বিগত কয়েকদিন যাবৎ গরুখুটি এবং ঢোলপুর ১, ২, ৩ নম্বর অঞ্চলে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু করেছে আসাম সরকার। ব্রহ্মপুত্রের কাছে দারাং জেলার সিপাঝাড় ব্লকের গরুখুটিতে প্রায় সাড়ে পঁচিশ হাজার একর জমিতে গরুখুটি প্রকল্প নিতে চলেছে আসাম সরকার। ৯.৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে সরকার, এ কথা জুলাইয়ের রাজ্য বাজেটেই এই ঘোষণা হয়ে গেছিল। মুখ্যমন্ত্রী টুইটে জানিয়েছিলেন, এই প্রকল্পে ১৩৪টি ইকোলজিকাল টাস্ক ফোর্স তৈরি হবে এবং ২০০০টি গির প্রজাতির গোপালন করা হবে। ওই চারটি অঞ্চলে বসবাসকারী ‘জবরদখলকারী’দের উচ্ছেদ করে স্থানীয় ‘অসমিয়া ভূমিপুত্রদের’ জন্যে কৃষি ও আনুষঙ্গিক প্রকল্প শুরু করাই ছিল উদ্দেশ্য। বাসিন্দাদের অনেকেরই বক্তব্য, যে তাঁরা বিগত কয়েক দশক ধরে গরুখুটি ও ঢোলপুরে বাস করছেন। চাষাবাদ তাঁদের মূল পেশা। কিন্তু সরকার তাঁদের ঘর ছাড়ার প্রয়োজনীয় সময়টুকুও দেয়নি। এক সোমবার প্রায় ১৪৮০ একর জমি থেকে ৮০০ পরিবারকে জবরদস্তি উচ্ছেদ করা হয় পুনর্বাসনের আশু পরিকল্পনা ছাড়াই। ঢোলপুর ৩ গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, বুধবার সন্ধেয় উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়ার পরে বৃহস্পতিবার সকালেই সবলে উচ্ছেদ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রশাসন পুলিশ। মহামারীর ভয় এবং আশু পুনর্বাসনের ভরসা ছাড়া রাতারাতি সরকারি নির্দেশে উচ্ছেদ হওয়ার আতঙ্ক গ্রাস করেছিল ঢোলপুরের বাসিন্দাদের। উচ্ছেদকারীদের সঙ্গে তাঁদের সংঘাত বাধে — ঘরবাড়ি আঁকড়ে থাকা অনেক মানুষ আহত হন এবং কয়েকজন পুলিশকর্মীও আহত হন। ভিডিওতে দেখা যায় পুলিশের গুলিতে মারা যান ৩৩ বছরের দিনমজুর মইনুল হক, তাঁর মৃতদেহের উপরেই লাফিয়ে উঠে পদাঘাত করেন এক চিত্রসাংবাদিক। এছাড়াও গুলিতে খুন হয় ১২ বছরের ফরিদ শেখ।
মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা প্রকারান্তরে সেই পরিবারগুলিকেই দুষেছেন, যাঁরা সরকারি জমিতে অস্থায়ী ঘর বানিয়ে থাকছিলেন। রাষ্ট্র সবসময়েই বিশৃঙ্খলার দায় চাপিয়ে দেয় শাসিতের ওপরে এবং ‘অশান্তি’ দমনের অজুহাতে প্রশাসন কর্তৃক হত্যাকে ন্যায্যতা দিতে চায়। শাসিত জনতার সম্মতি আদায় করে নিতে চায় শান্তিরক্ষার বানানো বয়ানে। বিশেষত কোনও ফ্যাসিবাদী শাসক সংখ্যাগুরু জনগণের সম্মতি আদায় করতে চেয়ে সংখ্যালঘুর ওপরে প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে অশান্তির সব দায় চাপিয়ে দেয়। কিন্তু, ৩৩ বছরের মইনুল হক আর ১২ বছরের ফরিদ শেখের হত্যাকে কি এত চেষ্টা করেও ন্যায্যতা দিতে পারছে রাষ্ট্র? যদি ধরেও নেওয়া যায়, উচ্ছেদ করতে আসা পুলিশদের বিরুদ্ধে ভিটেমাটি আঁকড়ে থাকা গ্রামবাসীদের সংঘাত উদ্বেগপূর্ণ হয়ে উঠছিল, তাতে কি পুলিশের গুলিচালনা সমর্থনযোগ্য হয়? বিজেপি প্রশাসন বলছে ‘অবৈধ’ বাসিন্দারা সরকারি নির্দেশ অমান্য করেছিলেন। কিন্তু তাতে কি মৃত মইনুল হকের দেহের ওপরে এক সাংবাদিকের হিংস্র লাফালাফির অপরাধ লঘু হয়ে যায়? নাকি ওই সাংবাদিক, সাংবাদিকের সঙ্গে থাকা পুলিশ ও আসাম সরকার এই নারকীয় উল্লাসের মাধ্যমে মুসলমান সম্প্রদায়কে বার্তা দিতে চায়? আসামবাসী বাঙালিদের মনে-মগজে আতঙ্ক গেঁথে দিতে চায়? আসামবাসী বাঙালি, বিশেষত বাঙালি মুসলমানরা ‘বেনাগরিক’ ‘অবৈধ’ এমনটাই প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা। তাই যে কোনো উপায়ে তাদের উচ্ছেদ করা এবং উচ্ছেদনির্দেশ মানতে না চাইলে নৃশংস পদ্ধতিতে প্রকাশ্যে হত্যা করার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। হত্যাকাণ্ডের ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পরে সাংবাদিক বিজয়শঙ্কর বানিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ; কিন্তু বিজয়শঙ্কর যখন গুলিবিদ্ধ মইনুলের ওপরে লাফাচ্ছে, ঘুঁষি মারছে; তখনই তাকে গ্রেপ্তার করল না কেন? গুলিবিদ্ধ মইনুলকে ও শেখ ফরিদকে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই ফেলে রেখে দিল কেন? তাঁদের অপরাধ তাঁরা ‘অবৈধ’? তাঁরা বাংলাভাষী মুসলমান? তাঁরা নিঃসহায় চরবাসী কৃষক ও দিনমজুর?
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ভারতবর্ষে গত কয়েক বছরে সংখ্যালঘু হত্যা নিত্যকার খবর হয়ে উঠেছে। ভারতবর্ষের চিরাচরিত নৈতিক মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে হিন্দুত্ববাদী আস্ফালন আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করছে। ঠিক ছয় বছর আগে ৫২ বছরের মহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে খুন করা হয় উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে। হিন্দু প্রতিবেশিরা সন্দেহ করেছিল যে তিনি বাড়ির ফ্রিজে গোমাংস রেখেছেন। ২০১৬ সালে ঝাড়খণ্ডের ছাতরা জেলার কাছে গোরক্ষক বাহিনীর হিংস্র গণপিটুনির বলি হন ৩২ বছরের মাজলুম আনসারি ও ১২ বছরের ইমতিয়াজ খান। ২০১৭ সালে রাজস্থানে পেহলু খানকে একইভাবে পিটিয়ে খুন করে গোরক্ষক বাহিনীর সমর্থকেরা। রাজস্থানের শম্ভুলাল রেগার একটা ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন ২০১৭-র ডিসেম্বরে, যাতে দেখা যায় মহম্মদ আফরাজুল নামে এক বাঙালি শ্রমিককে পিটিয়ে অর্ধমৃত করে জ্বালিয়ে দিচ্ছে শম্ভুলাল। মনে আছে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের সময় উত্তরবঙ্গের শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি চালিয়ে চারজনকে খুন করেছিল? সেখানেও কিন্তু বিশৃঙ্খলার দায় চাপানো হয়েছিল ভোট দিতে আসা সংখ্যালঘু গ্রামবাসীদের উপরেই। সেই হত্যার পরে কেন্দ্রের তরফে কোনো প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি হত্যাকাণ্ডের জন্যে সামান্য লজ্জা প্রকাশ করেছিলেন কি? কেন্দ্রের শাসক দল তথা রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের শীর্ষব্যক্তিত্বরা সেই হত্যাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং প্রকারান্তরে সংখ্যালঘুদের ভয় দেখিয়েছিলেন শীতলকুচির বীভৎসতা পুনরায় ঘটানোর। তারপরে তদন্ত কমিটি তৈরি হয়েছে। একাধিকবার তদন্তকারী সংস্থা ঘটনাস্থলে গেছে এবং গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলেছে। কিন্তু কারোর কোনো শাস্তি হয়েছে? হয়নি।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে মুসলমান বসতির ওপরে হামলা শুরু হল ‘দেশদ্রোহী’ ও ‘জিহাদি’ তকমা এঁটে। প্রকাশ্যে। স্থানীয় প্রশাসনের নির্লজ্জ অনুমোদনে। মারা গেলেন ৫৩ জন, আহত দ্বিশতাধিক। তদন্ত কমিটি কাকে শাস্তি দিতে পারল আজ অবধি? এই বছরের মে মাসে উত্তরপ্রদেশের উন্নাওতে ফয়জল হুসেন নামক এক ১৭ বছরের সবজি বিক্রেতাকে লকডাউনে ঘুরে ঘুরে সবজি বিক্রির ‘অপরাধে’ পিটিয়ে হত্যা করে পুলিশ। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে আসামের গোয়ালপাড়ার খাটুয়ামারিতে পুলিশের গুলিচালনায় মারা যান ২২ বছরের ইয়াকুব আলি। আসামে তখন নাগরিকপঞ্জির কাজ চলছিল, গোয়ালপাড়ার সিংহভাগ বাঙালি মুসলমান মানুষের নাম বাদ গেছিল ভোটার তালিকা থেকে। শ্রমিক ইয়াকুব প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। প্রশাসন গুলিচালনার সপক্ষে শাসক বলেছিল ‘অশান্ত’ প্রতিবাদীদের শান্ত করার উপায়ান্তর না থাকায় গুলি চলেছিল। নাঃ, কারোর শাস্তি হয়নি। ২০১৯ সালে শম্ভুলালকে নির্বাচনে প্রার্থী করেছিল উত্তরপ্রদেশ নবনির্মাণ সেনা নামক একটি হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী। বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকের হত্যাকে উল্লসিত সমর্থন জানিয়েছিল তারা।
শাহীনবাগে প্রকাশ্য দিবালোকে মুসলমান প্রতিবাদীদের ওপরে গুলি চালানো কপিল গুজ্জরকে নিয়ে হিন্দুত্ববাদী উচ্ছ্বাস গণতন্ত্রের আতঙ্ক বাড়িয়ে তুলেছিল। ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক আবহে সংখ্যালঘু হত্যাকারীদের নায়কের মর্যাদা দিচ্ছে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। বিজেপি শাসিত (বা ‘নরম হিন্দুত্ববাদী’ শাসিত) রাজ্যগুলিতে এমত হত্যা এবং নির্যাতন ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠছে ক্রমশ। ভারতীয় সংস্কৃতির ওপরে, সংবিধানের ওপরে গাঢ় ছায়া ঘনাচ্ছে।
ঢোলপুরের ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। বিগত কয়েক বছর যাবৎ ফ্যাসিবাদী শক্তি এরকম বহু ঘটনার পরিকল্পনা করেছে। মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে, ডি-ভোটার করে দিয়ে, জমি-বাড়ির অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে এবং ‘অস্থায়ী দখলদার’ বনাম ‘স্থানীয় ভূমিপুত্র’ বয়ানের দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে তুলে উচ্ছেদ-হত্যা-হিংসার ভিত শক্ত করেছে। ২০১৯ সালে ১৯ লাখ মানুষকে বেনাগরিক ঘোষণা করে দেয় সরকার। শিকার হলেন বাংলা ভাষাভাষী (হিন্দু-মুসলমান দুইই) মানুষ, মেহনতি মানুষ। স্বাধীন ভারতবর্ষ প্রথমবার দেখল ডিটেনশন ক্যাম্পের মনুষ্যেতর জীবনযাপন, স্বজন হারা, ঘরছাড়া মানুষের কান্না শুনল। ধর্মীয় বিদ্বেষ আর জাতিবিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্র এত মানুষের দেশ কেড়ে নিল। ‘বৈধ’ বনাম ‘অবৈধ’ বয়ান প্রতিষ্ঠা করে জনতোষী হয়ে উঠল শাসক, উচ্ছেদ-হত্যার সম্মতি আদায় করে নিল স্থানীয় বহু নাগরিকের থেকে। লড়িয়ে দিল এককে অন্যের বিরুদ্ধে। শ্রেণি ভুলে শোষণের ইতিহাস ভুলে জাত ধর্মই হয়ে উঠল মূল বিবেচ্য। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘উইপোকা’ বলে দেগে দিলেন দেশের এক বিশেষ সম্প্রদায়কে। এই সমস্ত ঘটনাই মানবতার বিরুদ্ধাচরণ। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে জাতি-ধর্মের নামে উচ্ছেদ ও হত্যা রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাচ্ছে, অর্ধমৃত জনৈক সংখ্যালঘুর উপরে বীভৎস উল্লাসে লাফাচ্ছে সংখ্যাগুরু জনৈক সাংবাদিক। আর শাসক বলে চলেছে আসাম পুনর্গঠনের স্বার্থে উচ্ছেদপ্রক্রিয়া জারি থাকবে — এর থেকে বড় লজ্জা আর কীই বা হতে পারে?
১২ বছরের শেখ ফরিদ ফ্যাসিবাদী উল্লাসের সাম্প্রতিকতম শিকার। শেখ ফরিদ স্থানীয় ডাকঘর থেকে জীবনের প্রথম সচিত্র পরিচয়পত্র আধার কার্ড নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। রাষ্ট্রীয় পরিচয়পত্র তাকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি। এই লজ্জা রাষ্ট্রের, এই লজ্জা গণতন্ত্রের।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।