শুভদীপ গাঙ্গুলী

মেট্রো স্টেশন থেকে আমার বাড়ি ফেরার রাস্তায় তৃণমূল কংগ্রেসের একটা পার্টি অফিস পড়ে। যাতায়াতের সময় দেখি নানান বয়সের পুরুষ মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। মাঝেসাঝে আবার দু চারটে চেনা মুখও চোখে পড়ে যায়, যাঁরা সরাসরি তৃণমূল কংগ্রেস করেন না বলেই জানি। আচ্ছা, তাঁরা ঠিক কিসের লোভে ঐ অফিসে আসেন? এই রে! লোভ শব্দটা ব্যবহার করা মনে হয় ঠিক হল না। একটু ভাল থাকা, একটু ভাল জীবন পাওয়ার ইচ্ছে কার নেই? শহরের হোয়াইট কলার চাকরি করা মধ্যবিত্তের যাপনকে কি অনসাইট যাওয়া বা গ্রীন কার্ড পাওয়ার ইচ্ছে নিয়ন্ত্রণ করে না? সেক্ষেত্রে ঐ নিম্নবিত্ত মানুষগুলোর একটু ভাল থাকা, আরেকটু ভালভাবে বাঁচতে চেয়ে শাসক দলের অনুগ্রহপ্রার্থী হওয়াকে নিজের প্রিভিলেজড অবস্থান থেকে বিচার করা বোধহয় ঠিক হবে না।

আচ্ছা, একজন সাধারণ মানুষ ঠিক কী কারণে ভোট দেন? মানে নিজের পছন্দের প্রার্থী বাছেন কী করে? কিসের ভিত্তিতে? আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, আরেকটু ভাল থাকার চাহিদা আর সুযোগ জনমত তৈরিতে প্রধান ভূমিকা নেয়। তার জন্য সরকার বা শাসক দল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রোজগারের সুযোগ কতটা তৈরি করতে পারছে অথবা বিরোধী দল তার জীবন ও পরিবারের জন্য কতটা উন্নততর জীবনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তার চুলচেরা বিচারের উপর ঠিক হয় একজন ভোটার কাকে ভোট দেবে। যেসব দল বিভাজনের রাজনীতি করে, তাদের বিদ্বেষ ছড়ানোটাও কিন্তু ঐ চাওয়া, পাওয়া আর না পাওয়ার ভিত্তিতে হয়। মনে করে দেখুন আই টি সেলের মূল প্রোপাগান্ডাগুলো “সীমান্ত পেরিয়ে এসে রেশনের চাল থেকে কাজের সুযোগ সব নিয়ে যাচ্ছে” কিংবা “তুমি যে তোমার প্রাপ্য সুযোগ পাচ্ছ না, সে নিয়ে কিন্তু কেউ কিছু বলছে না, অথচ অমুক ধর্মের লোক হলে……”। অর্থাৎ তারা মূলত মানুষের না পাওয়ার রাগটা শাসকের বদলে কোন একটা ধর্মের মানুষের দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। এটাই তাদের রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড দিচ্ছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এবার গৌরচন্দ্রিকা ছেড়ে মূল বিষয়, “নো ভোট টু বিজেপি” –তে আসা যাক। কিছু অতিবাম এবং লিবারাল, যাদের কেউ কেউ হয়ত রাজ্যের বর্তমান শাসক দলের প্রতি কিঞ্চিৎ দুর্বল, তারা এই স্লোগানের উদ্ভাবক। তাদের মূল বক্তব্য বিজেপির রাজনীতি বিষাক্ত, তাই সে রাজনীতিকে রুখতে বিজেপিবিরোধী কোন শক্তিকে ভোট দিন। কেউ কেউ আবার আরো একটু এগিয়ে বলছেন যে বিজেপির বিরুদ্ধে যে যেখানে শক্তিশালী, তাকেই ভোট দিন। বিজেপির রাজনীতি যে বিভাজনের রাজনীতি এবং অত্যন্ত ক্ষতিকর রাজনীতি, তাতে বাম বা প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী কোন মানুষের কোনরকম সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু সমস্যা হল একজন সাধারণ ভোটার বিজেপিকে রুখে দেওয়াটা তার পবিত্র কর্তব্য বলে ভাবতে যাবেন কেন? বিজেপি “বাংলার সংস্কৃতির বিরোধী” বলে? সেই ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলার জীবনে বঙ্গ সংস্কৃতি মানে যদি মাঝে সাঝে সলমন খানের ছবি দেখতে যাওয়া, আর পিকনিকে টুনির মা বা টুম্পা চালিয়ে নাচা হয়, বিজেপি তার কোনটাতেই বাধা দেবে বলে মনে হয় না। তাহলে সে যদি বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেয়, তবেই দেবে যদি বিজেপির চেয়ে অন্য কোন দলের প্রতিশ্রুতি তার কাছে উন্নততর জীবনের আশ্বাস নিয়ে আসে। সেক্ষেত্রে যাকে খুশি ভোট দিন কথাটা তার কাছে কোন অর্থ বহন করে না। বরং তার মনোভাব যদি ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠানবিরোধী অর্থাৎ রাজ্যসরকারের বিরোধী হয়, যা হওয়ার যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে, তাহলে এই স্লোগান তার কাছে বিজেপিকেই একমাত্র তৃণমূলবিরোধি গ্রহণযোগ্য বিকল্প হিসাবে উপস্থিত করবে।

এদিকে কেউ কেউ বলছেন এই “নো ভোট টু বিজেপি” আগামী দিনে “ভোট ফর টিএমসি” স্লোগানে রূপ নিতে চলেছে। হয়তো ২০১১ নির্বাচনের আগে পরে বিভিন্ন ধারার অতিবাম শক্তির সাথে রাজ্যের শাসক দলের ঘনিষ্ঠতার কারনেই তাদের এরকম মনে হচ্ছে। তবে আমার মতে সেটা বরং অপেক্ষাকৃত ইতিবাচক স্লোগান। সে স্লোগান কিছু প্রতিশ্রুতির সামনে দাঁড় করাবে একজন নির্বাচককে। হ্যাঁ, সঙ্গে এ প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে, গত দশ বছরে তৃণমুল শাসনে সঙ্ঘের শাখার সংখ্যা ঢালাও বাড়ল কেন? প্রশ্ন উঠবে তৃণমূলের স্বৈরাচার নিয়ে, হাথরসের পাশাপাশি কামদুনি উঠে আসবে। উঠে আসবে সুদীপ্ত গুপ্ত থেকে মইদুল মিদ্যার নাম, অম্বিকেশ মহাপাত্রর গ্রেপ্তারি। কর্মসংস্থান থেকে বাকস্বাধীনতা — প্রতিটা ইস্যুতে তৃণমূল বিজেপির চেয়ে ঠিক কোথায় কোথায় ভাল প্রমাণ করতে হবে। এই স্লোগানের প্রবক্তারা হয়তো সে দায়টা নিতে চান না, তাই কাকে ভোট দেবেন না সেটুকু বলেই নিজেদের দায় মিটিয়ে ফেলতে চান। কিন্তু তাঁদের একটা কথা মাথায় রাখা জরুরি। গা বাঁচিয়ে আর যা-ই হোক রাজনীতি হয় না। রাজনীতি করতে হলে কিছু দায়িত্ব নিতেই হয়, আর হ্যাঁ, রাজনীতির পথ কোনকালেই কুসুমাস্তীর্ণ না।

~লেখক DYFI সদস্য এবং গণআন্দোলনের কর্মী (মতামত ব্যক্তিগত )

ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত

পড়ুন বিপক্ষের মতামত : কেন আমরা ‘নো ভোট টু বিজেপি’ বলছি >>

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.