আসামের নতুন মুখ্যমন্ত্রী হলেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা। সাধারণভাবে দেখলে, একটাই অস্বাভাবিকতা। একটি সরকার পুনর্নির্বাচিত হয়েও নিজের মুখ্যমন্ত্রীকে ফের আসনে বসাল না। অথচ মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের বিরুদ্ধে দল বা জনগণ, কারোরই কোনো আলাদা অভিযোগ ছিল না। একে কেউ কেউ বলছেন হিমন্ত বিশ্বশর্মার বুদ্ধিদীপ্ত রাজনৈতিক কৌশলের জয়। কিন্তু বিষয়টা কি শুধু দুজন ব্যক্তির চেয়ার দখলের দৌড়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? আসলে এই নিয়ে পরিবর্তন আসামের রাজনীতির একটি বড় পরিবর্তনকে সূচিত করছে। কী সেই পরিবর্তন? স্বাধীনতার পর থেকেই আসামের শাসকশ্রেণির রাজনীতি হচ্ছে ভাষিক উগ্রতার রাজনীতি। কিন্তু এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আসামের রাজনীতির একটি চূড়ান্ত ভোলবদল হল। এখন শাসক রাজনীতির ভাষা পুরোপুরি হিন্দুত্বের কূলে ভিড়েছে। এমন অভিমতের কারণ কী?

প্রকৃতপক্ষে গত ২০০ বছর ধরেই আসামের রাজনীতির প্রধান সুর ভাষিক উগ্রতার। আরো স্পষ্ট করে বললে, এই ভাষিক উগ্রতা আবর্তিত হচ্ছে আসামের বাঙালিদের ঘিরে। আসামে বাঙালিরা কতটা স্থানীয়, কতটা বহিরাগত। কতটা বাঞ্ছিত, কতটা অবাঞ্ছিত। তাদের কোন কোন অধিকার প্রাপ্য এবং কোন কোন অধিকার পরিত্যাগ করতে হবে — এই নিয়েই গত ২০০ বছরের আসামের রাজনীতি। বিষয়টা এত সহজ সরল হলে আসামে একটি ‘আমরা বাঙালি’ বা তাদের আধুনিকতম সংস্করণ ‘বাংলাপক্ষ’ যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে যায়। বিষয়টি জটিল এবং সুদীর্ঘ ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। ‘আসামের বাঙালি’ এই অভিধাটিও বিচিত্র। ধর্ম বা জাতের পরিচয় উপেক্ষা করেও আসামের বাঙালিরা চারটি গোত্রের। এক, যারা ১৮২৬ সালে আসামে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলা থেকে আসামে এসেছিল। দুই, যাদের উনবিংশ শতকের শেষ থেকে ব্রিটিশ প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ময়মনসিংহ জেলা থেকে আসামের অনাবাদী জমিতে চাষ করার জন্যে বসত দেওয়া হয়েছিল। তিন, যে বাঙালিরা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে আসামে এসেছে। চার, ব্রিটিশ সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বঙ্গদেশের যে সমস্ত অঞ্চলকে আসামের সাথে যুক্ত করা হয় সেই বাঙালিরা।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

প্রথম তিনটি গোত্রের ক্ষেত্রে আসামে আগমনের কথা বলা গেলেও চতুর্থ বর্গের ক্ষেত্রে সেটা বলা সম্ভব নয়। কারণ সেখানে মানুষ আসেনি, মাটিই চলে এসেছে আসামে। এই বাঙালিদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান দুইই আছে। প্রথম ও তৃতীয় গোত্রে প্রধানত বাঙালি হিন্দুরা। দ্বিতীয় গোত্রে মযমনসিংহের বাঙালি মুসলিম কৃষকেরা। চতুর্থ গোত্রে, হিন্দু ও মুসলমান দুইই আছে। প্রথম গোত্রের যে বাঙালিরা এসেছিল আজ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এদের সিংহভাগই অসমিয়া জাতিসত্তার সাথে মিশে গেছে। এই মুহূর্তে আসামে তাদের পরিচয় অসমিয়াভাষী হিসাবেই। তাদের পদবি ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে তাদের বাঙালি অতীতকে নির্দিষ্ট করা অসম্ভব। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই পরিচিতি বদল পৃথিবীর সর্বত্রই ঘটে। এটাই সভ্যতার নিয়ম। কিন্তু আসামের ওই প্রথম গোত্রের বাঙালি আগন্তুকদের ঘিরেই শুরু হয়েছিল আসামে বাঙালি বিরূপতা বা বাঙালি বিদ্বেষের রাজনীতি।

ব্রিটিশরা আসাম অধিগ্রহণের পরই তাকে যুক্ত করেছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাথে। প্রশাসন পরিচালনার প্রয়োজনে বঙ্গদেশ থেকে নিয়ে এসেছিল বাঙালি আমলা ও কেরানিদের। এদের পিছন পিছন বঙ্গদেশ থেকে মোক্তার ডাক্তার ব্যবসায়ী মহাজনেরাও হাজির হয় ভাগ্যান্বেষণে। বর্মীদের আক্রমনে জর্জরিত আসামের মানুষ চেয়েছিল ব্রিটিশ সরকার এদের তাড়িয়ে দিক। কিন্তু নিজেদের রাজার পরিবর্তে বিদেশি শাসকের রাজত্বে তারা খুশি ছিল না। চোখের সামনে শাসকদের পেত না, পেত তাদের বাঙালি প্রতিনিধি কেরানি, আমলাদের। ফলে যত অসন্তোষ সব গিয়ে পড়ল বাঙালিদের ওপর।

এর কিছুদিন পরে ১৮৩৭ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন আসামের সরকারি কাজে বাংলা ভাষার প্রচলন করে এবং বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকেই শিক্ষার মাধ্যম করে দেয়। সেইসময় সারা দেশ জুড়েই সরকারি কাজে ফার্সি ভাষা সরিয়ে স্থানীয় ভাষা প্রবর্তন করা হয়। আসামে এই সিদ্ধান্তের অর্থ অন্যরকম দাঁড়াল। এখানে মুঘল শাসন ছিল না, ফলে ফার্সিও ছিল না। অহোমদের রাজসভার কাজকর্ম হত অসমিয়া ভাষাতেই। এখন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অংশ হওয়ায় স্থানীয় ভাষা হিসাবে বাংলার প্রচলন হল মানে স্থানীয় অসমিয়া ভাষা অপসারিত হল, বহিরাগত বাঙালিদের ভাষা চেপে বসল। এই সিদ্ধান্ত অসমিয়া সমাজে বিরাট আলোড়ন তোলে। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে দিকে দিকে। অসমিয়া সমাজের ধারণা হল, এই সিদ্ধান্ত হয়ত বাঙালি আমলাদের প্ররোচনাতেই হয়েছে। ফলে বাঙালি বিদ্বেষও দানা বাঁধতে থাকল। সাম্প্রতিক সময়ে অসমিয়া বুদ্ধিজীবীদেরই কয়েকজন গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে ব্রিটিশদের ওই সিদ্ধান্তে বাঙালি আমলাদের কোন ভূমিকা ছিল না। অসমিয়া সমাজের তীব্র প্রতিবাদের জেরে ১৮৭২ সালে আসামের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বাংলা ভাষাকে সরিয়ে অসমিয়া ভাষার পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। সাড়ে তিন দশকের এই পর্বটির কালো ছায়া আজও অসমিয়া সমাজমানসে গভীরভাবে ছায়া ফেলে রেখেছে। একে বলা হয় “অসমিয়া ভাষার অন্ধকার পর্ব”। এই আতঙ্ক এখনো তাড়া করে ফেরে অসমিয়া সমাজকে। এনআরসি হোক আর সিএএ হোক, সমাজের গভীরে সবসময় একটি ভয় থেকে যায় — আবার না সেই অন্ধকার পর্ব ফিরে এসে অসমিয়াদের নিজ দেশে পরবাসী করে দেয়।

কেউ ভাবতে পারেন, কবেকার মাত্র ৩৫ বছর সময়পর্বের ব্রিটিশ রাজের একটি সিদ্ধান্ত, তার ভূত এখনও কেন আধুনিক সময়ের মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়! আসলে তারপরও পর পর আরো কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার যার অভিঘাত ওই আতঙ্ককে দীর্ঘায়ু করেছে। ১৮৭৪ সালে বঙ্গদেশ থেকে আসামকে বিযুক্ত করে গঠিত হল আসাম প্রদেশ। কিন্তু আসামের রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করতে তার সাথে জুড়ে দেওয়া হল বঙ্গদেশ থেকে নেওয়া গোয়ালপাড়া, সিলেট ও কাছাড়কে। বর্মী আক্রমণের ফলে আসামের জনসংখ্যা অস্বাভাবিক হ্রাস পেয়েছিল। তাছাড়া এমনিতেও আসাম ছিল হালকা জনবসতির রাজ্য। বিপুল জনসংখ্যার বঙ্গদেশের এই অংশগুলিকে আসামের সাথে যুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যার ভারসাম্যে পরিবর্তন এল বাঙালিদের দিকে। অসমিয়া সমাজ আবারও আতঙ্কিত হল। বড়লাট এসে প্রবোধ দিলেন, অসমিয়াদের কোন ক্ষতি হবে না।

উনবিংশ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশ সরকার আরেকটি সিদ্ধান্ত নেয় যার সুদূরপ্রসারী ফলাফলে এখনো রক্তপাতের শেষ নেই আসামে। আসামের ধর্মীয় রাজনীতির উৎসও লুকিয়ে আছে সেই সিদ্ধান্তে। আসামের স্থানীয় মানুষ জলাজমিতে চাষ করতে জানতেন না। ফলে রাজ্যের খাদ্য উৎপাদন সম্ভাবনার তুলনায় অপ্রতুল ছিল। সেই সময়ে ময়মনসিংহ জেলায় জমির ওপর জনসংখ্যার চাপ ছিল মাত্রাতিরিক্ত। ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিল ময়মনসিংহের পরিশ্রমী বাঙালি মুসলমান কৃষকদের আসামের অনাবাদী জমিতে বসতি দেওয়ার। এই সিদ্ধান্তে আসামের খাদ্য উৎপাদনে বিরাট বৃদ্ধি এল।

এর হাত ধরে যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল তাতে খুশি হয়ে অসমিয়া মধ্যবিত্ত সমাজ প্রাথমিকভাবে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিল। প্রথম দশ বছরে ৫০,০০০ বহিরাগত থেকে তিনটি দশক পর এই সংখ্যা ৫,৭৫,০০০-এ পৌঁছতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল আসামের স্থানীয় সমাজে। তাঁরা ভাবলেন, এভাবে জনসংখ্যা বাড়লে নিজ দেশে অচিরেই পরবাসী হয়ে যাবেন। এখান থেকেই শুরু হল সংগঠিতভাবে বাঙালি বিরোধিতার রাজনীতি। সংগঠন গড়ে উঠল। দাবি উঠল, বঙ্গদেশ থেকে বাঙালি কৃষকদের আগমন কুড়ি বছরের জন্যে বন্ধ করে দিতে হবে। সিলেটকে আবার বাংলায় ফিরিয়ে দিতে হবে। এমনকি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের আওয়াজও উঠল। এর আগে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে একটি প্রদেশ গঠিত হলে জনসংখ্যার বিচারে বাঙালি মুসলমানরা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেন। কৃষকদের অধিকারের রাজনীতি ও মুসলিম লিগের রাজনীতি হাত ধরাধরি করে এগোতে থাকল।

ইতিমধ্যে পরিষদীয় রাজনীতিতে ভারতীয়দের অংশগ্রহণের পর্ব শুরু হতেই অসমীয়া-বাঙালি, হিন্দু-মুসলিম প্রতিদ্বন্দ্বিতার রাজনীতি দানা বাঁধতে শুরু করল। ধর্ম ও ভাষার দ্বন্দ্ব, বিরোধের রাজনীতি নানা বিচিত্র পথে এগোতে থাকল। বাঙালির রাজনীতি ক্রমেই হিন্দু-মুসলিম চেহারা নিতে থাকলেও অসমীয়া রাজনীতি বাঙালি বিরোধিতার মধ্যেই প্রধানত আবর্তিত হতে থাকল। দেশভাগ অনিবার্য হয়ে উঠলে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিম রাজনীতির চেহারা বদলে গেল। ১৯০৫ সালে সিলেটের হিন্দুরা চেয়েছিলেন সিলেট বঙ্গদেশে ফিরে যাক, মুসলিমরা চেয়েছিলেন আসামে থাকুক। দেশভাগ ঘনিয়ে আসতেই হিন্দুরা চাইলেন সিলেট আসামে থাকুক, মুসলিমরা চাইলেন সিলেটে বঙ্গদেশে ফিরে যাক। আসলে তখন আসাম আর বঙ্গদেশ দুটি পক্ষের কাছে নাম বদলে হিন্দুস্থান আর পাকিস্তান হয়ে গেছে।

আসামের অসমিয়া রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাঁদের সহকর্মী বাঙালি কংগ্রেসীদের বিরুদ্ধে গিয়েই চাইলেন শুধু সিলেট নয়, সমস্ত বঙ্গভাষী অঞ্চলই পাকিস্তানে চলে যাক। দেশভাগ ঠেকানোর শেষ প্রচেষ্টা হিসাবে ১৯৪৬ সালে যে ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব এসেছিল, তা-ও বাতিল হয় আসামের অসমিয়া কংগ্রেস নেতাদের পীড়াপীড়িতেই। তাঁদের ভয় ছিল ওই প্রস্তাবে আসাম ও বাংলাকে যে অভিন্ন গ্রুপিং-এ রাখার কথা বলা হয়েছে তা আসামকে কার্যত বাংলার অধীন করে ফেলবে। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতায় সিলেট পাকিস্তানে চলে গেলেও কাছাড় ও গোয়ালপাড়া আসামেই থেকে গেল। স্বাধীনতার ঠিক পরেই যে আসাম বিধানসভার অধিবেশন বসে সেখানে রাজ্যপাল তাঁর আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে ব্রিটিশের অধীনতা থেকে মুক্তির জন্যে যতটা আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি করেছিলেন সিলেটর পাকিস্তানভুক্তিতে। খোলাখুলিই বলেছিলেন, এখন আর বাঙালিরা আমাদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারবে না। তবে সতর্ক থাকতে হবে কারণ কাছাড় ও গোয়ালপাড়া আসামেই থেকে গেল। ১৯৫১ সালের জনগণনার সময় ময়মনসিংহ মূলের বাঙালি মুসলমান কৃষকদের বলা হল, নিজেদের অসমিয়াভাষী হিসাবে নথিভুক্ত করতে হবে, নয়ত এ দেশ থেকে চলে যেতে হবে। একটি ভাষাগোষ্ঠীর ভাষিক পরিচয় পরিবর্তন অভিযানকে প্রায় সরকারি কর্মসূচি করে ফেলা হল। কখনো ভয় দেখিয়ে, কখনো প্রলোভন দিয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত বাঙালি মুসলমানদের সার্বিকভাবে অসমিয়াভাষী হিসাবে নথিভুক্ত করা হল। উদ্দেশ্য ছিল দ্বিবিধ। এক, ১৯৩১ সালের জনগণনায় ৩১% অসমিয়াকে সংখ্যাগুরু হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। দুই, বাঙালি সমাজের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন এনে বাঙালিদের তরফে কোন ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া।

এখান থেকেই আসামের রাজনীতি ভাষিক উগ্রতার সাথে ধর্মের উপাদান ভিন্নভাবে যুক্ত করে নিল। পরিবর্তিত পরিচিতির বাঙালি মুসলিমদের নতুন নাম দেওয়া হল ন-অসমিয়া মানে নতুন অসমিয়া। এরপর ১৯৬০ সালে আসামে রাজ্য ভাষা আইনের মাধ্যমে যখন একমাত্র অসমিয়া ভাষাকেই সরকারি ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার আন্দোলন শুরু হয়, সেখানে সামনের সারিতে নিয়ে আসা হয় এই ন-অসমিয়াদের। এই আন্দোলন অচিরেই “বঙাল খেদা” নাম নিয়ে বাঙালিদের উপর সহিংস আক্রমণে পরিণত হল। এই হিংসাত্মক ঘটনায় সামনে ঠেলে দেওয়া হল বাঙালি মুসলিমদের এই ভাষান্তরিত অংশকে। এর প্রতিবাদে তৎকালীন অবিভক্ত কাছাড়ে (আজকের বরাক উপত্যকা) যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয়, তখন সেখানেও বাঙালি মুসলিমদের ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা হয়েছে। তবে কাছাড়ে সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

মজার কথা, আসামের বঙাল খেদাকেও কেউ কেউ ভাষা আন্দোলন বলেন। কোন কোন বামপন্থী সমতা দেখাবার ছলে কাছাড়ের ভাষা আন্দোলন ও ব্রহ্মপুত্রের ভাষা দাঙ্গা — দুটোকেই একইভাবে ভাষা আন্দোলন বলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও অন্যের ভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার দাবিকে ভাষা আন্দোলন বলা হয় বলে জানি না। বরাক আর ব্রহ্মপুত্রের ভাষার দাবি চরিত্রগতভাবেই আলাদা। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার দাবি ছিল সবার উপর অসমিয়া ভাষা চাপাতে হবে। এবং এর জন্যে খোলাখুলিভাবে হিংসাত্মক ঘটনার সৃষ্টি করা হয়। উল্টোদিকে, বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রাম ছিল প্রত্যেকের মাতৃভাষার অধিকারের। কোন ধরনের ভাষা দাঙ্গার ঘটনা বরাক উপত্যকায় শহীদের মৃত্যুর পরও ঘটেনি।

আসামের অসমিয়া উগ্রতার রাজনীতির সাথে বাঙালি মুসলিমদের একটি বিশেষ অংশের সম্পর্ক ছিল, এ ছাড়া স্থানীয় অসমিয়া মুসলিম সমাজও অসমিয়া জাতীয়তাবাদের দ্বারা যথেষ্টই অনুপ্রাণিত ছিল। তাই আসামের শাসকশ্রেণির রাজনীতি বাঙালি বিরোধিতার বাইরে কখনো মুসলিম বিরোধিতার পথে হাঁটেনি। এই বদল ঘটানোর প্রচেষ্টা শুরু হল ১৯৭৯ সালের বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলনের সময় থেকে। একদিকে আসাম বিধানসভায় ২৫টি আসন পেয়ে বামপন্থীরা একটি উল্লেখযোগ্য শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। অন্যদিকে কেন্দ্রে ক্ষমতায় তখন জনতা সরকার, যার প্রধান শরিক আরএসএস-এর অঙ্গ জনসঙ্ঘ। হঠাৎ করে আত্মপ্রকাশ করা আন্দোলন প্রথম থেকেই ছিল বামপন্থীদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্টভাবে আক্রমণাত্মক। এতে কলকাতা থেকে আনন্দবাজারের সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্তেরও উসকানি ছিল। তিনি লিখেছিলেন, আসামে সিপিএমের বিজয় বাঙালিদের আধিপত্যের বার্তা বহন করে। আনন্দবাজারের ওই সংখ্যার বহ্ন্যুৎসব দিয়েই আসাম আন্দোলনের সূচনা। এই প্রথম বামপন্থীরা আসামে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হলেন এভাবে।

প্রথমে দাবি ছিল, সমস্ত বহিরাগত বহিষ্কারের। আরএসএস চুপিসাড়ে এই আন্দোলনের পিছনে দাঁড়াতেই বহিরাগত শব্দটা পাল্টে বিদেশী হয়ে গেল। আন্দোলনকারীদের কাছে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষ মাত্রেই বিদেশী। তাঁরা বললেন ১৯৫১ সালের পর যারাই এসেছে সবাইকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে হবে। আরএসএস ধীরে ধীরে হাওয়ায় ভাসাতে লাগল অনুপ্রবেশকারী ও শরণার্থী তত্ত্ব। খুব একটা গৃহীত হল না। তবে ধীরে ধীরে মুসলিম বিদ্বেষ দানা বাঁধতে থাকল। নেলিতে মোকালমুয়ায় সেই মুসলিমরা গণহত্যার বলি হল, যারা কয়েক দশক আগে নিজেদের ভাষিক পরিচয় দিয়েছিল অসমিয়া হিসাবে।

এরপর থেকেই আসামের রাজনীতি হিন্দুত্ব আর উগ্র ভাষিক বিদ্বেষের হাত ধরাধরি করে চলেছে। বিজেপি বরাক উপত্যকায় বাঙালি হিন্দুর ত্রাতা হিসাবে হাজির হলেও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় হিন্দুত্ব ও উগ্র অসমিয়া ভাষিকতার মধ্যে একটা ভারসাম্য রেখে চলছিল। ক্রমে আসামের রাজনীতি থেকে বিদেশী শব্দটি বিদায় হয়ে হাজির হল বাংলাদেশী। চিরাং চাপোরি নামে একটি সংগঠন লিফলেট বার করে বলল, কোনো বাংলাদেশীকে ঘর ভাড়া দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশীর দোকান থেকে কিছু কেনা যাবে না, তাদের সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে। বাংলাদেশী কারা? যাদের মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি, কথায় পূর্ববঙ্গীয় টান। তুচ্ছার্থে তাকে বলা হল ‘মিয়া’। স্থানে স্থানে আক্রমণ, লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটতে থাকল। এই মানুষগুলো মাতৃভাষা ত্যাগ করেছিল। ফলে বাঙালি হিসাবে দাঁড়াবার কোন জায়গা ছিল না। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাঙালি ও হিন্দু সমার্থক হয়েই গিয়েছিল। অসমিয়া জাতীয়তা এদের পরিত্যাগ করেছে। ঘুরে দাঁড়াবার জন্যে একটাই পরিচিতি ছিল, সেটা ধর্মের।

এভাবেই এআইইউডিএফের জন্ম। আসামের রাজনীতিতে বদরুদ্দিন আজমলের আত্মপ্রকাশ। আজমল একদিনের জন্যেও বাঙালিত্বে ফিরে যাবার কথা বলেন নি। তবু তাঁকে অসমিয়া জাতীয়তাবাদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করা হল। একদিনের জন্যেও হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে বা হিন্দু জনগণের বিরুদ্ধে কোন কথা বলেননি। তবু বলা হল আজমল একজন সাম্প্রদায়িক নেতা। অসমিয়া ও বাঙালি হিন্দুদের ভয় দেখানো হল — আজমল আজ হোক, কাল হোক, আবার বাঙালি মুসলমানদের বাঙালি হিসাবে নাম লেখাতে বলবে, তারপর বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে ইসলামিক বাংলাদেশের সাথে আসামের সংযুক্তির কথা বলবে। এভাবে অসমিয়া জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দুত্ব একটি অভিন্ন মঞ্চ পেয়ে গেল, যার নাম আজমল বিরোধিতা।

এদিকে সংখ্যালঘুদের রক্ষাকবচ আইএমডিটি আইন সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে বাতিল করিয়ে সর্বানন্দ সোনোয়াল আসামে জাতীয় বীরের সম্মান পেয়ে গেলেন। এক অদ্ভুত রাজনৈতিক কৌশলে আজমল জুজু সামনে এনে অসমিয়া জাতীয়তাবাদের সাথে সমস্ত জনগোষ্ঠী ও বাঙালি হিন্দুদের এক অভিন্ন জায়গায় ঐক্যবদ্ধ করা হল ২০১৬-র নির্বাচনে। সর্বানন্দ ও এনআরসিকে মুখ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অসমিয়া জনমত সঙ্গে নেওয়া হল। বরাক উপত্যকায় বলা হল এনআরসি অনুপ্রবেশকারী মুসলিমদের বিরুদ্ধে। হিন্দুদের জন্যে নতুন আইন আসছে। অসমিয়া জাতীয়তাবাদের মুখোশ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় দেখিয়ে ২০১৬ সালে বিপুল বিজয পেলো বিজেপি। সেই জাতীয়তাবাদের নয়নমণি সর্বানন্দকে করা হল মুখ্যমন্ত্রী।

পাশাপাশি গত পাঁচ বছর ধরে হিন্দুত্বের পোস্টার বয় হয়ে ছিলেন কংগ্রেস ছেড়ে আসা হিমন্ত বিশ্বশর্মা। সর্বক্ষণ উগ্র মুসলিম বিরোধিতার প্রচার করে অসমিয়া সমাজে জাতীয়তাবাদের আবেগকে তিনি ধীরে ধীরে পরিণত করেছেন মুসলিম বিদ্বেষে। অসমিয়া সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যেও মান্যতা পেতে শুরু করল অনুপ্রবেশকারী ও শরণার্থী তত্ত্ব। অন্যদিকে বিজেপির রাজনীতি বরাক উপত্যকাতেও ভাষার আবেগকে দুর্বল করে সর্বগ্রাসী করে তুলল মুসলিম বিদ্বেষকে। এখন বরাক উপত্যকায় খোলাখুলি বক্তব্য রাখা হয়, উনিশের ভাষা আন্দোলন ভুলে যাওয়ার সময় হয়েছে। সরকারি ভাষা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে বরাকে অবাধে চলছে অসমিয়াকরণ।

এইভাবে পাল্টে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এবং বরাক উপত্যকার আসামে এখন আর সর্বানন্দ নামক আড়ালের কোন প্রয়োজন নেই। ফলে তার অপসারণ ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। ক্ষুরধার বুদ্ধির হিমন্ত নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যে শুধু প্রার্থী নির্বাচনে নিজের পছন্দের লোকেদেরই নিয়ে আসেন নি। নিজেকে এই অনিবার্য পরিবর্তনের পুরোহিত হিসাবেও গড়ে তুলেছেন বিগত পাঁচটি বছর ধরে। হিমন্ত বিশ্বশর্মার মুখ্যমন্ত্রী পদে অভিষেক আসলে উগ্র অসমিয়া ভাষিকতার ওপর হিন্দুত্বের চূড়ান্ত বিজয়।

এতে আসামের জন্যে কোন নতুন সূর্যের উদয় হবে না। তবে অন্ধকারের এক নতুন পর্বের সূচনা হবে।

লেখক সাংস্কৃতিক কর্মী, মতামত একান্ত ব্যক্তিগত

আসাম, বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল ও নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা – চিত্র Wikipedia-র সৌজন্যে।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.