
ভারতে স্ট্যান্ডআপ কমেডি খুব নতুন কিছু নয়। আগেকার সেই গ্রাম গঞ্জের রঙ্গ-তামাশার আসর থেকে, দি গ্রেট ইন্ডিয়ান লাফটার চ্যালেঞ্জ হয়ে, আজকের ‘এইসি তেইসি ডেমোক্রেসি’। এরই মধ্যে রয়েছেন একজন কুনাল কামরা, আর, একজন মুনাওয়ার ফারুকী।
সাম্প্রতিক সময়ে, ইন্টারনেটে, আপনি যত বার কুনাল কামরার বিরুদ্ধে হওয়া আদালত অবমাননার মামলার কথা পড়েছেন, নিশ্চিত ভাবেই ততবার মুনাওয়ার ফারুকীর গ্রেপ্তারের কথা পড়েননি। কিন্তু, অধিকারের প্রশ্নে মুনাওয়ারের গ্রেপ্তারি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক কারণ, কুনাল এবং মুনাওয়ার দুজনেই স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান হলেও, মুনাওয়ার বয়স এবং অভিজ্ঞতায় কুনালের থেকে ছোট। এবং, মুনাওয়ারের জনপ্রিয়তা বেড়েছে অনেক দ্রুত, উপরন্তু, মুনাওয়ার মুসলিম ধর্মালম্বী, অতএব, অনুভূতি আহত হওয়ার যথেষ্ট কারন বিদ্যমান।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
মুনাওয়ারের দোষের মধ্যে, মধ্যপ্রদেশের এক বিজেপি এমএলএর ছেলের অভিযোগের ভিত্তিতে, ইন্দোরের পুলিশের মনে হয়েছিল যে, একটি কমেডি শো তে মুনাওয়ার এমন কিছু জোক বা রসিকতা করতে চলেছিল যার মাধ্যমে, দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ এবং কিছু হিন্দু দেব-দেবীর অবমাননা হতেও পারতো, এবং, যেহেতু মুনাওয়ার মুসলিম ধর্মালম্বী তাই, সেই ক্ষেত্রে, হয়তো, হিন্দু ধর্মালম্বী অনেক মানুষের ধর্মানুভূতি আহত হতে পারত। যদিও এই অভিযোগের পক্ষে কোনো এভিডেন্স ইন্দোরের পুলিশ কোর্টে জমা দিতে পারেনি, কিন্তু তাও, শুধু এই কারনেই প্রায় এক মাসের ওপর মুনাওয়ার, এবং তার ম্যানেজার ও উক্ত কমেডি শোয়ের সংগঠকরা ইন্দোরের জেলে থাকতে বাধ্য হয়েছে। ওহ হ্যাঁ, মুনাওয়ারের বিরুদ্ধে কোভিড-১৯ ভাইরাস ছড়ানোর, এবং ওই সংক্রান্ত গাইডলাইন্স না মানার অভিযোগও ছিল। তার বেলের আবেদন প্রথমে ট্রায়াল কোর্ট, আর তারপর মধ্যপ্রদেশ হাই কোর্ট রিজেক্ট করে, এবং, শেষ মেশ সুপ্রিম কোর্ট থেকে বেল পেতে হয় মুনাওয়ারকে। সুপ্রিম কোর্ট বেল দেওয়ার সময় বলে যে, মুনাওয়ারের বিরুদ্ধে নাকি কোনো সুস্পষ্ট অভিযোগ আনতেই পারেনি পুলিশ!

এই প্রসঙ্গে মনে পরে যায় আরেকটা মজার ঘটনা। চিত্রকর অসীম ত্রিবেদী কার্টুন এঁকেছিলেন আমাদের পার্লামেন্টকে আর অশোক স্তম্ভ কে কেন্দ্র করে, লড়ছিলেন করাপশনের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধেও যথা নিয়মে সেডিশনের কেস রুজু হয় কংগ্রেস আমলে, এবং উনি অল্পদিনের মধ্যেই বেল পেয়ে যান। যদিও, অত্যন্ত সাহসের সাথেই তিনি জানিয়েছিলেন যে বেল তিনি চাইবেননা কারণ কোনো অন্যায় উনি করেননি। আসল ঘটনা এর পরে জানা যায়। একটি পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশনের সূত্রে জানা যায়, অসীম ত্রিবেদীকে আরেস্ট করবার পর, সরকারি আইনজীবীর পরামর্শে সেই সেডিশনের চার্জই তুলে নিয়েছিল পুলিশ ! ভাবুন একবার, আরেস্ট করবার পর, যেই অপরাধের অভিযোগে আরেস্ট করা, সেই অভিযোগই তুলে নেয়া হয়, আর তা জানা যায়, কোর্টে পৌঁছনোর পর ! তখন এগুলো একটু বেমানান লাগলেও, আজ স্বাভাবিক।
ব্ল্যাসফেমি আইনের এই ধরনের প্রয়োগ ভারতে অবশ্য একটু অনভিপ্রেত। আইপিসির ২৯৫-এ এবং ২৯৮ ধারার উপস্থিতি পুরোন হলেও, প্রয়োগ খুব বেশি হতনা। ব্রিটিশ আমলে, ১৯২৭ সালে, ‘রঙ্গিলা রাসূল’ নামের একটি বইয়ের বিরুদ্ধে প্রথম এই অভিযোগ ওঠে, এবং সেই তখন থেকেই, আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা বারংবার এই ধারাগুলির সুচিন্তিত, সীমাবদ্ধ ও সীমিত প্রয়োগের ব্যাপারে আমাদের দেশের সরকার ও প্রশাসকদের নির্দেশিকা দিয়ে চলেছে। ২০১৫ সালের শ্রেয়া সিংঘালের মামলায়ও সুপ্রিম কোর্ট আবারো এই ধারার ভ্রান্ত এবং ভুল প্রয়োগের ব্যাপারে রায় দিয়েছিল। কিন্তু, যা হয় আর কি, বিচার ব্যবস্থা যেহেতু কোনো একজন ব্যক্তি মানুষ নয়, এবং, সমষ্টির বিচক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল, তাই অনেক সময়েই, তার নানাবিধ ভিন্ন মতের পরিচয় আমরা পাই। কখনো ঠিক এবং কখনো ভুল, এই নিয়েই আমাদের বিচার ব্যবস্থা। আর তাই জন্যই, যেকোনো বিচার প্রার্থীর জন্যই অপছন্দের রায় হলে, তার বিরুদ্ধে আপিল, রিভিশন, রিভিউ, কিউরিটিভ পিটিশন, এইরম নানানা বিধান আমাদের দেশের আইনে একদম শুরু থেকেই আছে। অর্থাৎ, আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করার অধিকার একটি আইন-সিদ্ধ অধিকার আমাদের দেশে।
তাহলে, কুনাল কামরা আদালত অবমাননা করলো কিভাবে ? কারণ, কুনাল লিখেছিলেন বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই। রিপাবলিক টিভির এঙ্কর অর্নব গোস্বামীর খুব তাড়াতাড়ি সুপ্রিম কোর্ট থেকে বেল পেয়ে যাওয়া, আর অন্যান্য বহু কেসের বহুদিন যাবৎ বিচারই না হওয়ার বিরুদ্ধে টুইট করেছিলেন কুনাল, একবার না, একাধিক বার। সেই টুইট গুলোর জন্য, কয়েকজন আইনজীবী, ও আইনের ছাত্র আদালত অবমাননার মামলা করে কুনালের বিরুদ্ধে, এবং নিজের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে ফাইল হওয়া আদালত অবমাননার মামলার খবর জানার পর, কুনাল কামরার টুইট গুলো পড়লে, আপনার মনে পরে যাবে, সেই ঘটনাটি। সেই, বব মার্লের ওপর, তার গান গুলোর জন্য হওয়া খুনের হামলার পরের দিনই ওনার একটি প্রায় ক্যানসেল হয়ে যাওয়া অনুষ্ঠানে, বব মার্লে নিজের উদ্যোগেই পৌঁছে যান ও জীবনের তোয়াক্কা না করে, আবার স্টেজে উঠে পড়েন গান গাইতে। স্টেজে উঠেই বলেন, “দি পিপল, হু ওয়ের ট্রায়িং টু মেক দিস ওয়ার্ল্ড ওয়ার্স আর নট টেকিং এ ডে অফ, হাউ ক্যান আই ?”
তবে, কুনাল কামরার বিরুদ্ধে হওয়া আদালত অবমাননার অভিযোগের বিচার করতে বসে, আশা করবো, আমাদের সর্বোচ্চ আদালত, নিজের সেন্স অফ হিউমার বা রসবোধের পরিচয় দেবে, এবং মনে রাখবে রসিকতার পার্সপেক্টিভ। এই প্রসঙ্গে, সুপ্রিম কোর্টে ফাইল করা কুনালের নিজের এফিডেভিটের একটি লাইন দিয়েই লেখাটি শেষ করবো..
“আমি বিশ্বাস করি যে, বিচার ব্যবস্থা সহ, সাংবিধানিক কোনো দপ্তরই রসিকতার উর্ধে নয়। আমি বিশ্বাস করিনা যে, মহামান্য বিচারপতিরা সহ কোনো উচ্চ-কতৃপক্ষেরই, ব্যঙ্গ বা রসিকতার বিষয় হওয়ার দরুন, নিজ দায়িত্ব পালনে কোনো রকম অসুবিধা হতে পারে।”
ছবি ঋণ: Wikimedia এবং ফেসবুক
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।