সম্প্রতি ভারতের সবুজ অংশ নিয়ে এক রিপোর্টে জানা গেছে, গত দশ বছরে কলকাতা শহরে সবুজের মাত্রা কমে গেছে প্রায় ৩০%। ২০১১ সালে কলকাতায় সবুজে ঘেরা স্থলভাগের পরিমাণ ছিল ২.৫ বর্গ কিলোমিটার, যা এখন ১.৮ বর্গ কিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। অঙ্কটা সহজ, প্রায় সকলেই কষে ফেলতে পারবেন। তাছাড়া বিশ্ব পরিবেশ সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী কলকাতা আগামী দশ বছরে সম্পূর্ণ জলের তলায় চলে যাবে, যদি না পরিবেশ বাঁচাতে আশু হস্তক্ষেপ করা হয়। তবে এত পরিসংখ্যান দেখার কি আদৌ দরকার আছে? এপ্রিলের মাঝামাঝি রাস্তায় বেরিয়েই টের পাওয়া যাচ্ছে, সেই গ্লুকোজের বিজ্ঞাপনে যেভাবে সূর্য স্ট্র দিয়ে সমস্ত জীবনীশক্তি শুষে নিত, তেমনটাই যেন বাস্তবে হচ্ছে।
তাহলে এই গরমে কী করণীয়? কেউ বলবেন প্রচুর জল তথা জলের ভাগ বেশি এমন ফল খান, কেউ বলবেন হালকা রঙের সুতির জামা পরুন, কেউ বলবেন নেহাতই প্রয়োজন বোধ না করলে রাস্তায় বেরোবেন না, পারলে সূর্যাস্তের পরে বেরোন, এমনকি কেউ কেউ বলবেন এতই যদি গরম তো তিব্বত গেলেই পারো। কিন্তু সম্ভবত কেউই বলবেন না গরম নিয়ে রাজনীতি করুন। আপনার সেটাই সমীচীন মনে হবে। সত্যিই তো, এ নিয়ে কেনই বা রাজনীতি করবেন? প্রকৃতির উপর মানুষের রাজনীতির জোর খাটে নাকি? এ প্রশ্নের উত্তরে কিন্তু স্রেফ ‘না’ বলে দেওয়া চলে না।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
গত দশ বছর পশ্চিমবঙ্গে যে দল ক্ষমতায় আছে তাদের বিরুদ্ধে নানা অপরাধমূলক কাজের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও একটা ব্যাপারে সাধারণ মানুষ দারুণ প্রসন্ন। তারা রাস্তাঘাট ঝকঝকে তকতকে করে, পুকুর বা দীঘি ঘিরে পার্ক বানিয়ে, আলো লাগিয়ে, রং করে সৌন্দর্যায়ন করেছে। ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের দুধারে বহুতল এবং অফিসবাড়ি তৈরি হয়েছে, যার প্রায় সবই পূর্ব কলকাতার জলাভূমি ধ্বংসের বিনিময়ে। এই রাজনীতি সমর্থন করে যে বৃহত্তর যুক্তি দেওয়া হয়, তা হল – শিল্পায়ন এবং নগরায়নের জন্য কিছুটা সবুজ নাশ মেনে নিতে হবে, নইলে প্রগতির গতি রুদ্ধ হবে। একে ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেওয়ার আগে দুটো প্রশ্ন করা দরকার। এক, যে প্রগতির জন্য জলা বুজিয়ে, গাছ কেটে কলকাতার সবুজের বারোটা বাজানো হল, সেই প্রগতির নিরিখে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে? দুই, যদি আর কয়েক বছর পরে প্রাণেই না বাঁচি, তাহলে প্রগতির মূল্য কী?
প্রথমে আসা যাক প্রগতির নিরিখে বাংলার অবস্থানে। আমার বয়সী কলকাতাবাসীরা এখন অধিকাংশই রাজ্যের বাইরে চাকরি করছেন এ কথা প্রায় কারোর অজানা নয়। প্রত্যেকেই যে ভিনরাজ্যে যেতে চেয়েছিলেন এমনটা কিন্তু নয়। যেখানে গেছেন সেখানে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন না এমনটাও নয়। তাহলে যাচ্ছেন কেন? কারণ সবকিছু সত্ত্বেও যেটুকু অন্য রাজ্যে পাওয়া যাচ্ছে, সেই পরিমাণ কর্মসংস্থান এ রাজ্যে তৈরি হয়নি। যাঁরা তাও বা চাকরি পাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গে, তা সেই পুরোনো কোম্পানিগুলোতেই। অর্থাৎ এই দশ বছরে হু হু করে সবুজ কমেছে শিল্পের জন্য নয়, কর্মসংস্থান তৈরি করে প্রগতি হচ্ছে বলে নয়। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় সবুজ ধ্বংস করে এমন কিছু প্রকল্প তৈরি হয়েছে যা ভবিষ্যতে ফল দেবে, তাহলেও সেইসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে হতে কলকাতা জলের তলায় চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং আমাদের বোঝা উচিত যে প্রগতিকে শিখণ্ডী করা হচ্ছে মানুষকে পরিবেশ রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্য।
এবার আসা যাক প্রাণে বাঁচার প্রশ্নে। বাঁচার জন্য তিনটে জিনিস অবশ্য প্রয়োজনীয় – অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান। তিনটেই কোনো না কোনোভাবে পরিবেশের সাথে জড়িত। অন্নের সংস্থান, সুতি-পাট-চট-রেশমের কাপড়, বাসস্থানের জমি এবং একক পরিবারের বসতবাড়ির জায়গায় ফ্ল্যাটবাড়ি ওঠার ফলে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং জলবায়ুর উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। সেখানে কী করে পরিবেশ ধ্বংস না করে অন্নের জোগান দেয়া যাবে, কীভাবে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্য নিয়ে বিনাশ করা সবুজে তৈরি বাসস্থানের সদ্ব্যবহার হবে, কিভাবে বেসরকারি, ব্যক্তি পুঁজি দ্বারা পরিচালিত শিল্পবাণিজ্য সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে, বর্জ্য পদার্থ ও রাসায়নিক পদার্থের নিষ্পত্তি করা হবে কী করে, কোনো সংস্থা পরিবেশবান্ধব না হলে তার শাস্তি কী হবে – সবটাই ঠিক করে দেয় রাজনীতি। সুতরাং সবটা উল্টেও দেয় রাজনীতিই। আর সেই ভুলের মাশুল হতে পারে আমাদের প্রাণ।
তাহলে উপায় কী? উপায় সমাজতন্ত্র। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। পরিবেশ বাঁচাতে আমাদের উচিত ব্যক্তিগত যানবাহন কমিয়ে জনপরিবহনমুখী হওয়া। কিন্তু আমরা যেই এই পদক্ষেপ নেব, জেনারেল মোটর্স বা টয়োটার মালিকরা নিজেদের কোম্পানি লুঠ করে সমস্ত টাকা সুইস ব্যাংকে রেখে বাকি জীবনটা পায়ের উপর পা তুলে উপভোগ করবেন। আর তাঁদের হাজার হাজার সাধারণ কর্মচারীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। কিন্তু একই ঘটনা একটা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে হলে এই কোম্পানির মালিক ও বাঘা বাঘা শেয়ারহোল্ডারদের অর্জিত মুনাফা থেকে সাধারণ কর্মচারীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা হবে।
আমাদের জেনে রাখা দরকার, জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের একশোটা সবথেকে বড় বহুজাতিক কোম্পানির অবদান ৭০%। আবার এই কোম্পানিগুলোই ‘কর্পোরেট সোশাল রেসপনসিবিলিটি’-র মোড়কে আমাদের জন্য নিয়ে এসেছে ‘ভেগানিজম’, ‘সাসটেইনেবল’ পোশাক, ‘জিরো প্লাস্টিক লাইফস্টাইল’, ‘থ্রিফট শপিং’ ইত্যাদি। প্রতিনিয়ত ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থার দায় অস্বীকার করে সাধারণ ব্যক্তির ঘাড়ে সব দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
অন্যদিকে এখনো যেভাবে রমরমিয়ে খনিজ তেলের ব্যবসা চলছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে চীনের ভূখণ্ডের সমপরিমাণ জমি জুড়ে গাছ লাগালেও পৃথিবীকে বাঁচানো সম্ভব নয়। বাঁচার একমাত্র উপায় হল খনিজ তেল ছেড়ে অন্য জ্বালানি ব্যবহার করা। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেলের সাম্প্রতিক রিপোর্ট কোড রেড ফর হিউম্যানিটি অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সমস্ত উন্নত দেশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে বাকি সব দেশ যদি কয়লা তথা অন্যান্য খনিজ পদার্থ ব্যবহার বন্ধ না করে, তাহলে কোনোভাবেই গ্রীন হাউস গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত নিঃসরণ রুখে পরিবেশ সংরক্ষণ সম্ভব নয়। বিকল্প হিসাবে কোন জ্বালানি ব্যবহার করা হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয় কারা? সরকার, তার রাজনীতি। অর্থাৎ শেষপর্যন্ত সেই রাজনীতিই ঠিক করবে জলবায়ু পরিবর্তন সামলানো যাবে কিনা।
পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্র বাদে কি কোনো বিকল্প নেই তবে? আছে, ভয়ানক একরোখা একনায়কত্ব। তবে তাতে ব্যক্তি পুঁজিকে খানিকটা সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও গণতন্ত্র একেবারেই বেহাত হয়ে যাবে। ব্যাপারটা কেমন হবে তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় নরেন্দ্র মোদী, ডোনাল্ড ট্রাম্প বা বলসোনারোর মত রাষ্ট্রনায়কদের রাজনীতি দেখে। তাই সমাজতন্ত্রই একমাত্র উত্তর।
আবার প্রশ্নটা মনে করিয়ে দিই। আমাদের পরিবেশ যদি রাজনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে আমরা পরিবেশের হিতার্থে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা ভাবব না কেন?
মতামত ব্যক্তিগত
আরো পড়ুন
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।