ভেবেছিলাম, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে জাতীয় কিছু একটা লিখে ফেলব। কিন্তু, আশেপাশে হাসিঠাট্টা ছাড়া আর কিছুর উপাদান বিশেষ দেখছি না। সত্যি বলতে কি, এই নারদ স্ক্যামের এবং তৎসংলগ্ন তদন্ত প্রক্রিয়ার গোটা বিষয়টাই খুব হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, এর দায় কার?

২০১৬ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে আগে নারদ টিভি বলে একটি ইউটিউব চ্যানেলে প্রথম বেশ কিছু ফুটেজ প্রকাশিত হয়। সেখানে রাজ্য সরকারের তদানীন্তন কিছু মন্ত্রী এবং রাজ্যে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কিছু নেতা, কর্মী, বিধায়ক ও সাংসদকে একদম নিজ হাতে, বা তাদের সহায়কদের মাধ্যমে, বেশ কয়েক লক্ষ টাকা ঘুষ বাবদ নিতে দেখা যায়। যুক্ত থাকতে দেখা যায় এসএমএইচ মির্জা নামের এক আইপিএস অফিসারকেও। এই স্টিং অপারেশনের মূল হোতা ছিলেন জৈনক ম্যাথু স্যামুয়েলস। ইউটিউবে প্রকাশিত হওয়ার পর, বিজেপি দলের কলকাতা অফিস থেকে সরাসরি, নানান সংবাদমাধ্যমে এগুলোর প্রচার করা হয়, এবং, জনমানসে এই ফুটেজগুলো ছড়িয়ে পড়ে। এইসব ফুটেজ প্রকাশিত হওয়ার পর, সম্ভবত উপায়ান্তর না দেখেই, নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় জানান, আগে জানলে উপর্যুক্ত নেতাদের ভোটে দাঁড় করাতেন না, এবং মানুষ যেন, এদের নন, বরং রাজ্যের ২৯৪টি আসনেই, তাঁকেই প্রার্থী ভেবে ভোট দেন। তাঁর ওই বক্তব্যের পর, বলা বাহুল্য, তৃণমূল বিপুল ভোটে সেই নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়, এবং ওই নারদ কাণ্ডের কোনো প্রভাব সেই নির্বাচনে পড়তে দেখা যায় না।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এই নেতাদের সবাই এখন আর তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে যুক্ত নেই, এবং এঁদের মধ্যে শ্রী মুকুল রায়, শ্রী শংকুদেব পণ্ডা এবং শ্রী শুভেন্দু অধিকারী বিজেপি দলে যোগদান করেছেন। পরবর্তীকালে আরও জানা গেছে যে, ওই স্টিং অপারেশনের সময়কাল ছিল ২০১৪ সাল। এরই মাঝে, আমাদের কলকাতা হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে শুরু হয়, এই স্টিং অপারেশনের সিবিআই কর্তৃক তদন্ত। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে সর্বমোট ১২ জন তৎকালীন তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে এফ আই আর ফাইল করেছিল সিবিআই। এছাড়া এঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটও।

সেই ২০১৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০২১ সালের মে মাস। মাঝে কেটে গেছে চারটে বছর। এর মাঝে, ওই স্টিং অপারেশনের ফুটেজ সত্য বলে রিপোর্ট এসেছে। পাল্টা মামলা হয়েছে ম্যাথু স্যামুয়েলের বিরুদ্ধেও, রাজ্য সরকারের তরফে, আইপিসির বিভিন্ন ধারায়। এইসব মিলিয়ে ভালোই চলছিল আর কি। অভিযুক্ত সাংসদদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউট করবার জন্য প্রয়োজনীয় স্যাংশন চাওয়া সিবিআইয়ের চিঠি পড়েই ছিল স্পিকারের টেবিলে, গত কয়েক বছর, কোন অজানা কারণেই। অভিযুক্ত এমএলএ-এমপিরা আজও বহাল তবিয়তেই আছেন। মানে, কদিন আগে অব্দি ছিলেন আর কি। আমাদেরও ধারণা হয়ে গেছিল যে, যেহেতু উপর্যুক্ত তিনজন প্রাক্তন তৃণমূল নেতা বর্তমানে বিজেপিতে যোগদান করে, যথেষ্ট সিরিয়াসলি গৃহীত হয়েছেন, তাই সম্ভবত এই তদন্ত নিয়ে আর কোনো নাড়াচাড়া হবে না। কিন্তু এই চেনা ছকের একটু বিপরীতের ঘটনাই আজকের বহুচর্চিত নারদ কেস, যাতে, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হওয়ার পর, এবং তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল সংখ্যায় জিতে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের অব্যবহিত পরেই, কিছুটা হঠাৎ করেই যেন, শ্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় সহ তৃণমূল কংগ্রেসের আরও তিনজন হেভিওয়েট নেতা-মন্ত্রীকে কার্যত বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় সিবিআই।

এই প্রসঙ্গে, সংক্ষেপে বলা উচিত, সিবিআই জানিয়েছে যে শ্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়, শ্রী ববি হাকিম, শ্রী সুব্রত মুখার্জি এবং শ্রী মদন মিত্রের ব্যাপারে তাদের তদন্ত সম্পূর্ণ হয়েছে। সিবিআই আরও জানিয়েছে, অভিযুক্ত বিধায়ক শ্রী মুকুল রায় এবং শ্রী শুভেন্দু অধিকারীর ব্যাপারে তাদের তদন্ত এখনো বাকি। তাদের সূত্রে এ-ও জানা গেছে যে, লোকসভার স্পিকার এখনো উক্ত সাংসদদের নিয়ে তদন্তের ছাড়পত্র দেননি। উপর্যুক্ত চারজন তৎকালীন এবং বর্তমান বিধায়কের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার ছাড়পত্র সিবিআই পেয়েছে গত ৮ তারিখ, বিধানসভা গঠনের একদিন আগে, রাজ্যের বর্তমান রাজ্যপালের থেকে, আর সেইজন্যই রাজ্য বিধানসভার স্পিকারের থেকে কোন আলাদা ছাড়পত্রের প্রয়োজন নেই।

যাই হোক, গত ১৭ তারিখ সকালবেলা নেতা-মন্ত্রীদের হঠাৎ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তারের সময়, প্রথমে সিবিআই কর্তৃপক্ষ জানান যে, তাঁরা গ্রেপ্তার করছেন না, বরং তাঁদের সিবিআইয়ের নিজাম প্যালেসের দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাঁদের বিরুদ্ধে আনা চার্জশিট দেওয়ার জন্য। যদিও তারপর নিজাম প্যালেসে ওই চারজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়। ওই গ্রেপ্তার যতটা অতর্কিত, প্রায় ততটাই অভূতপূর্ব তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেত্রী সহ আরও একাধিক মন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেস নেতা পৌঁছে যান নিজাম প্যালেসে, গ্রেপ্তার হওয়া তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের ছাড়বার দাবিতে। ঘটনাস্থলে তৈরি হয় প্রায় যুদ্ধ পরিস্থিতি। ওই একই দাবি নিয়ে, প্রায় চোখের নিমেষেই, লকডাউনের সমস্ত বাধা ও করোনার সমস্ত ভয়কে উপেক্ষা করে, ওই অঞ্চলে জড়ো হয়ে যান বহু সংখ্যক সাধারণ কর্মী সমর্থক। বাইরে এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণে, সিবিআই গ্রেপ্তার হওয়া উক্ত চারজনকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রের সামনে সশরীরে হাজির না করে ভার্চুয়াল বা অনলাইন পদ্ধতিতে হাজির করার আবেদন করে, যা গৃহীতও হয়। অভিযুক্তদের আইনজীবীরাও তা মেনে নিয়েই ভার্চুয়াল পদ্ধতিতেই শুনানিতে যোগদান করেন, অভিযুক্তদের বেলের বা জামিনের আবেদন করেন।

এত অব্দি, আমার ধারণায়, আইনবিরুদ্ধ কিছু বিশেষ হয়নি। হ্যাঁ, মহামান্য রাজ্যপাল নাকি মহামান্য স্পিকার, কার থেকে ছাড়পত্র নেওয়া উচিত ছিল, সেই নিয়ে তর্ক বিতর্ক আছে। সেরকম এই স্টিং অপারেশনের জন্য আদৌ কোন ছাড়পত্রের প্রয়োজন আছে কিনা সেটা নিয়েও তর্ক আছে। এইসব তর্কের উর্ধ্বে উঠে, সিবিআইকে বেনিফিট অফ ডাউট দেওয়ার পরেও যে প্রশ্ন থেকে যায়, তা হল সময়কালের। অর্থাৎ, ওই স্টিং অপারেশনের প্রায় সাত বছর পর, ফুটেজ জনমানসে আসবার দীর্ঘ পাঁচ বছর পর, আর সিবিআই তদন্ত ভার পেয়ে এফ আই আর লজ করবার চার বছর পর, হঠাৎ এমন কী হল, যে আচমকা এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই উক্ত চারজন, যাঁরা সবাই পঞ্চাশোর্ধ, তাঁদের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করতে এইরকম উদ্যোগী হয়ে উঠল সিবিআই? অর্থাৎ, কেন আরও আগে নয়, এবং কেন আরও কিছুদিন পরে নয়?

কিন্তু এই প্রশ্নকে ছাপিয়ে উঠে এসেছে আরও বেশ কিছু প্রশ্ন, যা উক্ত ব্যাঙ্কশাল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে হওয়া ‘সিবিআই ভার্সেস মুকুল রায় এন্ড আদার্স’ মামলার শুনানির সময় আমরা জানতে পারি। সিবিআই ওই মামলার ভার্চুয়াল শুনানির সময় অভিযুক্তদের জেল কাস্টডি চায় নিজেদের কাস্টডি না চেয়ে, যা থেকে বোঝা যায় এদের ইন্টারোগেট, বা কোন ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন, সিবিআইয়ের আর নেই। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, চার্জশিট ফাইল হয়ে যাওয়ার পর, কোনো নতুন প্রশ্নোত্তর/প্রমাণ/এভিডেন্সের প্রয়োজন না থাকলে, এই করোনা  পরিস্থিতির মধ্যে, এঁদের গ্রেপ্তারের বা কাস্টডির প্রয়োজন কী? যখন তদন্তের পুরো সময়টায় এঁরা সবাই বাইরেই ছিলেন এবং তদন্তে সাহায্যই করেছেন? ব্যাঙ্কশাল কোর্টের শুনানিতে এই কথাও হয় যে, বাকি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত সম্পূর্ণ হলে, এদের সবার তো একসাথেই বিচার বা ট্রায়াল হতে পারে, যেহেতু এঁদের সকলের বিরুদ্ধে রয়েছে একই অভিযোগ। ব্যাঙ্কশাল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট স্বাভাবিকভাবেই, আইন অনুযায়ী, এবং মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের করোনা সংক্রান্ত সংশোধনাগার খালি রাখবার গাইডলাইন মেনে, উক্ত চারজন অভিযুক্তকেই শর্তসাপেক্ষে জামিন দিয়ে দেন। এই শুনানি শেষ হয় সন্ধেবেলা, এবং বিচারপতি রায় দেন তারও বেশ কিছুক্ষণ পরে। এ পর্যন্তও, আমার ধারণায়, আইনবিরুদ্ধ কিছু বিশেষ হয়নি।

চিত্রনাট্য নাটকীয় মোড় নেয় ঠিক এই সময়েই। ব্যাঙ্কশাল কোর্টে শুনানি চলাকালীনই, বিকেল নাগাদ, সিবিআইয়ের তরফ থেকে হঠাৎ কলকাতা হাইকোর্টের মহামান্য ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির কাছে একটা ই-মেলের মাধ্যমে অভিযোগ করা হয় যে, রাজ্যের আইনমন্ত্রী কিছু সঙ্গী নিয়ে চলে গেছিলেন ব্যাঙ্কশাল কোর্টের আদালত প্রাঙ্গণে, এবং সেখানেই শুনানির সময় উপস্থিত ছিলেন, বিচারক বা ম্যাজিস্ট্রের ওপর চাপ ফেলতে, এবং প্রভাব খাটিয়ে অভিযুক্তদের জামিনের ব্যবস্থা করতে। সেদিন, কোভিড পরিস্থিতির জন্য কলকাতা হাইকোর্টের বিচার চলেছিল দুপুর তিনটে অব্দি। কোর্টের সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার অনেক পরে, সন্ধে নাগাদ, হাইকোর্টের মহামান্য ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ আরও একবার বসে, এবং সেখানে আরও এক দফা বিচার শুরু হয়।

সিবিআইয়ের মূল অভিযোগ তিনটি। ১. রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং নিজাম প্যালেসে ধর্নায় বসে পড়ে সিবিআইকে নিজের কাজ করা থেকে আটকাচ্ছেন এবং বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন, ২. রাজ্যের আইনমন্ত্রী এজলাসে উপস্থিত হয়ে, ব্যাঙ্কশাল কোর্টের বিচারককে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন এবং ৩. এই গ্রেপ্তারগুলোকে কেন্দ্র করে গোটা রাজ্যে একটা অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যার ফলে সিবিআই নিজের কাজ করতে পারছে না, এবং এই পরিস্থিতিতে বিচার সঠিকভাবে হওয়া সম্ভব নয়।

এইসব অভিযোগ ১৭ তারিখ সন্ধে অব্দি মৌখিক ছিল, এবং কোনো লিখিত পিটিশন সিবিআইয়ের তরফ থেকে মহামান্য হাইকোর্টের সামনে সেদিন ফাইল করা হয়নি। মহামান্য হাইকোর্টে ওই শুনানি শুরু হওয়া পর্যন্ত কেউই জানত না যে ব্যাঙ্কশাল আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট কী অর্ডার দিতে চলেছেন। শুনানির কোনো নোটিস দেওয়া হয়নি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের কাউকেই। কিন্তু তাও, প্রায় মধ্যরাতে, নিম্ন আদালতের রায়ের কপি না দেখেই, কোনো লিখিত পিটিশন ছাড়াই, উপরোক্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে, মহামান্য হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করেন, এবং ১৯ তারিখ আবার ওই শুনানির দিন ধার্য করেন। মহামান্য হাইকোর্ট ১৭ তারিখ প্রায় মধ্যরাতে ব্যাঙ্কশাল কোর্টের জামিনের অর্ডারের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়ার ফলে, মূল অভিযুক্ত চার নেতা-মন্ত্রীকেই সেই রাতেই প্রেসিডেন্সি জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। তারও খানিকক্ষণ পরে, শ্রী ববি হাকিম ছাড়া বাকি তিনজন অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় পিজি হাসপাতালে।

১৯ তারিখে, অভিযুক্ত পক্ষের সবাইকে নোটিশ দিয়ে, সিবিআই একটি লিখিত পিটিশন ফাইল করে হাইকোর্টে। এর মাধ্যমে মূল প্রার্থনা জানানো হয় যে, নিম্ন আদালতে উক্ত ‘সিবিআই ভার্সেস মুকুল রায় এন্ড আদার্স’ মামলার শুনানি না চালিয়ে তা যেন হাইকোর্টে স্থানান্তরিত করা হয়। পিটিশনে পার্টি করা হয় মূল চার অভিযুক্তকে, এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীকে। এঁদের সাথে আরও যুক্ত করা হয় শ্রী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে, যিনি নিম্ন আদালতে মূল অভিযুক্তদের হয়ে সওয়াল করেছিলেন। শুনানিতে সিবিআইয়ের তরফে উপস্থিত ছিলেন দেশের সলিসিটর জেনারেল শ্রী তুষার মেহতা। উক্ত চার মূল অভিযুক্তদের হয়ে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শ্রী সিদ্ধার্থ লুথরা। মুখ্যমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রীর হয়ে সওয়াল করার জন্য উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও রাজ্যসভার সাংসদ শ্রী অভিষেক মনু সিংভি। এছাড়া কলকাতা হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শ্রী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল শ্রী কিশোর দত্তও উপস্থিত ছিলেন।

শুনানির মূল উপপাদ্য — নিম্ন-আদালত, বা ব্যাঙ্কশাল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট, ১৭ তারিখ, ওই ‘সিবিআই ভার্সেস মুকুল রায় এন্ড আদার্স’ মামলায় মূল চার অভিযুক্তদের পক্ষে জামিনের রায় দেওয়ার সময়, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, বা আইনমন্ত্রী, বা অন্য কোনো নেতা মন্ত্রীর দ্বারা, বা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার সামগ্রিক পরিস্থিতির জন্য কোনভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন কিনা। অর্থাৎ, যদি প্রমাণিত হয় যে প্রভাবিত হওয়ার দরুন ওই জামিনের রায় দেওয়া হয়েছিল, তাহলে রায় খারিজ হবে এবং নতুন করে শুনানি হবে, হয় আবার সেই ব্যাংকশাল কোর্টেই বা মহামান্য হাইকোর্টে। এবং যদি প্রমাণিত হয়, যে কোনো রকম প্রভাব ছাড়াই সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ওই রায় দেওয়া হয়েছিল, তাহলে সেই জামিনের রায়েই বহাল থাকবে। নানান বাকবিতণ্ডার পর বোঝা যায় যে, ১৭ তারিখ ব্যাঙ্কশাল কোর্টে শুনানির দিন রাজ্যের আইনমন্ত্রী বা তাঁর সঙ্গীদের কেউই আদালত কক্ষে ঢোকেননি, একবারও। রাজ্যের তরফে প্রমাণ করার চেষ্টা হয় যে মুখ্যমন্ত্রীর ধর্না একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি। আইনমন্ত্রীর আদালত প্রাঙ্গনে যাওয়া শুধুমাত্র তাঁর সহকর্মীদের প্রতি উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ। আর নিজাম প্যালেসে লোকসমাগম, সিবিআইয়ের বেআইনি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ। এর সাথে বিচার প্রক্রিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই, কারণ সম্পূর্ণ বিচার প্রক্রিয়া হয়েছিল ভার্চুয়াল, অর্থাৎ অনলাইন মাধ্যমে। এবং আদালতকক্ষে বিচারক ও তাঁর আর্দালি ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না। উল্টোদিকে সিবিআইয়ের তরফে বলা হয়, কোন গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে যখন স্বয়ং রাজ্যের প্রধান আন্দোলনে নেমে পড়েন, তখন সেই গ্রেপ্তারির বিচারের সময়, নিম্ন আদালত স্বাভাবিকভাবেই প্রভাবিত হয়ে পড়বে। এছাড়া শুনানির শেষের দিকে মহামান্য জাস্টিস অরিজিৎ ব্যানার্জি এ-ও পর্যবেক্ষণ করেন যে, যদি নিম্ন আদালতের বিচারক কোনভাবে প্রভাবিত হতেন, তাহলে তিনি খুব সহজেই তাঁর অর্ডারে বা রায়ের মধ্যে সে কথার উল্লেখ বা ইঙ্গিত করতেই পারতেন। কিন্তু তা না করে সেই বিচারক সব পক্ষের আর্গুমেন্ট শুনে সেগুলোর আইনানুগ বিচার করেছেন। ১৯ তারিখের শুনানি এইখানেই সমাপ্ত হয় এবং পরের দিন আবার শুনানির জন্য ধার্য করা হয়। ২০ তারিখ ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির ব্যক্তিগত সমস্যার দরুন ওই শুনানি হয় ২১ তারিখ, অর্থাৎ শুক্রবার। সেদিন শুনানির শুরুতেই জানা যায় যে, চূড়ান্ত রায় কী দেওয়া হবে তা নিয়ে ডিভিশন বেঞ্চের দুজন জজের, অর্থাৎ ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির সাথে জাস্টিস অরিজিৎ ব্যানার্জির মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে, এবং তাঁরা দুজন মিলে কোনও মীমাংসায় আসতে পারছেন না। এমতাবস্থায় হাইকোর্টেরই আরও কিছু বিচারপতিদের নিয়ে, একটা লার্জার বা স্পেশাল বেঞ্চ তৈরি হবে, যেখানে পুরো শুনানি সম্পন্ন হবে এবং একটি চূড়ান্ত রায় পাওয়া যাবে। এই বেঞ্চ গঠন হওয়া, শুনানি হওয়া, ও চূড়ান্ত রায় আসা অব্দি, উক্ত চার অভিযুক্তকে আর জেল হেফাজতে থাকতে হবে না। বরং তাঁরা থাকতে পারেন গৃহবন্দী অবস্থায়, অর্থাৎ তাঁদের নিজেদের বাড়িতে। এখনো অব্দি প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, সর্বমোট পাঁচজন হাইকোর্টের মহামান্য বিচারপতিকে নিয়ে ওই লার্জার বেঞ্চ তৈরি হয়েছে।

মহামান্য ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ও মহামান্য জাস্টিস অরিজিৎ ব্যানার্জির ডিভিশন বেঞ্চের কার্য প্রণালীর পর আইনের ছাত্র হিসাবে নানা প্রশ্ন মনে আসা অযৌক্তিক নয়। এইভাবে বিনা নোটিসে, বিনা পিটিশনে, আদালতের সময়সীমা অতিক্রম করে, আইনের কোন ধারাকে কেন্দ্র না করে, নিম্ন আদালতের রায়ের কপি না দেখেই, মধ্যরাতে সেই রায়ের উপরে স্থগিতাদেশ দেওয়া, ভারতের আইন ব্যবস্থার ইতিহাসে, সম্ভবত প্রথম। এছাড়া মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের আপিলেট সাইডের রুল অনুযায়ী, কোন মামলার শুনানির সময় ডিভিশন বেঞ্চের দুজন বিচারপতির মধ্যে মতপার্থক্য হলে সাধারণত সেই মামলা স্থানান্তরিত হয় কোন তৃতীয় জজের কাছে। এই পরিস্থিতিতে লার্জার বা স্পেশাল বেঞ্চ গঠনের পদ্ধতিও, মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের শতাধিক বছরের ইতিহাসে, সম্ভবত প্রথম। প্রথমবারের মত আরো দেখতে পাওয়া গেল, আপিলের প্রভিশন থাকা সত্ত্বেও, শুধুমাত্র সিবিআইয়ের মৌখিক অভিযোগেই নিম্ন আদালতের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দিল মহামান্য হাইকোর্ট, নিজের সাংবিধানিক ক্ষমতার বলে। এসবই আইনি তর্ক, এবং সেই তর্কের অবসান এই লেখার মাধ্যমে হবে না। বর্তমানে উক্ত লার্জার বা স্পেশাল বেঞ্চে ওই মামলার শুনানি চলছে। শুধু সিবিআইয়ের অভিপ্রায় আরো বেশি করে স্পষ্ট হয়ে যায় এই ঘটনা থেকে, যে লার্জার বেঞ্চের শুনানির প্রথমেই সিবিআইয়ের তরফে শুনানি স্থগিত রাখার আবেদন করা হয়, এবং কারণ স্বরূপ জানানো হয় যে সিবিআই এই মামলাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে। সেই আবেদন যদিও গৃহীত হয়নি এবং লার্জার বেঞ্চ ২৪ তারিখের শুনানির পর আবার ২৬ তারিখ এই মামলার শুনানির দিন ধার্য করেছে।

লার্জার বেঞ্চ চূড়ান্ত রায় কী দেবে আমরা জানি না। যার পক্ষেই রায় যাক না কেন, অন্য পক্ষ সম্ভবত মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে আপিল করবেই। কিন্তু, উপরের খেলাচ্ছলে লেখা চিত্রনাট্য নিয়ে এখন পর্যন্ত কম আলোচনা হয়নি। সাধারণ মানুষ ও মিডিয়া উদগ্রীব হয়ে গোগ্রাসে গিলেছে শুনানির প্রতি মুহূর্তের আপডেট। সাধারণত কোন মামলার শুনানি নিয়ে সারাদিনের এই ব্যস্ততা সহজে চোখে পড়ে না। কিন্তু এই শুনানির সাথে সাথে উঠে গেল যে প্রশ্নগুলো, সেগুলোর উত্তর দেবে কে? প্রায় একমাস হতে চলল করোনা পরিস্থিতির জন্য কলকাতা হাইকোর্টের স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ আছে। হাতে গোনা কয়েকটি বেঞ্চের মাধ্যমে, দিনের মধ্যে মাত্র তিন ঘন্টা, অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত জরুরি কিছু মামলার শুনানি হচ্ছে শুধু। বিচার পাওয়ার আশায় দিন গুনছেন অজস্র মানুষ। নিম্ন আদালতের অবস্থাও তথৈবচ। আইনজীবী এবং ল্য-ক্লার্করা প্রায় সবাই কর্মহীন। প্রায় কোন মামলার বিচারই যেখানে হচ্ছে না, সেখানে, সন্ধেবেলা কোর্ট বসিয়ে, মধ্যরাতে স্থগিতাদেশ জারি করে, আবার পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ গঠনের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার এই প্রক্রিয়া থেকে প্রমাণ হয়, যে কাজ করা সম্ভব।

তাহলে খুলে দেওয়া হোক আদালত সকলের জন্য। রাত ১২টায় জেলে গিয়ে, রাত একটাতেই অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে ট্রান্সফার হওয়া, আবার সকাল ১২টায় হাউস অ্যারেস্টের অর্ডার আসতেই বিকেল তিনটের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাওয়া একজন অভিযুক্ত যদি ইচ্ছে মতন শুনানির সুযোগ পেতে পারেন, তা হলে সাধারণ বিচারপ্রার্থীরা কেন অপেক্ষা করবেন বছরের পর বছর? আমরা তো জানি, আইনের চোখে সকলেই সমান। সেই কেউ নেতা হোন বা আমজনতা। মিডিয়ার মাধ্যমে সমস্তটাই তো তাঁরা দেখছেন। সবাই তো দেখছেন, কিভাবে নির্বাচনে পর্যুদস্ত হওয়ার পর, শুধুমাত্র প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে এত বছরের একটা পুরনো কেসে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করে সমস্ত রাজ্যবাসীকে বিপদের মুখে ফেলে দেওয়া যায় এবং সেই কেসের অন্য দুজন অভিযুক্তকে ছোঁয়া পর্যন্ত হয় না। কারোর তো বুঝতে কিছু বাকি থাকছে না। সিবিআইয়ের এই যে কর্মপদ্ধতি, তাতে তো বিন্দুমাত্র বিশ্বাস আর কারোর থাকবে না, থাকার কথাও নয়। সম্ভবত এই কারণেই কিছু বছর আগে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন সিবিআই হচ্ছে খাঁচাবন্দি টিয়াপাখি, অর্থাৎ তাকে দিয়ে যা খুশি তাই বলিয়ে বা করিয়ে নেওয়া যায়।

সম্ভবত সিবিআইয়ের অভিপ্রায়, এই আকস্মিক, অপ্রয়োজনীয় এবং তর্কাতীতভাবে অন্যায্য গ্রেপ্তার, এত বছরের অস্বাভাবিক নীরবতা আর গোটা প্রক্রিয়ার পিছনে থাকা আসল অভিসন্ধির প্রশ্নও মহামান্য হাইকোর্টের লার্জার বা স্পেশাল বেঞ্চে বিচার হবে। কিন্তু কিছু কিছু প্রশ্ন তো থেকে যাবেই।

আমরা বারবার ভুলে যাই, দুর্নীতি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুধু দুর্নীতির অভিযোগে সরকার পড়ে যাওয়ার নিদর্শন এই দেশে একাধিকবার রয়েছে। কিন্তু সেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে আজ লোকে মুখ ফিরিয়ে হাসে। এর দায় কার? সিবিআই, সিআইডি সহ সমস্ত এজেন্সি বহু ব্যবহারে জীর্ণ। এর দায়ই বা কার? দেশের জনমানসে বারবার প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে বিচার ব্যবস্থা নিয়ে, বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে। এর দায়ই বা কার? কোনভাবে এই অবস্থার পরিবর্তন না করতে পারলে বিচারব্যবস্থার প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাসটাই না সবার চলে যায়, এই ভয়টাই এখন পাচ্ছেন প্রায় সমস্ত আইনজীবী। না, শুধু সমাজকে দায়ী করে বোধ হয় পাশ কাটানো যাবে না। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে না এখন আর। বরং হাসছে সম্ভবত।

নারদ স্ক্যামের বিচার ও তদন্ত – ছবি উইকিপেডিয়া ও দ্য কুইন্ট এর ওয়েবসাইট থেকে।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.