গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির অভূতপূর্ব জয় জাতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জয়জয়কার হিসাবে আবার সোচ্চারে ঘোষিত হয়েছে। তাঁর নিজের রাজ্য হওয়ায় গণমাধ্যমের বাড়তি উৎসাহ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তদুপরি যেভাবে পূর্বতন সব রেকর্ড ভেঙে বিধানসভার ৮৫% আসন তারা দখল করেছে, তা খানিক বিস্ময়ের জন্ম দেয় বইকি। টানা ছবার ক্ষমতায় ফেরা – ২৬টা লোকসভা আসনওয়ালা একটা মোটামুটি বড় রাজ্যে – গত ৫০ বছরে এর থেকে বড় সাফল্যের উদাহরণ বাংলায় বামেদের টানা সাতবার ক্ষমতায় ফেরা ছাড়া আর কী আছে? একাই ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জেতার থেকে বেশি দাপট দেখানো আর কিসে হয়?
যেমনটা আশা করা গিয়েছিল, মোদী-শাহ মডেলের আঁতুড়ঘর, হিন্দুত্বের প্রথম ল্যাবরেটরি গুজরাটে বিজেপির প্রচার চলেছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের লাইনেই। এই প্রচার যে গুজরাট রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ পছন্দ করেন তাও দেখাই যাচ্ছে। কংগ্রেস থেকে পালটি খাওয়া বিজেপি বিধায়ক সিকে রাউলজি, যিনি বিলকিস বানোর ধর্ষক ও তাঁর পরিজনের খুনিদের “সংস্কারি” বলেছিলেন, তিনিও জিতেছেন গোধরা থেকে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
গুজরাট নিয়ে এই হইচইয়ের মধ্যে অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে হিমাচলে বিজেপির পতন। একথা ঠিক যে হিমাচল ছোট রাজ্য, মাত্র চারটে লোকসভা আসন। তবু হিন্দুত্ববাদী প্রচার তো সেখানেও হয়েছে। বিজেপির জাতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডার রাজ্য। একদিকে বিজেপি, অন্যদিকে আম আদমি পার্টির সাঁড়াশি আক্রমণে বিপর্যস্ত কংগ্রেসের হাতে এখানে বিজেপি শাসনের অবসান কি কোনো বার্তাই দেয় না?
এই পরিপ্রেক্ষিতেই দেখা প্রয়োজন সাম্প্রতিক দিল্লি পুরনির্বাচনকে। দিল্লিতে বিজেপি গত কয়েকবছর ধরেই চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক প্রচার করেছে – লোকসভা, বিধানসভা, পুরসভা – যে কোনো নির্বাচনেই। বিধানসভায় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের পার্টির সঙ্গে পেরে না উঠলেও লোকসভা ও পুরসভায় তার জয়যাত্রা বজায় থেকেছে। আম আদমি পার্টি এক দিকে পরিষেবামূলক রাজনীতিতে বিজেপিকে টেক্কা দিয়েছে, অন্যদিকে তার চেয়েও বড় হিন্দু হয়ে উঠতে চেয়েছে। একটাই পার্থক্য – তারা মুসলিমদের পাশে দাঁড়ায়নি, আবার বিদ্বেষমূলক মন্তব্যও করেনি। এখন পুরসভায় বিজেপিকে ধাক্কা দিয়ে তারা দেখিয়ে দিল যে তারা কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়েরই ক্ষতি করতে পারে – কখন, কোথায়, কার ভোটে থাবা বসাবে বলা মুশকিল।
তাছাড়া উত্তরপ্রদেশেও কিন্ত সমাজবাদী পার্টি প্রয়াত মুলায়ম সিং যাদবের মৈনপুরী লোকসভায় নিজেদের ভোট অনেকটা বাড়িয়েছে। দুটো বিধানসভা উপনির্বাচনের একটা বিজেপি সমাজবাদী পার্টির থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে, আরেকটা বিজেপির থেকেই ছিনিয়ে নিয়েছে রাষ্ট্রীয় লোক দল। সব রাস্তাই এখনো পদ্মবাগানে যাচ্ছে না। এখনো।
এই হিসেবের বাইরে যা রইল, আবার দেখা গেল বিজেপি ও মোদী-শাহ জুটি অপয়াজেয় নয়। হিমাচল ও দিল্লির মানুষ উগ্র হিংসার রাজনীতির বদলে অন্যকিছু বেছে নিয়েছেন। ‘মোদী ম্যাজিক’ সব জায়গায় কাজ করছে না।
আরো পড়ুন বিলকিস বানো: ছাত্রীর সঙ্গে অসমাপ্ত আলোচনা
এই সাম্প্রতিক নির্বাচনের কী প্রভাব পড়তে পারে আগামী বছরের নির্বাচনগুলোতে? গুজরাটে আম আদমি পার্টির ফল তাদের উচ্চগ্রাম প্রচারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় মধ্য ভারতের মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিসগড়ে আগামী বছরের নির্বাচনে তাদের পক্ষে কংগ্রেসের বাড়া ভাতে ছাই দেওয়ার সম্ভাবনা কম। গুজরাট রাজ্যে কংগ্রেসের কাছাকাছি ভোট পেলে সে সম্ভাবনা থাকত। কিন্তু আপাতত এই দুই রাজ্যে সরাসরি বিজেপি বনাম কংগ্রেস লড়াই হবে ধরে নেওয়া যায়। হিমাচলে ক্ষমতায় ফেরার ফলে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়ে নিশ্চয়ই কংগ্রেসের মনোবল একটু হলেও চাঙ্গা হবে।
গুজরাটের পার্শ্ববর্তী রাজ্য রাজস্থানেও ভোট আগামী বছর। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জীর্ণ কংগ্রেসের বিকল্প হিসাবে নিজেদের তুলে ধরার চেষ্টা করছে আম আদমি পার্টি। বিজেপি চেষ্টা করছে ক্ষমতায় ফেরার। গুজরাটে আরেকটু ভাল ফল হলে রাজস্থানেও কেজরিওয়ালের পালে হাওয়া লাগতে পারত। তবু ১২ শতাংশ ভোট আর চারটে আসন তৃণমূলের গোয়া অভিযানের মত নেহাত ফেলনা নয়। তাই আগামীদিনে রাজস্থানে আপের বৃদ্ধি হলে তা কংগ্রেস না বিজেপি, কার ক্ষতি করবে সেই নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যায়।
তবে সবচেয়ে বড় যে বার্তা এই ফলাফল দিল বলে মনে হয়, তা হল এদেশে কোনো একটা নির্দিষ্ট মডেল সর্বত্র সফল হচ্ছে না। বিরোধীদের পক্ষে এটা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।