উমর খালিদ

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির এক হিমশীতল সকালে আমাকে জেল থেকে একটা পুলিস ভ্যানে করে আদালতে প্রথমবার পেশ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ভ্যানের মধ্যে পুলিসকর্মীরা কৃষক আন্দোলন নিয়ে জোর আলোচনা করছিল। কিন্তু চার মাস বন্দী থাকার পর, আমার কাছে বেশি আকর্ষণীয় ছিল ভ্যানের বাইরের দৃশ্য। লোকে অফিস যাচ্ছে, বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে — এইসব আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। গাড়িতে, বাসে, রাস্তায় — সর্বত্র মানুষ দেখছি। কেউ কেউ হাতের ফোনে ডুবে আছে, আবার কেউ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। কেউ তাদের উপর নজরদারি করছে না। তারা যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে, যার সাথে খুশি কথা বলতে পারে।

সে এক অপূর্ব দৃশ্য। মুক্ত মানুষ দেখতে পাওয়া যে কী দারুণ ব্যাপার! আমার মনে পড়ল সেইসব দিনের কথা, যখন আমিও ওই মানুষগুলোর মত মুক্ত ছিলাম। ইকবালের সেই লাইনগুলো মনে পড়ল:

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

“আতা হ্যায় ইয়াদ মুঝকো গুজরা হুয়া জমানা

উয়ো বাগোঁ কী বাহারেঁ, উয়ো সব কা চেহচহানা

আজাদিয়াঁ কাঁহা উয়ো অপনে ঘোসলে কী

অপনি খুশি সে আনা অপনি খুশি সে যানা।”

[পড়ছে মনে কতকালের কথা

কতকালের বসন্ত আর সবার কথকতা

যখন খুশি জুড়ে বসি আবার উড়ে যাই

সেই সেদিনের আরামটি আর নাই]

আমি এই দিনটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। সে পর্যন্ত কোভিড বিধির কারণে আমাদের আদালতের শুনানি জেলের মধ্যে থেকেই ভার্চুয়ালি হচ্ছিল। মাসের পর মাস বাইরের পৃথিবীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটাই জায়গায় আটকে থেকে আমার মনে হচ্ছিল যেন কোনো ফাঁদে পড়ে ছটফট করছি। একটু বদলের জন্য প্রাণ আনচান করছিল। আদালতে যেতে বোধহয় ঘন্টা দেড়েক সময় লেগেছিল। ওখানে শুনানি চলল মাত্র ৩০ মিনিট। কাজকর্ম মিটে যেতেই আমাকে জেলে ফেরত যাওয়ার জন্য আবার ভ্যানে তুলে দেওয়া হল। আসা যাওয়ার গোটা সময়টাই আমি অবাক হয়ে বাইরেটা দেখছিলাম। যেন একজন পর্যটক, আমাকে বাসে করে কোনো অচেনা শহর ঘুরিয়ে দেখানো হচ্ছে।

বেলা দুটোর মধ্যে আমাকে তিহারে ফিরিয়ে আনা হল। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে আমার সেলে বন্ধ করে দেওয়া হল। আদালতের ‘এক্সকার্শন’ সেই ছোটবেলার পিকনিকগুলোর মত নিমেষে ফুরিয়ে গেল। আবার তিহারের উঁচু দেয়ালগুলোর দমবন্ধ করা একঘেয়ে জীবন শুরু হল।

আমি যখন ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিহারে ঢুকেছিলাম, প্রথম যে জিনিসটা খেয়াল হয়েছিল সেটা হল এক অদ্ভুত থমথমে ভাব। ওই চত্বরে কেউ যদি একবারও গিয়ে থাকে, সে ওই থমথমে ভাবটার কথা বলবেই। মনে হবে কোনো ভুতূড়ে শহরে ঢুকে পড়েছি, যেখানে চারদিকেই উঁচু দেয়াল। আমাকে পুলিসের যে গাড়িটা থানা থেকে নিয়ে গিয়েছিল, সেটা যত ভিতরে ঢুকতে লাগল তত বাইরের পৃথিবীটা দূরে সরে যেতে লাগল আর তার স্থান নিল নৈঃশব্দ্য।

তিহারের চত্বরে ঢুকে পড়ে থাকলেও তখনো আমরা আমাকে যে জেলে থাকতে হবে সেখানে পৌঁছইনি। তিহার একটা বিরাট জায়গা। নটা আলাদা আলাদা জেলে বিভক্ত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় কারাগার। গাড়িটা অনেকক্ষণ একেবারে একলা একটা রাস্তা দিয়ে চলার পর আমরা ২ নম্বর সেন্ট্রাল জেলে পৌঁছলাম। সেখানে পুলিস আমাকে জেল কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিল। কিন্তু তার আগে কিছু কাগুজে কাজকর্ম ছিল। একটা জানলার সামনে একটা লাইনে আমাকে দাঁড়াতে হল। সেটা সেদিন আরও যারা জেলে ঢুকছে তাদের লাইন। সেই জানলায় একজন কেরানি বসে ফর্ম পূরণ করছিলেন। “নাম কী? বাবার নাম কী? কোন কেসে আসা হয়েছে?”

নিজের নাম আর বাবার নাম বলার পর ভদ্রলোকের শেষ প্রশ্নের উত্তরের আমি বললাম “ইউএপিএ”। কথাটা উনি আগে কখনো শোনেননি। ফলে মনে করলেন আমি ওঁর প্রশ্নটা বুঝতে পারিনি।

“আরে কোন ধারায় জেল হয়েছে?”

“ইউএপিএ।”

এবার বেশ বিরক্ত হয়েই বললেন “কী? ঠিক করে বলো।”

তখন আমাকে দিল্লি পুলিসের যে কনস্টেবল জেলে ভর্তি করতে এসেছিল, সে পিছন থেকে বলল “দাঙ্গার কেস, স্যার। দিল্লি দাঙ্গা।”

কেরানি ভদ্রলোক রেজিস্টারে লিখলেন। ঠিক করে বলিনি ভেবে তখনো আমার উপরে বেশ বিরক্ত। এটা আমার গ্রেপ্তারির ১১ দিন পরের ঘটনা, কিন্তু তখন পর্যন্ত কেউ আমার সম্বন্ধে ওই কথাটা সরাসরি বলেনি। এত বছর ধরে যে রাজনীতি দাঙ্গা, ঘৃণা আর বিভাজনের উপর ভর দিয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে তার বিরুদ্ধে কথা বলার পর আমি জেলে ঢুকছি। হাতে একটা কাগজের টুকরো, যাতে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের জায়গায় লেখা আছে “দিল্লি দাঙ্গা”। মনে হল যেন কেউ আমার পেটে প্রচণ্ড জোরে এক ঘুঁষি মেরেছে।

কিন্তু তখন সেন্টিমেন্টাল হওয়ার সময় নয়। জেল সম্বন্ধে যা যা শুনেছিলাম তার ভিত্তিতে আমার মনে যেসব ভয় তৈরি হয়েছিল, তখন সেগুলোই আমার মাথায় ঘুরছে। জেলাররা আমাকে কোথায় রাখবে? আমি জেলের ভয়ঙ্কর “ব্লেডবাজ”-দের কথা শুনেছিলাম। যারা তাদের দাবি না মানলে ব্লেড দিয়ে শরীরে কাটাকুটি করে। ওরা কি আমাকে ধরে নানারকম দাবিদাওয়া জানাবে? সে দাবি তো টাকাপয়সা চাওয়া থেকে শুরু করে যৌন দাবি পর্যন্ত যা খুশি হতে পারে। সংবাদমাধ্যম আমি গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আমার সম্বন্ধে যা যা বলেছিল, তার জন্যে কি জেল কর্তৃপক্ষ আমার সাথে দুর্ব্যবহার করতে পারে?

ভাগ্যের কথা, ওসব কিছুই ঘটেনি। উল্টে জেল কর্তৃপক্ষ আমার যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিয়েছিল। জেল চত্বরে আমি হয়ে গেলাম “হাইলাইট ম্যাটার”, মানে যাদের কেস সংবাদমাধ্যম রিপোর্ট করে। এরকম বন্দীদের কোনো ক্ষতি হলে সেটা খবর হয়ে যাবে। তাতে জেল কর্তৃপক্ষের মুশকিল হবে। আমাকে অন্য বন্দীদের থেকে আলাদাভাবে একটা সেলে রাখা হল, আর আমার নিরাপত্তার জন্য দুজন জেল ওয়ার্ডেনকে রাখা হল। আমি বুঝলাম, টিভি চ্যানেলগুলো যেভাবে আমাকে খলনায়ক বানিয়ে গ্রেপ্তার করাল, সেটাই জেলের ভিতরে আমার বর্ম হয়ে উঠেছে।

কিন্তু কদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, তার ফলে কিছু নতুন সমস্যাও তৈরি হয়েছে। অন্য বন্দীদের মত আমাকে আমার সেলের বাইরের ছোট বারান্দায় ঘুরতে দেওয়া হয় না। নিরাপত্তার নাম করে আমাকে আমার সেলের ভিতরেই আটকে রাখা হয়। কয়েক ঘন্টা ধরে অনুরোধ করলে আমাকে সারাদিনে ১০-১৫ মিনিটের জন্য খোলা হাওয়ায় ছাড়া হয়। তিন সপ্তাহ ধরে চলা এই কনফাইনমেন্ট মানুষকে ভেঙে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট। পরের শুনানিতে আমি আদালতে এই বিষয়টা তুললাম। জজ জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টকে শমন দিলেন এবং বলে দিলেন আমাকে এইভাবে খাঁচায় বন্দী করে রাখা যাবে না। ফলে দিনে তিন ঘন্টা — সকালে দুই আর বিকেলে এক — সেলের বাইরে আসার সুযোগ পেলাম। সেটাও অন্যদের চেয়ে অনেক কম, কিন্তু তিন সপ্তাহের ওই যন্ত্রণার পর ওটুকুও বিরাট স্বস্তির। এক মাস পরে আমি কর্তৃপক্ষের সাথে দরাদরি করে আরও এক ঘন্টার অনুমতি আদায় করলাম। কয়েক মাস পরে আরও একটু বেশিক্ষণ।

গত ১৫ মাস ধরে এই হল আমার জীবন। বই, গরম জামাকাপড় বা সামান্য খোলা হাওয়ার জন্যও রোজ দরাদরি করতে হয়। তাছাড়া আমার হাতে যে অফুরন্ত সময়, সেটা নিয়ে কী করব তা-ও ভাবতে হয়। কেনিয়ার লেখক এনগুগি ওয়া থিওংও তাঁর জেলের স্মৃতিকথায় লিখেছেন, বাইরে থেকে লোকে মনে করে জেলের জীবন মানে হয় অন্তহীন লড়াই। কিন্তু আসলে জেলের জীবন মানে হল দৈনিক একঘেয়েমি। জেগে উঠলাম, খেলাম, পেচ্ছাপ পায়খানা করলাম, ঘুমোলাম। দিনের পর দিন। এর সাথে পড়াটা যোগ করতে পারি। ব্যাস, এই হল গত ১৫ মাসে আমার দিন রাতের রুটিন।

তার উপর বোঝা যায় না এ জিনিস কতদিন চলবে। প্রায়ই বলা হয় যে জেল হল দণ্ডিতদের জন্য, বিচারাধীনদের জন্য নয়। কিন্তু আমার প্রাক-বিচার বন্দীদশাতেই ১৫ মাস কেটে গেল। শিগগির আমাদের বিচার শুরু হবে বলেও মনে হচ্ছে না।

এনগুগি ওয়া থিওংও নিজের স্মৃতিকথায় রাজনৈতিক বন্দীদের এই অদ্ভুত দশার কথাও লিখেছেন, যে তারা জানে না আবার কতদিন পরে মুক্তি পাওয়া যাবে। এর ফলে একদিক থেকে আমাদের অবস্থা দণ্ডিত অপরাধীদের থেকেও খারাপ। তারা জানে তাদের কতদিন এই অবস্থায় থাকতে হবে। কারাবাস যদি অনেকদিনেরও হয়, তাহলেও তার জন্যে মানসিক প্রস্তুতি থাকে। অথচ আমরা জানি না একমাস পরে ছাড়া পাব, নাকি এক বছর পরে ছাড়া পাব, নাকি ১০ বছর এভাবেই থাকতে হবে।

আশা নিরাশার মধ্যে এই যে দুলতে থাকা, এই অনিশ্চয়তার মোকাবিলা করা খুব শক্ত। সর্বদাই আশা করি, কোনো একজন জজ অভিযোগগুলো যে একেবারে আষাঢ়ে গল্প সেটা বুঝতে পারবেন এবং আমাদের মুক্তি দেবেন। একইসঙ্গে নিজেকে ওরকম আশাবাদী হওয়ার বিপদ সম্পর্কে সচেতন করি। যত বেশি আশা করব, আশাভঙ্গ হলে তত বেশি আঘাত পাব।

*লেখকের অনুমতিক্রমে আউটলুক পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা থেকে ভাষান্তরিত। মতামত ব্যক্তিগত।

শেষাংশ আগামীকাল

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.