একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পর অনেকেই মনে করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তিকে পরাজিত করা গেল। বিজেপির পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলায় সাম্প্রদায়িক শক্তির কবর রচনা হল। কিন্তু গত এক বছরে অসংখ্য ঘটনার মধ্য দিয়ে এই ধারণা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিজেপি হেরেছে ঠিকই, কিন্তু বিজেপির রাজনীতি হারেনি। বরং তৃণমূল কংগ্রেস নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে বিজেপির রাজনীতিকে আরও জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী করে তুলছে। প্রতিদিন পশ্চিমবঙ্গে নতুন করে বিপন্ন হচ্ছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, রাজনৈতিক হিংসায় তাঁরাই মারা যাচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। সরাসরি সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করছে তৃণমূল কংগ্রেস। রামনবমীর দিন রাজ্য জুড়ে যা ঘটল, তা থেকে একথা নিঃসংশয়ে বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গ এখন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির নতুন গবেষণাগারে পরিণত হয়েছে। সেই গবেষণাগারের গবেষক দুটি রাজনৈতিক শক্তি — বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস।
কী দেখলাম আমরা রামনবমীতে? গোটা রাজ্যে অস্ত্র হাতে মিছিল হল। সেই মিছিলে বিজেপি নেতাদের পাশাপাশি সগর্বে হাজিরা দিলেন তৃণমূল নেতারা। তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরাও মিছিলে অস্ত্র হাতে হাঁটলেন। মিছিল থেকে স্লোগান উঠল, মুসলিমদেরও এ দেশে থাকতে হলে “জয় শ্রীরাম” বলতে হবে। আমরা দেখলাম, খোলা তলোয়ার হাতে আগ্রাসী হিন্দুত্বের মিছিলের উপর ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছেন তৃণমূলের বিধায়ক। বস্তুত, দিনভর বিজেপি এবং তৃণমূলের নেতারা কে কত বেশি আগ্রাসী হিন্দুত্ব প্রচার করতে পারেন, তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতে ছিলেন।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
পশ্চিমবঙ্গে রামনবমী কোনো নতুন উৎসব নয়। যাঁরা রামনবমীকে বিজাতীয় তকমা দিচ্ছেন, তাঁরা আদতে হিন্দুত্ববাদীদের হাতই শক্ত করছেন। রামনবমী বহুকাল ধরে এই রাজ্যে পালিত হয়ে আসছে। জুটমিল সহ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে রামনবমী পালনের রেওয়াজ দীর্ঘকালের। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে যা করা হচ্ছে বাংলায়, তা নতুন জিনিস। রামনবমীকে কেন্দ্র করে নিঃসীম ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং হিংসার বীজ বপন করা হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মুসলিম বিদ্বেষ। সেই সঙ্গে এক ধরণের উত্তর ভারতীয় রাম সংস্কৃতির আমদানি করা হচ্ছে, যা বাংলায় রাম সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
আমাদের হাওড়ার একটা এলাকার কথাই ধরা যাক। রামরাজাতলায় বহুযুগ ধরে রামনবমী পালনের চল রয়েছে। এলাকার মানুষের কাছে এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এই এলাকায় বহু বছর ধরেই একটা রামমন্দির রয়েছে। সেখানে রামসীতার যে মূর্তি রয়েছে, তার সঙ্গে ইদানীংকালে রাজ্যের সর্বত্র যে যোদ্ধা রামের মূর্তি এবং ছবি দেখা যায়, তার মিল নেই। রামরাজাতলার ওই মন্দিরের রাম যেন অনেকটাই কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণের পাতা থেকে উঠে আসা। তাঁর সরু গোঁফ, নিতান্ত মানবিক এক দেবতা তিনি।
২০১৪ পরবর্তী সময়ে গোটা রাজ্যের মতো ওই এলাকাতেও বিজেপি-আরএসএস আগ্রাসী হিন্দুত্বের রাজনীতি প্রচার করতে থাকে। ওই মন্দিরটি দখল করতে যায় তারা। কিন্তু মন্দিরের লোকজন স্পষ্ট জানিয়ে দেন, মুসলিম বিদ্বেষের কেন্দ্র হিসাবে তাঁরা ব্যবহৃত হবেন না। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়। ফলে তারা ওই মন্দির ছেড়ে পিঠটান দেয়।
যেহেতু মন্দিরে আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা গেল না, সেহেতু গেরুয়া শিবির অন্য পন্থা নেয়। আমরা দেখলাম এলাকার তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক তথা বর্ষীয়ান নেতা জটু লাহিড়ি ওই এলাকাতেই এক নতুন রামমন্দির তৈরি করলেন। মন্দিরের উদ্বোধন করলেন স্থানীয় সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। এই মন্দিরের রামের চেহারা কিন্তু একদম আলাদা। তাঁর শরীর পেশিবহুল, রণংদেহি অবতারে তিনি এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। ঠিক যে রকম রাম-শরীর আজকাল উত্তর ভারতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, অবিকল তাই। জটু লাহিড়ি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছেন। প্রসূনবাবু তৃণমূলেরই সাংসদ এখনো। ওই রামন্দিরকে কেন্দ্র করে এখন আগ্রাসী হিন্দুত্বের রাজনীতি চলছে। এবারও মিছিল থেকে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করার স্লোগান উঠেছে। তাতে শামিল বিজেপি এবং তৃণমূলের নেতারা।
একটা ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কানাগলিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গকে। এর দায় কেবল বিজেপির নয়, তৃণমূলেরও। তৃণমূলের কোনো রাজনৈতিক আদর্শ নেই। জনপ্রিয় হতে এরা ইফতার করতেও বসে পড়ে, রামনবমীর মিছিলে অস্ত্র নিয়েও হাঁটে। কিন্তু দেশ এবং রাজ্য জুড়ে যেভাবে হিন্দুত্ববাদের হেজিমনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মুসলিমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়েছেন, তাতে তৃণমূলের এই ধরণের কাজ রাজ্যকে বিজেপির রাজনীতির মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত করেছে। বাধাহীন তো বটেই, বহু ক্ষেত্রে সরকারি মদতেই বাংলায় চলছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি।
এর দায় কিন্তু নিতে হবে সব ধরনের বামপন্থীদেরও। বিশেষত, সাড়ে তিন দশক সরকার চালানো বামপন্থীদের। তাদের দায় অন্যদের চেয়েও বেশি। পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলে এসব ঘটত না, ঘটলেও সরকার কড়া ব্যবস্থা নিত। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতাকে আটকানো কেবল রাজনৈতিক কাজ নয়, সামাজিক কাজও বটে। সেটা তেমন হয়নি। সরকার ও প্রশাসন দাঙ্গা রুখতে সক্রিয় ছিল, কিন্তু বাম গণভিত্তিকে অসাম্প্রদায়িক করে তোলার জন্য যতখানি চেষ্টা প্রয়োজন ছিল তা হয়নি। বিপদটাকেই ঠিকভাবে অনুধাবন করা যায়নি। কেবল সরকার বা পার্টিকে দিয়ে এ কাজ হয় না। ছাত্রযুব সংগঠন, ক্লাব, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে দিয়ে এ কাজ করানো যেত, তা হয়নি। এই না পারার দায় বামপন্থীদের নিতে হবে।
রামনবমীর দিনে বাংলা দেখল বিজেপি এবং তৃণমূলের প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি। অন্য দিকে, এই প্রথম একজন দলিত জায়গা পেলেন কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরোতে। একজন আদিবাসী মহিলা জায়গা করে নিলেন কেন্দ্রীয় কমিটিতে। এ বড় কম আনন্দের কথা নয়। সামাজিক পরিসরে বামপন্থার আরও নিবিড় অনুশীলনের জন্য মাইলফলক হতে পারে এই ঘটনা। হিন্দুত্ববাদের গবেষণাগারে পরিণত হওয়া বাংলায় এইটুকুই যা আশার কথা।
মতামত ব্যক্তিগত
আরো পড়ুন
হিন্দুত্বের গবেষণাগার উত্তরপ্রদেশে পরীক্ষা সফল
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।