কয়েকদিন আগে দ্য টেলিগ্রাফ অনলাইন-এ একটা খবর প্রকাশিত হয়। জম্মুর রাজৌরিতে ১৬ ডিসেম্বর সেনাশিবিরের বাইরে দুজন দলিত অধিবাসী অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের হাতে নিহত হন। সেনাবাহিনী দাবি করে এটা জঙ্গীদের কাজ। কিন্তু নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, এই হত্যাকান্ড সেনাবাহিনীই ঘটিয়েছে। ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। যাই হোক, এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ওই দলিত পরিবারকে পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে নিকটাত্মীয়দের সরকারি চাকরি দেবার কথাও ঘোষিত হয়েছে। এই ঘটনার পনেরো দিনের মাথায় পয়লা জানুয়ারিতে সাত কিলোমিটারের মধ্যে অন্য একটি গ্রামে আরও একটা হামলার ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনায় ছজন নিহত হন। প্রত্যেকেই ব্রাহ্মণ পরিবারের। এবারেও সেনাবাহিনী দাবি করে এটা জঙ্গীদের কাজ। কিন্তু এক্ষেত্রে সেনাবাহিনী দশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়, সেইসঙ্গে সরকারি চাকরি।
এই বৈষম্যে প্রবল ক্ষুব্ধ দলিত পরিবার। তাঁরা জানিয়েছেন, প্রথমে তাঁদের এক লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যখন তাঁরা দেহ সৎকার করতে অস্বীকার করেন তখন পাঁচ লক্ষ দেওয়া হয়। কিন্তু ব্রাহ্মণ পরিবারের মৃতদের একেবারে দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। দলিত পরিবারের এক ব্যক্তিকে উদ্ধৃত করা হয়েছে যেখানে তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, জীবিত থাকাকালীন তো সমমর্যাদা দাওনি। দলিত পরিবারের ‘শহিদদের’ তো অন্তত উচ্চবর্ণের সমান মর্যাদা দাও!
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
খবর এইটুকুই। কিন্তু বাস্তবতা পর্বতপ্রমাণ। ভারতীয় সেনা প্রতিবেশীর ঈর্ষা কিনা জানা নেই, কিন্তু শাসকের গর্ব। সেইসঙ্গে এক বড় অংশের নাগরিকের আদিখ্যেতার পাত্রও বটে। আগে তা ছিল গোলাপি রঙে ছোপানো, ইদানীং গেরুয়ার ছিটে লেগেছে। কিন্তু পৃথিবীর আর সব সেনাবাহিনীর তুলনায় ভারতীয় সেনাবাহিনী কিছু কম অত্যাচারী, কম প্রতিক্রিয়াশীল নয়। কাশ্মীর থেকে মণিপুর – সেনাবাহিনীর অত্যাচার, বর্বরতা, নৃশংসতা নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। কিন্তু তার দৈনন্দিন যাপনের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়াশীলতা সতত বহমান থাকে তার উপর আলোকপাত কমই হয়ে থাকে। যদিও তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ, সেনাবাহিনী রাষ্ট্রেরই অংশ। সুতরাং এই মনুবাদী প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রের সমস্ত কদর্যতাই যে সেনাবাহিনী ধারণ করে চলবে সেটাই স্বাভাবিক। বরং বছর বছর ১৫ অগাস্ট মাইকে মাইকে ওই যে আমরা শুনি, “অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ” – সেটা এই প্রেক্ষাপটে এক করুণ কমেডির বেশি কিছু নয়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা যে রাষ্ট্রব্যবস্থা ছেড়ে গেল স্বাধীন ভারতীয়দের হাতে, তা বহুলাংশেই রয়ে গেল ঔপনিবেশিক। দেশের স্বাধীনতার চরিত্র নিয়েও তো বিতর্ক কম নয়। কমিউনিস্টরা বলেছিল, ঝুটা স্বাধীনতা। বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর বলেছিলেন, জাতিব্যবস্থা নির্মূল না হলে স্বাধীন ভারত হবে দলিতদের কারাগার। আম্বেদকর সংবিধান রচনা করেছিলেন বলে দিনরাত প্রচার করা হয়, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে বিষয়টা ছিল উভয় পক্ষেরই কৌশল মাত্র। সাম্রাজ্যবাদের ছেড়ে যাওয়া সিংহাসনে সাম্রাজ্যবাদেরই তাঁবেদাররা যখন ক্ষমতায় বসল, তখন তারা চাইল সংবিধানটা তৈরি হোক তাদেরই মর্জি মত, কিন্তু তাতে দলিত সমাজের অনুমোদনের একটা সিলমোহর থেকে যাক। ফলে তারা আম্বেদকরকে চাইল সংবিধান সভার চেয়ারম্যান হিসাবে। আম্বেদকরও দেখলেন এটাই সুযোগ। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে যদি সংবিধানে কিছু রক্ষাকবচ ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। আসলে এই তো ব্যাপার। কিন্তু ব্যবস্থাটা ঔপনিবেশিকই রয়ে গেল। আইনকানুন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় রীতি, দর্শন, ভাবনাচিন্তা একই রইল।
ইংরেজরা যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠন করে, তখন তা তৈরি হয়েছিল বিভিন্ন বর্ণ, সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে অথবা জাতি ও জাতিসত্তা এবং ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে। এর কারণ আছে এবং ইতিহাস আছে। আপাতদৃষ্টিতে তারা এইভাবে রেজিমেন্টগুলো গঠন করার পিছনে একটা যুক্তি দাঁড় করায়। সেটা হল, যে সমস্ত গোষ্ঠীর লোকেরা ভাল যুদ্ধ করতে পারে তাদেরই তারা সৈন্যবাহিনীতে নিয়েছে এবং যেহেতু তাদের গোষ্ঠীর নামাঙ্কিত রেজিমেন্ট তাদের মনে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চেয়েও বেশি অনুপ্রেরণা সঞ্চার করে, তাই একেকটা গোষ্ঠীর লোকেদের নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর রেজিমেন্ট তৈরি করাই উচিত। এই ছিল ইংরেজ ঔপনিবেশিকদের যুক্তি এবং কর্মপদ্ধতি। এভাবেই তৈরি হয় পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, শিখ রেজিমেন্ট, নাগা রেজিমেন্ট, রাজপুতানা রাইফেলস, রাজপুতানা রেজিমেন্ট, জাঠ রেজিমেন্ট, ডোগরা রেজিমেন্ট ইত্যাদি। তার আগে ব্রাহ্মণ ইনফ্যান্ট্রি ছিল, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তুলে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চামার রেজিমেন্ট তৈরি করা হয়, যা যুদ্ধের পর বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সুতরাং এটা বোঝা কঠিন নয় যে সৈন্যবাহিনী কোনো ধরনের প্রগতিশীল ভাবনাচিন্তা ধারণ বা অনুশীলন করার জায়গা নয়। বরং উল্টোটাই সত্য। সমাজের যে সমস্ত পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণা মানুষকে যুগে যুগে সমস্ত রকমের ধ্বংসাত্মক ও বর্বরোচিত কাজ করার প্রেরণা জুগিয়েছে, সেগুলোই সেনাবাহিনীর হাতিয়ার। সুতরাং ক্ষতিপূরণও যে তারা জাতের ভিত্তিতে দেবে এবং ব্রাহ্মণ যা পাবে দলিত পাবে তার অর্ধেক, এখানেও চালু থাকবে কুখ্যাত মনুর বিধান এবং মনুর দর্শন – তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কিন্তু দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পার করে যখন আমরা ‘স্বতন্ত্রতা কা অমৃত মহোৎসব’ উদযাপন করে কৃতার্থ হচ্ছি, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে – এই সৈন্যবাহিনী কার সৈন্যবাহিনী? কাদের স্বার্থে তারা কাজ করে?
২০১৩ সালে হরিয়ানার বাসিন্দা ডাঃ আই এস যাদব সুপ্রিম কোর্টে একটা মামলা করেছিলেন। তাতে অভিযোগ করা হয়েছিল, ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাইশটা রেজিমেন্ট আছে যা বর্ণ, জাতিসত্তা বা ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত। ডাঃ যাদব এই ব্যবস্থার অবসান চেয়েছিলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এই ব্যবস্থাকে সমর্থন জানিয়ে হলফনামা দেওয়া হয়। তাতে সেই একই যুক্তি ইনিয়ে বিনিয়ে বলা হয়। মোদ্দাকথা যুদ্ধে জিততে হবে, তাই যুদ্ধপটু গোষ্ঠীরা লোকেদের সেনাবাহিনীতে নিতে হবে এবং তাঁদের সেই গোষ্ঠীর ভিত্তিতে নামাঙ্কিত রেজিমেন্টেই রাখতে হবে, যাতে তাঁরা ভালভাবে যুদ্ধ করতে অনুপ্রাণিত হয়। দেখুন, ঔপনিবেশিক যুক্তি আজও কেমন কালো চামড়ার সাহেবদের মাথায় গেঁথে রয়েছে। এখন আসুন এই যুক্তিটাকে একটু ভাল করে বিচার করে দেখা যাক।
ইংরেজরা কী করে বুঝেছিল, কারা ভালো যুদ্ধ করে আর কারা যুদ্ধে দক্ষ নয়? সে এক মজার যুক্তি। এই বোঝাবুঝির ভিত্তি হল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ ইংরেজদের মনে স্থায়ী আতঙ্ক তৈরি করে দিয়ে যায়। মহারানির অধীনে এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধীনে তারা খুব সতর্কভাবে সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করে। তারা খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে, কোন কোন গোষ্ঠীর লোকেরা সিপাহী বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল আর কারা নেয়নি। অর্থাৎ সেই সময়ে কারা ব্রিটিশের পক্ষ নিয়েছিল আর কারা বিপক্ষে যুদ্ধ করেছিল। দেশের কোন অঞ্চলে বিদ্রোহের প্রভাব বেশি হয়েছিল আর কোথায় কম হয়েছিল। এই ধরনের পর্যবেক্ষণ শুধুমাত্র সিপাহী বিদ্রোহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সামগ্রিকভাবেই ইংরেজ শাসনের প্রতি কোন গোষ্ঠীর কেমন মনোভাব তা তারা সদাসর্বদা মেপে চলেছে। এর ভিত্তিতেই তারা তৈরি করেছিল ভারতীয়দের মধ্যে ভাগাভাগি – মার্শাল রেস ও নন-মার্শাল রেস। কারা ভালো যুদ্ধ করতে পারে আর কারা পারে না। এর ভিতরের কথাটা ছিল, কারা সরকারের পক্ষে আছে আর কারা নেই। নইলে সিপাহী বিদ্রোহে যাদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে ইংরেজদের আর একটু হলেই পতন হত তাদেরই তারা নন-মার্শাল বলে দাগিয়ে দেয়?
সিপাহী বিদ্রোহ গড়ে উঠেছিল মূলত দেশের পূর্ব এবং দক্ষিণ দিক থেকে। সমস্ত বিদ্রোহের মতই সিপাহী বিদ্রোহও ছিল একটা জটিল বিষয়। বিদ্রোহে অংশ নেওয়া আর ব্রিটিশের পক্ষ নেওয়ার মধ্যে অনেক ধরনের হিসাব ছিল, মনোভাব ছিল, জটিলতা ছিল। কিন্তু তাতে কারা ভাল যুদ্ধ করতে পারে আর কারা পারে না, তা প্রমাণিত হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বাঙালিদের কথা। ইংরেজরা বাঙালিদের নন-মার্শাল রেস বলে দাগিয়েছে। অথচ গোটা স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালিদের সশস্ত্র সংগ্রাম গোটা ভারতের কাছে বিরাট অনুপ্রেরণা। সিপাহী বিদ্রোহেও বেঙ্গল আর্মির বিরাট ভূমিকা ছিল। ফলে ইংরেজদের কাছে বাঙালিরা ছিল আতঙ্কের বিষয়, তাই তারা কখনোই বাঙালিদের বড় আকারে সেনাবাহিনীতে নেয়নি।
অন্যদিকে সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে শিখরা মূলত ব্রিটিশদের সহযোগিতা করেছিল। এর পিছনে দুটো প্রধান কারণ ছিল। এক, এই বিদ্রোহের অন্যতম এজেন্ডা হয়ে উঠেছিল মোগল সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং ‘হিন্দুস্তানী’ ও মুসলমান সৈন্যদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। তাই মোগল সাম্রাজ্যের ভূত শিখদের বেশকিছুটা তাড়া করেছিল। দ্বিতীয়ত, ইঙ্গ-শিখ একাধিক যুদ্ধে যেহেতু শিখরা হিন্দুস্তানী অংশের যথেষ্ট সাহায্য পায়নি বলে মনে করত, সেহেতু সিপাহী বিদ্রোহে তার শোধ তুলতে চেয়েছিল বলেও অনেকে মনে করেন।
আরো পড়ুন অগ্নিপথ: বেকারত্বের আগুন নেভাতে পারছে না জাতীয়তাবাদ
যা-ই হোক, এর কোনোটাই ভালো যুদ্ধ করতে পারা বা না পারার ব্যাপার নয়। সরকারের পক্ষে থাকা বা না থাকার ব্যাপার। অর্থাৎ কারণটা রাজনৈতিক। কিন্তু প্রশ্ন হল, স্বাধীন দেশের স্বাধীন সরকার কেন কারা সিপাহী বিদ্রোহে ইংরেজদের পক্ষ নিয়েছিল আর কারা নেয়নি তার ভিত্তিতে সেনাবাহিনী চালাবে?
ইংরেজরা মনে করেছিল, গোষ্ঠীর নামে রেজিমেন্টের নামকরণের ফলে সৈনিকরা বেশি অনুপ্রাণিত হবে, বেশি ভাল করে লড়াই করবে। কিন্তু দেশভক্তির পূজারী ভারত সরকার কোন যুক্তিতে জাতের নামে, ধর্মের নামে রেজিমেন্ট চালায়? কেন রাজপুতানা রাইফেলস নামে রেজিমেন্ট চলবে, আর কেনই বা ভীম আর্মি চামার রেজিমেন্ট পুনরায় চালু করার দাবি তাদের দাবিসনদে রাখবে? আশ্চর্য রাজনীতি! আম্বেদকর বলেছিলেন সকল জাতিবর্ণের বিলোপের কথা, বর্ণব্যবস্থার সমূল উৎপাটনের কথা, আর নব্য আম্বেদকরবাদীরা জাতিব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে কোন ফায়দাটা পাওয়া যায় সেই রাজনীতিতে নিমগ্ন। এ-ও এক মহা পরিহাস। এই রাজনীতি কীভাবে মনুবাদী ভারতীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়বে? কীভাবেই বা সে আম্বেদকরের স্বপ্নকে সফল করবে?
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।