সাহায্য করবে। এমনকি হিন্দু, মুসলমানদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কেরও নতুন বিন্যাস হবে। বলছি না যে এর ফলে সবকিছু বদলে যাবে। তবে এমন প্রত্যেকটা ছোট বড় পদক্ষেপেই কিছু না কিছু পরিবর্তন হয়।

অনেকে তবুও রাকেশ টিকায়ত সম্বন্ধে সন্দিহান এবং তার যথেষ্ট যুক্তিও আছে। তাও আমি তাঁদের বলব এই পরিস্থিতি সম্বন্ধে মতামত তৈরি করার ব্যাপারে একটু ধৈর্য ধরুন। সময়টা কঠিন এবং এই ধরনের আলোড়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপি ভারতের যা ক্ষতি করেছে সে ক্ষতি পূরণ হতে অনেক সময় লাগবে। সে চেষ্টা করতে গিয়ে অনেক সময় অনেক স্ববিরোধও দেখা দেবে। আবেগের বশে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে কারোর কোন লাভ হবে না।

পশ্চিম ইউ পি-তে এখনো নানারকম বিভাজন রয়েছে। এই অঞ্চলটা পাঞ্জাবের মত নয়, যেখানে লড়াকু কৃষক ইউনিয়নগুলো কয়েক দশক ধরে সক্রিয়। হরিয়ানা আর পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ (বিকেইউ সহ) কৃষকদের জোটবদ্ধ করার জন্য খাপগুলোর উপর নির্ভর করে। সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা দূর হতে সময় লাগবে। কিন্তু ২৯ তারিখের মহাপঞ্চায়েত সেই সমাজের গণতন্ত্রীকরণের পথে ক্ষুদ্র হলেও এক নিশ্চিত, উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।

আমার বন্ধু অমনদীপ সান্ধু যথার্থই বলেছে যে ‘মুজফফরনগর বাকি হ্যায়’ নামটা ছিল ভবিষ্যদ্বাণী।

লেখক ২০১৩-র সাম্প্রদায়িক হিংসা সম্বন্ধে তৈরি ‘মুজফফরনগর বাকি হ্যায়’ তথ্যচিত্রের নির্মাতা। লেখাটি তাঁর ইংরেজি ফেসবুক পোস্টের অনুবাদ । লেখকের অনুমতি নিয়ে প্রকাশ করা হল। অনুবাদ করেছেন প্রতীক। 

২০২০-২১ কৃষিবিল বিরোধী কৃষক আন্দোলন এবং রাকেশ টিকায়েত। ছবি ঋণ : Wikimedia

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.