যাদবপুরে সদ্য পড়তে আসা ছাত্রটির র্যাগিংয়ের কারণে মৃত্যু আমাদের সবার দায়িত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের মানে, প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের। শুধুমাত্র যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের উপর সমস্ত কিছু ঠিক করার দায় চাপিয়ে দিলে আমরা অনেক বেশি অপরাধী হয়ে যাব। প্রচুর অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা হয়েছে গোটা বিষয়টি নিয়ে। ক্যাম্পাসে মদের বোতল, গাঁজা, কনডম, বহিরাগতদের প্রেম করার মতো প্রসঙ্গ তুলে মূলধারার সংবাদমাধ্যম এবং প্রকারান্তরে বৃহত্তর সমাজ আসল সমস্যা থেকে নজর ঘুরিয়ে দিচ্ছে আমাদের সকলের।
আসল সমস্যা এক্ষেত্রে একটাই — র্যাগিং। দুর্বল ছাত্রের উপর শক্তিশালী ছাত্র বা ছাত্র গোষ্ঠীর বিকৃতকাম ক্ষমতা জাহির করার লক্ষ্যে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার। এখানে শক্তিশালীর শক্তির উৎস সাধারণত তাদের ‘সিনিয়র’ তকমাতেই নিহিত। কলেজে কলেজে সিনিয়রদের দাপট, জুনিয়রদের মধ্য থেকে অনুগামী তৈরির প্রবণতা আমাদের অজানা নয়। যে সিনিয়ররা নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে জুনিয়রদের অনুগামিতার প্রশ্রয় নেয়, তারা মানসিক ও চরিত্রগতভাবে দুর্বল। সেই দুর্বলতাকে ঢাকতে তারা বিভিন্ন সময়ে নানা ফন্দিফিকির আমদানি করেন। র্যাগিং যার মধ্যে উগ্রতম।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
শক্তিশালী সিনিয়রের দুর্বল জুনিয়রের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন শুধুমাত্র র্যাগিং করে হয় না। হয় জুনিয়রদের নির্বোধ প্রমাণ করে তাদের স্বাধীন মতামত পোষণ করার ক্ষমতাকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে। নিজেদের ব্যক্তি অথবা সমষ্টিগত অভিমত জুনিয়রদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করার মধ্য দিয়েও। বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর উঠে এলে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যের দেওয়ালে চিড় ধরবে, এই ভয় থেকে তারা আরো বেশি জাঁকিয়ে বসে নিজেদের কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ করতে। নিজেদের জীবনে অকৃতকার্য হওয়ার ভয় থেকেই তারা স্যাডিস্টিক আচরণ শুরু করে। সমস্ত এমন প্রবণতাকে প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিকভাবে দমন না করার ফলে র্যাগিংয়ের মত সামাজিক ব্যাধি আজও আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সামগ্রিক ব্যর্থতার ফলে ছোট ছোট কুঁড়িদের ফুটে ওঠার আগেই প্রাণ দিতে হয়। কিছু সময়ে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলি এই সিনিয়রকেন্দ্রিক আনুগত্যের সংস্কৃতিকে সার্বিক সাংগঠনিক শক্তিবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থের দিকে তাকিয়ে তাঁরা যে বৃহত্তর ছাত্র ঐক্যের ক্ষতি ডেকে আনছেন, তা নিয়ে খুব একটা অবগত নন। আমরা অনেকেই যারা নিজেদের প্রগতিশীল মনে করি, দোষ আমাদেরও কম নয়। এই প্রবণতাগুলিকে আমরা জ্ঞানে বা অজ্ঞানে বিভিন্ন সময় প্রশ্রয় দিয়েছি।
র্যাগিং বিরোধিতা প্রসঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়। আমি স্কুল পাশ করেই দিল্লি চলে আসি। সেন্ট স্টিফেন্সে এসেই প্রথম দেখি কলেজে “ইন্ট্রো” বিরোধী হাওয়া বইছে। প্রসঙ্গ, কলেজের হস্টেলগুলিতে ছাত্র ছাত্রীদের “ইন্ট্রো” নিয়ে তাদের মানসিক চাপে ফেলা হচ্ছে। সুতরাং, অবিলম্বে সমস্তরকম “ইন্ট্রো” নেওয়া বন্ধ করতে হবে। সবাই সহমত না হলেও বিপুলভাবে সিনিয়ররা এই ভাবনাকে সমর্থন করে। আমাদের ব্যাচকে তাই বিশেষ ‘ইন্ট্রো’র সম্মুখীন হতে হয়নি। সবচেয়ে খুশি হলাম এই দেখে, সিনিয়ররা কখনোই নিজেদের সিনিয়র সত্তা আমাদের উপর জাহির করেননি। স্কুলের যেই সব সিনিয়রদের দাদা বলে ডাকতাম, তারা নিজে থেকেই নাম ধরে ডাকতে বললো। বিভিন্ন কলেজ সোসাইটিতে গণতান্ত্রিকভাবে সকলের মত নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করতে দেখেছি আমাদের সিনিয়রদের। বারবার তাদের মুখে অনৈতিক আধিপত্যের অচলায়তন ভেঙে ফেলার কথা শুনেছি। সেই প্রচেষ্টায় কোনোদিন কোনো ত্রুটি দেখিনি। চেষ্টা করেছি নিজেদের জুনিয়রদের মধ্যেও সেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে। আমার ধারণা, অনেক যাদবপুরের বন্ধুরও একইরকম অভিজ্ঞতা।
স্টিফেন্স ছাড়া দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কলেজগুলিতেও এই নিয়মের অন্যথা হয়নি কোনোদিন। অথচ আজ থেকে তিন-চার দশক আগেও কিরোরী, রামজস, হংসরাজ, দেশবন্ধু, রাজধানীর মতো কলেজ ছিল র্যাগারদের মুক্তাঞ্চল। ভয়াবহ সব র্যাগিংয়ের গল্প শুনে শিউরে উঠেছি। ছাত্র ভোটকে কেন্দ্র করে আজও মারামারির ঘটনা ঘটে এখানে। কিন্তু, আগে এমনি সময়েও কলেজে কলেজে হিংসার ঘটনা খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল। এ সব থেকে মুক্তি এল কি করে?
আটের দশকের শুরুর দিকে রামজসের অধ্যাপক দিলীপ সিমিয়নকে মারধরের প্রতিবাদে হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী ক্যাম্পাস হিংসার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন। একই সময়ে স্টিফেন্সে মহিলা ছাত্রীদের যৌন হেনস্থার প্রতিবাদেও তাঁরা গর্জে উঠেছিলেন। সাম্প্রতিককালে ২০১৭ সালে রামজসের ছাত্রদের উপর এবিভিপির হামলার বিরুদ্ধে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় আবার সোচ্চার হয়েছিল। ২০১৯ সালে হিন্দু কলেজে চূড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক ‘ভার্জিন ট্রি পুজো’ বন্ধ হয়েছিল ছাত্র ছাত্রীদের সমবেত আন্দোলনে।
আসলে শুধু সরকারি আইন প্রণয়ন করে, কাগজে সই নিয়ে র্যাগিং বন্ধ করা সম্ভব নয়। গত চার দশক ধরে শিক্ষক শিক্ষিকা ও ছাত্রছাত্রীরা মিলে র্যাগিংসহ অন্যান্য হিংস্র কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মত তৈরির কাজ করে গেছেন নিরন্তর। তাঁদের অবিশ্রান্ত পরিশ্রমের ফলে আজ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য সমস্যা সত্ত্বেও সার্বিকভাবে র্যাগিং মুক্ত। যাদবপুরেও একইভাবে ছাত্রছাত্রীরা বারবার হিংসার বিরুদ্ধে গলা তুলেছেন, এক সুস্থ রাজনৈতিক পরিসর তৈরিতে সচেষ্ট হয়েছেন।
তবে এই সমস্যাকে শুধুই যাদবপুরের সমস্যা বলে যে বা যারা অপরাধীদের এবং এহেন অপরাধপ্রবণতাকে আশ্রয় দিচ্ছেন, তাঁদের ঐক্যবদ্ধ ছাত্রসমাজের শক্তি প্রদর্শনের সময় এসেছে। আজকের ভ্রান্ত নয়া শিক্ষানীতির ফলে শ্রেণী, জাতপাত, বা লিঙ্গ বৈষম্য আরও বাড়বে। ছাত্র গোষ্ঠী আরও খণ্ডিত হবে, র্যাগিংয়ের মত সমস্যা আরও বাড়বে।
এমতাবস্থায় অতীতের ছাত্র সংহতির কথা বারবার নিজেদের মনে করানো আবশ্যক। দেশের প্রতিটি কলেজে আমাদের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে যেতে হবে সহমর্মিতার বার্তা নিয়ে। উদ্যোগ নিতে হবে ঘন ঘন রাতপাহারার, ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের রাত্রিযাপনের, র্যাগিং সহ অন্যান্য হিংসাত্মক ব্যাধির বিরুদ্ধে মত তৈরি করার আন্দোলনের। র্যাগিং নিয়ে দেশের প্রতিটি ক্যাম্পাসে যতদিন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সুচিন্তিত আলোচনা শুরু না হচ্ছে, ততদিন কোটি কোটি সিসিটিভি লাগিয়েও এ ব্যাধি দূর করা সম্ভব নয়। যাঁরা এই সহজ সত্যি ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁরা আসলে ছাত্রবিরোধী। সংকীর্ণ রাজনৈতিক মতানৈক্য দূরে রেখে এই অশুভ শক্তিগুলির বিরুদ্ধে লড়াই সংগঠিত করাই আমাদের সবার দায়িত্ব। তাহলেই কোটি কোটি ‘স্বপ্ন’-কে অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়া থেকে আমরা বাঁচাতে পারব।
মতামত ব্যক্তিগত
আরো পড়ুন
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।