অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র এগারো বছর আগে এক সোনার কেল্লা আশ্রয়ী মিম ফরোয়ার্ড করে জানিয়েছিলেন “মুকুল ভ্যানিশ”। ২০২৩ সালে এসে তিনি সেই মামলা থেকে সসম্মানে অব্যাহতি পেয়েছেন, মামলা খারিজ হয়েছে। মামলা ভ্যানিশ হলেও ৪২ ডিগ্রি গরমে মুকুল নতুন করে ভেসে উঠেছেন। কৃষ্ণনগর উত্তর বিধানসভার এই তৃণমূল বিধায়ক অথবা বিজেপি বিধায়ক নাকি বিজেপিতে যোগদান করতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন মুকুল বিজেপি। তৃণমূল কংগ্রেস মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন মুকুল রায় উচ্চমার্গের ব্যাপার। তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায় বলছেন, মুকুল রায়কে নিয়ে আলোচনা করার মত সময় তাঁর নেই। অর্থাৎ মুকুল রায় বঙ্গ রাজনীতির বারমুডা ট্রায়্যাঙ্গল হয়ে উঠেছেন। সাধারণ নাগরিক গরমে খাবি খেতে খেতে ভাবছেন “মুকুল তুমি কোন দলে? মুকুল তুমি কোথায়?”

মুকুল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ২০০৬ সালে ছিলেন সাধারণ সম্পাদক, ২০০৬ থেকে ২০১২ পর্যন্ত রাজ্যসভার সাংসদ। দ্বিতীয় ইউপিএ আমলে মন্ত্রিসভাতেও ছিলেন। যদিও ২০১১ সালের ১১ জুলাই গৌহাটি-পুরী এক্সপ্রেস বিতর্কের পর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাঁকে সরিয়ে দেন। পরবর্তীকালে দিনেশ ত্রিবেদী মমতা ব্যানার্জির রোষে রেলমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হলে মুকুল তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। এই হল মুকুলের সংসদীয় পরিচয়। কিন্তু এ তাঁর প্রধান পরিচয় নয়। আসল কথা তিনি ছিলেন মমতার ছায়াসঙ্গী, তৃণমূল দলে তাঁর স্থান মমতার পরেই। একসময় মমতার পরে তিনিই ছিলেন শেষ কথা। দলের লোক এবং সংবাদমাধ্যম বলত মুকুল বঙ্গ রাজনীতির চাণক্য। এসবের পাশাপাশি মুকুল বাংলার রাজনীতিতে ঘোড়া কেনাবেচার সংস্কৃতির জনক। তাঁর হাত ধরেই ভয়ে এবং/অথবা লোভে গণহারে বিরোধী দলের নির্বাচিত সদস্যরা তৃণমূলে যোগ দিয়েছিল। তাঁর নেতৃত্বেই নীতিহীন দলবদলের সংস্কৃতি বাংলার বিধানসভায় চালু হয়েছে। সারদা চিট ফান্ডের মামলাতেও তিনি প্রধান ষড়যন্ত্রকারী বলে অভিযোগ আছে। বিরোধীদের অভিযোগ, সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের বিপুল বেআইনি সম্পদের অনেকটাই মুকুল কুক্ষিগত করেছিলেন এবং ওই কোম্পানির কাছ থেকে নিয়মিত তোলা তুলতেন। নারদের স্টিং অপারেশনে মুকুলকে ক্যামেরার সামনে ঘুষ নিতে দেখা গিয়েছিল। অবশ্য এসবের জন্য তাঁর মমতা-ঘনিষ্ঠ এবং তৃণমূলের অন্যতম ক্ষমতাশালী নেতা হয়ে থাকতে কোনো সমস্যা হয়নি।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

দলে অভিষেক ব্যানার্জির উল্কার গতিতে উত্থানের পর থেকেই মুকুল ক্রমশ ম্রিয়মান হতে থাকেন। অনেকে বলেন ক্ষমতার রাজনীতি। স্নেহ ক্রমশ দলের রাশ অভিষেকের হাতে পৌঁছে দিচ্ছিল, অন্যদিকে দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মুকুল আগের মত গুরুত্বপূর্ণ থাকতে পারছিলেন না। বিরোধী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সারদা মামলায় সিবিআই তদন্ত এবং নারদ মামলায় ঘুষ নেওয়ার ভিডিও প্রকাশিত হওয়ায় মুকুলের সামনে নিজেকে এবং দলকে বাঁচানোর জন্য বিজেপিতে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ ছিল না। অন্যদিকে বাংলার রাজনীতি বোঝে, এমন ধুরন্ধর কাউকে প্রয়োজন ছিল বিজেপির। তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের ধারণা ছিল বাংলা দখল করতে গেলে এমন একজনকে প্রয়োজন, যে তৃণমূল ভাঙতে পারে। সে কাজে মুকুলের চেয়ে বড় ওস্তাদ আর কে? তাই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত মুকুল নিজেকে বাঁচাতে (বিরোধীরা বলেন মমতাকে বাঁচাতে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেই) দলে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিজেপিতে যোগ দেন। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় বিজেপির সাফল্যের পিছনে মুকুলের অবশ্যই অবদান ছিল। ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত পরিস্থিতি এতটাই বদলে যায়, যে মনে হয়েছিল বিজেপির বাংলা দখল শুধু সময়ের অপেক্ষা।

২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতা দখল করতে ব্যর্থ হওয়ার পর কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক মুকুল রায় সপুত্র অভিষেকের হাত ধরে তৃণমূলে ফিরে আসেন।

মুকুল হয়ে যান একইসঙ্গে দুই দলের বিধায়ক। বিধানসভার ভিতরে তিনি বিজেপি, বিধানসভার বাইরে তৃণমূল। অবাক করার মত সমীকরণ। মুকুল নিজে বলেছেন “যাহা বিজেপি, তাহাই তৃণমূল”। মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মুকুল তৃণমূলের পতাকা তুলে নিয়েছিলেন। অথচ মুখ্যমন্ত্রী পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচনের সময়ে বলেছেন, উনি বিজেপি বিধায়ক। রীতিমত সাংবাদিক সম্মেলন করে তাঁর দলে যোগ দেওয়া একজন বিধায়ককে মুখ্যমন্ত্রী চিহ্নিত করছেন বিরোধী দলের বিধায়ক হিসাবে – রাজ্য রাজনীতির এমন দৈন্যদশা অতীতে কখনো হয়েছে কি?

গত দুবছরের মধ্যে মুকুলের পত্নীবিয়োগ হয়েছে, তিনি নিজেও অসুস্থ হয়েছেন, বঙ্গ রাজনীতিতে ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন। মুকুল বলে কেউ যে ছিলেন, তাঁর দলের লোকেরাই তা ভুলতে বসেছিল। অবশ্য তাঁর দল বলতে তো তৃণমূল, বিজেপি – দুটোই বোঝায়। বস্তুত তাঁর অনুষঙ্গেই বিজেমূল শব্দটার জন্ম। এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতাকে সময় গ্রাস করেছে। এতদিন পরে তিনি আবার খবরের শিরোনামে ফিরলেন যখন পুত্র শুভ্রাংশু থানায় অভিযোগ করলেন – মুকুল নিরুদ্দেশ। তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে। দলিল দস্তাবেজ দেখিয়ে বললেন বাবা অসুস্থ। মানসিক অসুখ। ‘অজ্ঞাত’ দুজন নাকি তাঁকে তুলে নিয়ে গেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হল তাঁর বিমানযাত্রার টিকিট। এদিকে মুকুল দিল্লিতে বসে সাংবাদিকদের বললেন, তিনি সজ্ঞানে এসেছেন। কেউ অপহরণ করেনি। তিনি সুস্থ এবং এখন বিজেপি করেন। তাঁর একটাই লক্ষ্য, সিপিএমকে হারাতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীও কলকাতায় বললেন, উনি বিজেপি বিধায়ক।

আরো পড়ুন নারদ স্ক্যামের দড়ি টানাটানি: বিচারের বাণী সম্ভবত নীরবে নিভৃতে হাসছে

তিনি যে সত্যিই অসুস্থ তা টিভির পর্দায় দেখেও বুঝতে অসুবিধা হয় না। কথাবার্তা অসংলগ্ন, স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে বলেও সন্দেহ হয়। কিন্তু মমতা এবং বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব তো সুস্থ। তাহলে একজন অসুস্থ মানুষকে নিয়ে এমন টানাটানি করছেন কেন? এ যেন কলকাতা ময়দানের দলবদলের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। কর্মকর্তারা যেভাবেই হোক নিজের দলের ডেরায় খেলোয়াড় তুলে আনবেন। মমতা ও বিজেপি নেতৃত্ব অসুস্থ মুকুলকে নিয়ে টানাটানি করছেন, তিনি দিল্লি যেতে বাধ্য হয়েছেন। বিরোধীরা বলছে, অভিষেককে যে কোনো দিন কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলো তলব করতে পারে। তাই মুকুলকে দিল্লি পাঠানো রফা সূত্রের খোঁজে। কারো কারো আশঙ্কা, আগামী লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল বাংলায় ৩০টির মত আসন বিজেপিকে উপহার দেবে নিজের দলের নেতা মন্ত্রীদের বাঁচাতে। মুকুলের দিল্লি যাত্রা, নিজেকে বিজেপি বলে ঘোষণা – এগুলো ব্যাটিং পিচ তৈরির প্রথম ধাপ। যেখানে অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথ প্রমুখ ঝোড়ো ব্যাটিং করবেন।

অতীতে বাংলার রাজনীতির একটা গর্বের জায়গা ছিল – এখানে গোবলয়ের মত ঘোড়া কেনাবেচা হয় না। সিপিএম, কংগ্রেস, নকশাল ছিল। তাদের সাফল্য ব্যর্থতা, দোষত্রুটি নিয়ে হাজার সমালোচনার অবকাশ আছে। বাংলার রাজনীতিতে তীব্রতা ছিল, হিংসাও ছিল। কিন্তু তৃণমূল আর বিজেপির আগে বাংলার রাজনীতি এতখানি অসৎ, দেউলিয়া কখনোই ছিল না। বাংলার এই দেউলিয়া, অসৎ রাজনীতি একান্তই মমতা ও বিজেপির উপহার।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.