“In its anxiety to suppress dissent, in the mind of the State, the line between the constitutionally guaranteed right to protest and terrorist activity seems to be getting somewhat blurred” – The Hon’ble Delhi High Court (Natasha Narwal vs. State of Delhi NCT)

শিরোনাম

গত ১৬ই জুন তারিখেই মহামান্য দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি সিদ্ধার্থ মৃদুল এবং জয়রাম ভাম্বানির রায়ে, ৫০,০০০ টাকা ব্যক্তিগত বন্ডে, আপাতত জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেলেন গত বছরের ২৩শে মে, কোভিড-১৯ সংক্রান্ত লকডাউনের মধ্যেই গ্রেপ্তার হওয়া, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ও জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী নাতাশা নারোয়াল, দেবাঙ্গনা কলিতা ও আসিফ ইকবাল তানহা। কিছু টালবাহানার পর তাঁরা শেষ অব্দি জেল থেকে মুক্তি পান গত ১৭ই জুন। মহামান্য দিল্লি হাইকোর্টের রায়গুলি থেকে আবারও স্পষ্ট হয় যে কিভাবে এই ছাত্রছাত্রীদের  বিরুদ্ধে আইপিসির ভুল ধারায় মামলা রুজু করেছিল দিল্লি পুলিশ এবং দানবীয় ইউএপিএ আইনের বিভিন্ন ধারা যুক্ত করা হয়েছিল এদের কেসে, যাতে আরো অনেকদিন এদের জেলের ভিতরেই রাখা যায়, যাতে তারা কোনওভাবে কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত হতে না পারে। দিল্লি হাইকোর্ট স্পষ্টভাবেই বলেছে “চার্জশিটে এমন কিছুই নেই যা থেকে এমন কোনও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, যার বিচার ইউএপিএ আইনের কোনও ধারায় হতে পারে”।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

উপসংহার 

রায়টি বর্তমানে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন, এবং রায়ের যথার্থতা নিয়ে শীঘ্রই চর্চা ও আলোচনা শুরু হবে সেখানে। সুপ্রিম কোর্টের আদেশানুসারে, দিল্লি হাইকোর্টের এই রায় এখন বহাল থাকলেও, অন্য কোনও মামলায় প্রিসিডেন্স হিসেবে গণ্য হবে না এখনই।

চরিত্র

 নাতাশা নারোয়াল জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এমফিল-পিএইচডির ছাত্রী, ইতিহাস নিয়ে পড়ছেন। দেবাঙ্গনা কলিতা পিএইচডি করছেন উইমেন্স স্টাডিজ নিয়ে, ওই জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। আর আসিফ ইকবাল তানহা ফারসি ভাষা নিয়ে পড়ছেন জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। এঁদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, নাতাশা ও দেবাঙ্গনা এনআরসি-বিরোধী আন্দোলনের সময়, বিভিন্ন গ্ৰুপের (মূলত জামিয়া কো-অর্ডিনেশন কমিটি আর পিঞ্জরা তোড়) সাথে যুক্ত হয়ে, প্রথমে ওই আইনগুলো নিয়ে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ভয় পাওয়ায় এবং তারপর, দেশদ্রোহী এক বৃহৎ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে, দিল্লির মুসলিম জনগোষ্ঠীর লোকেদের দাঙ্গা করবার জন্য উস্কানি দেয়। আসিফ নাকি ওই দাঙ্গার একজন মাস্টারমাইন্ড, যিনি ওই বৃহৎ দেশদ্রোহী কর্মকান্ডের পুরোধা ছিলেন এবং দাঙ্গা কিভাবে ছড়ানো যায় তা পুরোটা প্ল্যান করেন উক্ত গ্রুপগুলির মাধ্যমে। অর্থাৎ সংক্ষেপে এদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ রাষ্ট্রদোহ বা দেশদ্রোহিতা। এক কথায়, সিডিশন।

পাদটীকা

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত কয়েকজন ছাত্রী মিলে তৈরি করে ছাত্রীদের একটি সংগঠন, নাম ‘পিঞ্জরা তোড়’, যার ইংরেজি অর্থ “ব্রেকিং দি কেজ” আর বাংলায় “খাঁচা ভেঙে দাও”। বাইরে থেকে দিল্লিতে পড়তে আসা ছাত্রীদের সাধারণত হোস্টেলে ও পিজিতেই থাকতে হয়। প্রাথমিকভাবে তাদের বিভিন্ন দাবি দাওয়ার দাবিতেই ওই সংগঠন তৈরি হলেও, পরবর্তীকালে কিছু ছাত্রী মিলে দিল্লির বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ, প্রতিকার ও নিষিদ্ধকরণ করার পক্ষে লড়তে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। দিল্লির আশপাশের প্রায় সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে, যেমন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া-মিলিয়া ইসলামিয়া, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, লেডি শ্রীরাম কলেজ, সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ, আম্বেদকর বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব শিগগির ছড়িয়ে পড়ে এই সংগঠন। ক্রমশ এই আন্দোলনের ঢেউ পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়, এনআইটি – কালিকট, আইআইটি – রুরকি, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়ে। খুলতে থাকে একের পর এক শাখা। ছাত্রীদের সন্ধের পর হস্টেলের বাইরে বেরোতে বাধা, নানান বিধিনিষেধ ইত্যাদির বিরুদ্ধে শুরু হয় এদের লড়াই। আপাতদৃষ্টিতে অরাজনৈতিক মনে হলেও, নারীবাদী রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল এই সংগঠন। স্বাভাবিকভাবেই, ভারতের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা আর তার রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা ছাত্রীদের এই সংগঠনের কোনও প্রশ্নই শুনতে চায়নি, তাই লড়াই হয়ে ওঠে কঠিন। এই সংগঠনেরই মূল দুই নেত্রী ছিলেন নাতাশা নারওয়াল ও দেবাঙ্গনা কলিতা। এরকম চলতে চলতে সিএএ-র বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়, জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উপর যখন দিল্লি পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ঢুকে লাইব্রেরিতে এসে নির্দয়ভাবে লাঠিচার্জ করে, তখন তার বিরুদ্ধে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাই তৈরি করে ‘জামিয়া কো-অর্ডিনেশন কমিটি’। বহু ছাত্রের বেআইনি গ্রেপ্তার আর পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিত করবার জন্য লড়াই শুরু করে এই সংগঠন। এই সংগঠনের একজন কর্মী হলেন আসিফ ইকবাল তানহা। এঁদের বিরুদ্ধে হওয়া এফআইআরে বারবার উঠে এসেছে এই সংগঠন দুটির নাম, যেন ছাত্রছাত্রীদের এই ধরনের সংগঠন তৈরি করাই এক অপরাধ।

নির্যাস

২০১৯ সালের মে মাসে, লোকসভা নির্বাচনের পর, যখন ভারতীয় জনতা পার্টি ভারতবর্ষের প্রধান শাসক দল হিসাবে শাসনভার গ্রহণ করে, তখনও বোঝা যায়নি যে মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই সেই বিপুল জয়ের সমারোহে প্রশ্নচিহ উঠে যাবে দেশজুড়ে এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনের চাপে। তারপর দিল্লি দাঙ্গা, তারপর লকডাউন, তারপর ডালগোনা কফি-পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু-সুশান্ত সিং রাজপুত-আনলক ২৩ ইত্যাদির চাপে আমরা ভুলেই যাব আন্দোলনকারী সেই ছাত্রছাত্রী দের কথা, যারা নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিল এই কালা কানুন। হ্যাঁ, এই কথা বলতে বাধা নেই যে, এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীরা। তাদের চাপেই সেই সময় ওই আইন প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় সরকার। সেই ভুলে যাওয়া ঘটনাক্রম মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা ভুলে গেলেও, রাষ্ট্র কিন্তু ভোলেনি। ভারতবর্ষে লকডাউন ঘোষণা হওয়ার ঠিক আগেই, ২০২০-র ফেব্রুয়ারি মাসে, এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা দিল্লির শাহীনবাগ সংলগ্ন অঞ্চল জুড়ে ঘটেছিল একটি দাঙ্গা। এই দাঙ্গার ঠিক আগের উস্কানিমূলক কান্ডগুলোকেও আমরা ভুলে গেছি হয়ত। ভুলে গেছি কিভাবে “গোলি মারো সালো কো” স্লোগান উঠেছিল ভারতীয় জনতা পার্টির সমর্থকদের মিছিলে, কিভাবে সত্যিই একজন গুলি চালিয়েছিল শাহীনবাগের আন্দোলন স্থলের দিকে। এগুলো রাষ্ট্রও ভুলে গেছে, যদিও মহামান্য দিল্লি হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি জাস্টিস মুরলিধরের রায় ঠিকই রয়ে গেছে আর্কাইভে। এরপর, ওই দাঙ্গার সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে গত মে মাসে, চারিদিকে অখন্ড শান্তির মাঝেই, একে একে গ্রেপ্তার হন নাতাশা নারোয়াল, দেবাঙ্গনা কলিতা ও আসিফ ইকবাল তানহা। এফ আই আর নাম্বার ৫৯ অফ ২০২০।

পটভূমি

 সাল ১৯৮৪। আমেরিকান কমিউনিস্ট পার্টি জোরদার আন্দোলন করছে দেশজুড়ে। রোনাল্ড রেগানের অর্থনৈতিক নীতি, বেকারত্ব, সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে ঠান্ডা যুদ্ধ ইত্যাদি নানান ইস্যুতে তখন আমেরিকা উত্তাল। এই রকম সময়েই, ২২শে আগস্ট সকালে, রেভলিউশনারি কমিউনিস্ট ইয়ুথ ব্রিগেডের তরফ থেকে একটি ডেমন্সট্রেশনের আয়োজন করা হয়েছিল ডালাসে। সেই ডেমন্সট্রেশন শেষের মুখে, যখন প্রায় গোটা এলাকা লাল পতাকায় ঢেকে গেছে, তখন প্রায় হঠাৎই, জনৈক গ্রেগরী লী জনসন আমেরিকার জাতীয় পতাকায় আগুন ধরিয়ে দেয় এবং সেটা পোড়াতে শুরু করে। ভরদুপুরে, খোলা বাজারে, এ হেন আন্টি-ন্যাশনাল কাজে রাষ্ট্রের অনুভূতিতে আঘাত লাগবেই। এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে কয়েকজন দৌড়ে এসে সেই জ্বলন্ত জাতীয় পতাকার আগুন নেভান, এবং আধপোড়া সেই জাতীয় পতাকাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানের কায়দায় সমাধিস্থ করেন। ব্যাপারটা যে এটুকুতেই থেমে থাকেনি তা বলাই বাহুল্য। গ্রেগরী লী জনসনের বিরুদ্ধ সিডিশনের মামলা রুজু হয়, পিছনে লেগে যায় সহি-দেশপ্রেমিকরা, সাথে যোগদান করে সে যুগের মিডিয়া। জনসনের বিচার হয়, শাস্তি হয় জেল আর জরিমানা, দুটোই। এরপর গড়পড়তা যা হয়ে থাকে আর কি, আপিল, তারিখ পে তারিখ, ইত্যাদি। কখনও জনসন জিতছেন, কখনো হারছেন, আর এইভাবেই শেষ অব্দি মামলা পৌঁছয় সুপ্রিম কোর্ট অফ ইউনাইটেড স্টেটসের সামনে। ১৯৮৯ সালের সেই রায়কে আজ ঐতিহাসিক রায় বলা হয়, ও দেশের আইনের ছাত্র মাত্রেরই এই রায় মুখস্থ থাকে সাধারণত। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কার বলেছিলো, সিডিশনযোগ্য কিছুই হয়নি। কোনও লেখা, কোনও কথা বা কোনও একটা কাজের জন্য সিডিশন জাতীয় অভিযোগ আনাই যায় না। মজার কথা হল, আমাদের দেশের আইনও আলাদা কিছু নয়, বরং প্রায় একই।

আমেরিকা দিয়ে লেখা শুরু করলাম, কারণ কথায় কথায় শুনতে পাই, “এসব ইংল্যান্ড-আমেরিকাতে করলে এতদিনে ফাঁসি হয়ে যেত”। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইংল্যান্ডে এই সিডিশন আইনটাই আর নেই, ২০০৯ সালেই আমেরিকা এই আইনটি পরিত্যাগ করেছে।

চলে আসি আমাদের দেশের একটা মজার গল্পে। গল্প হলেও সত্যি। বলবন্ত সিংকে মনে পড়ে? ভুলে গিয়ে থাকলে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা মনে করুন, মনে করুন অপারেশন ব্লু স্টার। সেই ঘটনাক্রমেই, ঠিক যেদিন ইন্দিরা গান্ধী মারা যান, ওই দিন বিকেলবেলায়, চন্ডিগড়ে খোলা বাজারে, সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে নাকি খালিস্তানপন্থী স্লোগান দিয়েছিলেন জনৈক বলবন্ত সিংহ। কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, খালিস্তান আন্দোলন তখন জমজমাট, কিছুক্ষণ আগেই খুন হয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী। অতএব, সেই একই ভবিতব্য, সিডিশন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ভূপিন্দর সিং ও বলবন্তের সিংয়ের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা রুজু হয়, এবং স্বাভাবিক নিয়মেই ট্রায়াল কোর্টে শাস্তি হয় দুজনেরই। বহু আপিল-আর্জির পরে এই মামলাও পৌঁছয় আমাদের সুপ্রিম কোর্টে। মজার গল্পটা এখানেই শুরু। সুপ্রিম কোর্টে জানা গেল যে ট্রায়াল কোর্ট রায় দেওয়ার সময় “হিন্দুস্তান মুর্দাবাদ” বলে একটা স্লোগান নথিবদ্ধ করেছিল, যা আসলে নাকি বলাই হয়নি! অর্থাৎ, বলবন্ত ও ভূপিন্দর ওই স্লোগান দেননি। চেনা চেনা লাগছে? ইতিহাস তো ফিরে ফিরে আসেই। পরেরটুকু শুনুন। সেই মামলায় শেষ অব্দি বলবন্তদের বেকসুর মুক্তিই শুধু হয়নি, তার সাথে সাথে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল “It does not appear to us that the police should have attached much significance to the casual slogans raised by two appellants, a couple of times and read too much into them.”

উপাখ্যান

নাতাশা, দেবাঙ্গনা আর আসিফের মামলা তিনটের শুনানি একসাথে হলেও, তিনটে ভিন্ন রায়ে এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের আলাদাভাবে বিচার করেন মহামান্য দিল্লি হাইকোর্ট। নাতাশা আর দেবাঙ্গনার বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযোগ প্রায় একই হলেও, যেহেতু এরা দুজন আলাদাভাবে মামলা দাখিল করেছিল, হাইকোর্টে তাই এদের বিচারও আলাদাভাবেই হয়। নাতাশার মামলাতেই কোর্ট রায় দেয় যে, “মতবিরোধকে দমন করবার উদ্বেগের জন্যই, রাষ্ট্রের মনের মধ্যে সংবিধান স্বীকৃত প্রতিবাদের অধিকার এবং টেররিস্ট কার্যকলাপের ধারণা কিছুটা ঝাপসা হয়ে গেছে”। যেখান থেকে এই লেখার সূত্রপাত। শুরুর ওই বাক্যবন্ধ, শিরোনাম আর উপসংহার লিখেই এই লেখাটি শেষ করে ফেলা যেত, কিন্তু, অনেক কথাই তাহলে হয়ত না বলা থেকে যেত।

যেমন বলা হত না, যে এই রায়গুলি থেকে এটাও স্পষ্ট, ‘চাক্কা জ্যাম’ কর্মসূচি পালন কোনওভাবেই রাষ্ট্রদোহ হতে পারে না, খুব বেশি পেনাল কোডের কোনও অন্য সাধারণ ধারায় অভিযোগ হতে পারে, যেমনটা ভূরি ভূরি হয়েই থাকে। সেরকমই কোনও সংগঠন তৈরি করা, বা তাতে যুক্ত হওয়া, হোয়াটস্যাপ গ্রুপে যোগ দেওয়া, রাস্তায় গণপ্রতিরোধে যুক্ত হওয়া, নানা বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা, ইত্যাদি কোনও কিছুই ইউএপিএ আইনে বিচার্য হতে পারে না, এবং এগুলোর জন্য কাউকে কখনওই রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায় না। হ্যাঁ, নাতাশা আর দেবাঙ্গনার বিরুদ্ধে এইগুলোই মূল অভিযোগ ছিল।

বারবার আলোচনায় ইউএপিএ আইনের কথা উঠে আসছে কারণ, এই আইনে অভিযুক্ত হলে জামিন পাওয়ার সুযোগ খুব কম থাকে। দেশদ্রোহিতার যে কোনও অভিযোগের বিচার এখন এই আইনেই হয়, এবং বর্তমানে ভারতবর্ষে এই আইনে অভিযুক্ত হয়ে বিনা বিচারে প্রায় কয়েক হাজার বন্দি বিভিন্ন জেলে আটকে আছেন, শুধু বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে। এই আইনে অভিযুক্তদের বিচার বা ট্রায়াল হওয়ার হার খুবই কম, এবং মূলত সেই কারণেই, পুলিশ প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে এই আইনের ধারাগুলি কিছু বিশেষ মামলায় যুক্ত করে, যাতে অভিযুক্ত কোনওভাবে বেল পেয়ে জেলের বাইরে আসতে না পারে। দিল্লি হাইকোর্টের এই রায়গুলি থেকে স্পষ্ট যে এই দানবীয় আইন, রাষ্ট্রদ্রোহ ব্যতীত অন্যান্য সাধারণ অপরাধের সাথে যুক্ত করা উচিত নয়। কারণ তাতে অভিযুক্তের জামিনের আবেদন করার সাংবিধানিক অধিকার খর্ব হয়ে যায় এবং এই আইনের মূল্যও নষ্ট হয়ে যায়। দিল্লি হাইকোর্ট আরো বলেছে যে, রাইট টু প্রোটেস্ট একটি সংবিধান স্বীকৃত অধিকার, এবং কোনোভাবেই প্রতিবাদমূলক কোনো কর্মসূচিকে, রাষ্ট্রদোহের অভিযোগে ইউপিএ আইনের আওতায় আনা যায়না। কোর্ট আরেকবার প্রশাসনকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে, লঘু দোষে এরম গুরু দণ্ডের অচল প্রয়োগ হলে, দণ্ডকেই মানুষ তুচ্ছ বলে বিচার করবে, যা দেশের পক্ষেও লজ্যার। এমন নয় যে এই কথা মহামান্য দিল্লি হাইকোর্টই এই প্রথম বার বললো, সেডিশন সম্পর্কিত আইন, আমাদের দেশে বরাবরই এইরম। একই কথা এর আগে, হিতেন্দ্রা ভিষ্ণু ঠাকুর এন্ড আদার্স ভার্সেস স্টেট্ অফ মহারাষ্ট্র এন্ড আদার্স [(1994) 4 SCC 602], মজদুর কিষান শক্তি সংগঠন ভার্সেস ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া এন্ড এন্যাদার [(2018) 17 SCC 324] বা, ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি ভার্সেস জাহুর আহমেদ শাহ ওয়াটালি [(2019) 5 SCC 1] জাতীয় আরো অনেক মামলায় বারবার বলেছে আমাদের সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু, সম্ববত এত স্পষ্ট ভাবে আগে বলা হয়নি, ওই ওপরের না বলা কথা গুলো। এই রায়ের সার্থকতা সেখানেই।

এই কারণেই দিল্লি হাইকোর্টের এই রায়গুলি, আইনের ছাত্রদের কাছে অদূর ভবিষ্যতে, সাংবিধানিক বিষয়ে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

পুনরাবৃত্তি

২০১৭ সালের ৩১শে ডিসেম্বর মহারাষ্ট্রের পুনে শহরে দলিতদের পক্ষ থেকে একটি অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়, ঐতিহাসিক কোরেগাওঁ এর যুদ্ধের ২০০ বছর উপলক্ষে। এর ফলশ্রুতিতে ওখানে শুরু হয় জাতি-দাঙ্গা, হয় প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি। ২০১৮ সালের ৩রা জানুয়ারি প্রকাশ আম্বেদকরের ডাকে পালন করা হয় মহারাষ্ট্র বনধ, ওই দাঙ্গার সময় ঘটা বিভিন্ন জাতিবিদ্বেষী ঘটনার বিরুদ্ধে। অন্যান্য আরও অনেক মানবাধিকার কর্মীর সাথে সাথে সুরেন্দ্র গ্যাডলিং ও সুধা ভরদ্বাজরাও যোগদান করেছিলেন ওই আন্দোলনে। ভারতবর্ষে জাতিভেদ প্রথার শিকার যে দলিত সমাজ, তার পক্ষে এবং উচ্চবর্ণের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছিল ওই আন্দোলন। ঠিক ওই সময়েই, বিভিন্ন খবরের চ্যানেলে প্রচারিত হয় একটি ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব, যাতে এই আন্দোলনের পিছনে মাওবাদীদের ভূমিকার উল্লেখ করা হয়। অতএব ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে পুনের ওই ঘটনার প্রায় ছ-সাত মাস পর, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং ও সুধা ভরদ্বাজদের হঠাৎ বিনা নোটিসে গ্রেপ্তার করে পুনে পুলিশ, ইউএপিএ আইনে, সিডিশনের অভিযোগে। ২৮শে আগস্ট এই গ্রেপ্তারির পরদিন, অর্থাৎ ২৯শে আগস্ট, ওঁদের গ্রেপ্তারিকে বেআইনি ঘোষণা করে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট জানান যে, “Dissent is the safety valve of democracy, and if you don’t allow dissent, the pressure cooker may burst.”

পুনশ্চ

“Dissent is the safety valve of democracy, and if you don’t allow dissent, the pressure cooker may burst.”

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.