সায়ক ঘোষ চৌধুরী
শাসক পাল্টে যায়। কিন্তু শাসনের রূপ বোধহয় একই থাকে।
পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সিঁড়ি হিসাবে ধরা হয় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণে অংশ নিতে অনিচ্ছুক কৃষকদের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকে। সিঙ্গুরে টাটার কারখানা তৈরির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নন্দীগ্রামেও একই ভাবে সালিম-সিপুত্রা গোষ্ঠীর জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ক্ষমতায় আসার দরজা খুলেছিলেন একদা ‘অগ্নিকন্যা’ মমতা বন্দোপাধ্যায়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম – দু জায়গাতেই শাসক দল সিপিএমের কিছু স্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তাঁরা জমির দালালি করার লোভে গায়ের জোরে গ্রামবাসী কৃষকদের থেকে স্বল্প মূল্যে জমি কেড়ে নিচ্ছিলেন। অভিযোগের সত্যাসত্য প্রমাণ করতে করতে গেম-সেট-ম্যাচ মমতা ব্যানার্জির, ক্ষমতায় তৃণমূল, সব অভিযোগ হিমঘরে। “তাহাদের কথা আর কেউ বলে না”; সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম হারিয়ে গেছে।
না, বোধহয় হারিয়ে যায়নি, রূপ বদল করে দেখা দিয়েছে। এবার অভিযুক্ত তৃণমূল কংগ্রেস এবং সেই দলের নেতা, কর্মীরা।
অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু ফরাক্কার বেনিয়াগ্রামের দাদনটোলা। অভিযুক্ত সংস্থার নাম আদানি পাওয়ার। আবার গ্রামবাসীদের জমি জোর করে হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা থেকে আদানি সংস্থার বিদ্যুৎ যাবে বাংলাদেশে। অভিযোগ, ফরাক্কার এনটিপিসি এলাকার ৫০০ বিঘা জমি আদানি গোষ্ঠীকে দিয়ে দিয়েছে ভারত সরকার। শ্রীলঙ্কায় সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছিল যে মোদী নিজে সে দেশের সরকারকে আদানির সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করতে বলেছিলেন। দুটি সার্বভৌম দেশের মধ্যে আদানি কী করে ঢুকছেন এবং মোদী কার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছেন দেশের মানুষের স্বার্থ বাদ দিয়ে – সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ভারত-বাংলাদেশ সরকারের মধ্যেও নাকি আদানি গোষ্ঠী বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে বলে চুক্তি হয়েছে। সেই বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা যে কৃষকদের জমির উপর দিয়ে, তাঁদের জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার। এলাকার তৃণমূল নেতাদেরই জমি দখল করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে স্থানীয় মানুষের অভিযোগ। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে জিলা পরিষদ হয়ে বিধানসভা – সর্বত্রই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ তৃণমূল। সামনে দাঁড়ায় সাধ্য কার?
অন্তত তেমনই ধারণা ছিল কেন্দ্রের মোদী সরকার আর রাজ্যের মমতা সরকারের। কিন্তু এলাকার আম ও লিচু চাষীদের নাছোড় মনোভাব আরও এক ভূমিরক্ষা আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে।
গ্রামবাসীদের বক্তব্য, যেখানে আদানি গোষ্ঠীর বিদ্যুতের টাওয়ার লাগানোর কথা ছিল, সেখানে না লাগিয়ে আম, লিচু বাগান এবং মানুষের আবাসনের উপর দিয়ে হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই, অর্থনৈতিকভাবেও কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একটা লিচু গাছ প্রায় ২০০ বছর বাঁচে। প্রতি বছর একেকটা গাছে যা লিচু হয়, তা থেকে বাৎসরিক আয় প্রায় ১৫,০০০ টাকা। আদানি গোষ্ঠী প্রতি বিঘা জমির দাম ঠিক করেছে তিন লক্ষ টাকা। কৃষকদের মতে তা যথেষ্ট নয়। প্রতি বছর যে জমির লিচু গাছ থেকে তিন লক্ষ টাকা রোজগার হয়, তার বিক্রয়মূল্য তিন লক্ষ টাকা হয় কী করে? তাঁরা বলছেন, এক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণ আইন, ২০১৩, অমান্য করা হচ্ছে।
মালদা এবং মুর্শিদাবাদের ফরাক্কা সংলগ্ন এলাকার মূল কৃষি উৎপাদন আম আর লিচুই। কয়েক লক্ষ মানুষের রোজগারের প্রধান উৎস এই চাষ। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের গুজরাট মডেল যে এখানে চালানো হচ্ছে, তা বুঝতে হবে। ফরাক্কা আর বীরভূমের মোহাম্মদবাজারের দেউচা-পাঁচামি এখানেই একাকার হয়ে যাচ্ছে।
মোদী সরকার মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার ‘Chaebol’ মডেল অনুসরণ করে ভারতের সব সম্পদ আদানি আর আম্বানি — এই দুই গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিতে চাইছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক শাসক পার্ক চুং হি গোটা দেশের সম্পদ স্যামসুং, হ্যুন্ডাই, এলজি, দেয়ু প্রভৃতি পরিবারভিত্তিক সংস্থাকে শক্তিশালী করতে কাজে লাগিয়েছিলেন। মোদীর লক্ষ্য আদানি আর আম্বানিকে বিশ্বের প্রধান ব্যবসায়িক সংস্থা করে তোলা এবং এই দুই কোম্পানির ভবিষ্যতের সঙ্গে ভারতবাসীর ভবিষ্যৎকে জুড়ে দেওয়া। আদানি, আম্বানির মুনাফা বাড়ানোই যেন দেশপ্রেমিক হওয়ার একমাত্র লক্ষণ। আম্বানি, আদানিকে “বিশ্বগুরু” করে তোলার পাশাপাশি ভারতের সব পরিকাঠামোর অধিকার এদের হাতে তুলে দেওয়ার পর মোদী তথা বিজেপি তাঁদের ভাগ বুঝে নেবেন – এরকমই মতলব বোধহয়। একে ইংরেজিতে Plutocracy বলা হবে, না oligarchy — তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু ঘটনা হল, মোদীর গুজরাট মডেলের অবয়ব স্পষ্ট।
ফরাক্কার বেনিয়াগ্রাম, বীরভূমের দেউচা-পাঁচামি — দুই জায়গার মানুষেরই অভিযোগ, জমি অধিগ্রহণের মামলা আদালতে বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও আদানি গোষ্ঠী কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সে কাজে পুলিশ প্রশাসন এবং শাসক দল তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা সাহায্য করছেন। বিরাট পুলিশবাহিনী নামিয়ে গ্রামবাসীদের বাড়ি বাড়ি ঢুকে অত্যাচার চালানো হচ্ছে এবং তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি জনগণের পক্ষে না থেকে আদানি গোষ্ঠীর সালিশি করছেন। ঠিক যে অভিযোগ ১৫ বছর আগে নন্দীগ্রামে লক্ষ্মণ শেঠের মত কিছু সিপিএম নেতার বিরুদ্ধে উঠেছিল।
আরো পড়ুন একশো দিনের কাজ: কেন্দ্রের বঞ্চনা, রাজ্যের দুর্নীতির যুগলবন্দী
দেউচা-পাঁচামির কয়লা, ফরাক্কার জমি, এমনকি সমুদ্রতটকে বন্দর বানিয়ে আদানির হাতে তুলে দেওয়া – সবই মোদীর গুজরাট রাজ্যে অনুসৃত আদানি মডেল অনুযায়ী চলছে। মোদীর গুজরাট শাসনের সময়েও ঠিক এভাবেই প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার, দলিত-আদিবাসীদের জমি, সমুদ্র বন্দর আদানি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। আদানির বন্দর হয়ে ভারতে মাদক চালান হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এমনিতে দেউচা-পাঁচামিতে পুরু ব্যাসল্টের স্তর ভেদ করে কয়লা উত্তোলন কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু তাতেও জমি অধিগ্রহণ এবং তৃণমূলের জমি মাফিয়াদের ধমকি থেমে থাকছে না। তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি এবং কয়লা, পাথর, গরু ও বালি পাচারে অভিযুক্ত অনুব্রত মন্ডলের স্পষ্ট হুমকি, জমি দখলে বাধা দিতে এলে তিনি “শুঁটিয়ে লাল” করে দেবেন। এই কাজ না হলে নাকি বীরভূমের কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ঘটনা হল, দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজের সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী গুজরাতে অপ্রচলিত শক্তি শিল্পে গত ২০ বছরে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ১২,০০০। অথচ ভাইব্র্যান্ট গুজরাট মোচ্ছবে কিন্তু ২০ লক্ষ কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। আসলে এই ধরনের শিল্পে জমিটাই যায়, বিকল্প কর্মসংস্থান হয় না। গুজরাটের দলিত, আদিবাসীরা ভুক্তভোগী।
প্রশ্ন হল, মমতা ব্যানার্জির সরকারের কী এমন দায় পড়ল, যে আদানি গোষ্ঠীর পক্ষ নিয়ে ফরাক্কার বেনিয়াগ্রামে বিক্ষোভরত জেলা পরিষদ সদস্য কংগ্রেসের আসিফ ইকবাল সহ গ্রামবাসীদের উপরে পুলিস লেলিয়ে দিয়ে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার? মোদী-দিদি আঁতাতের যে অভিযোগ কংগ্রেস, বাম সহ বিরোধীরা তোলেন, দেউচা-পাঁচামির পরে বেনিয়াগ্রামেও কি তারই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে? নয়ত মমতা ব্যানার্জির পুলিস, প্রশাসন হাইকোর্টে মামলার শুনানির অপেক্ষা না করে উর্দ্ধশ্বাসে আদানি গোষ্ঠীর কার্যনির্বাহী সদস্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হল কেন? উত্তরটা সমস্ত যুক্তিবাদী, স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষকে খুঁজতে হবে।
মতামত ব্যক্তিগত। তথ্য লেখকের
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।