ধরুন, এক টাইম মেশিনে চড়ে আপনি হঠাৎ পৌঁছে গেছেন আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে — ১৯৮২ সালের এক জুন মাসের গরমের দুপুরে, কলকাতা শহরে।

সময়টা অন্যরকম; মাত্র মাসখানেক আগে বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে দ্বিতীয়বার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন জ্যোতি বসু, রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকেই। চিটফান্ডের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেবার ফলস্বরূপ পরাজিত হয়েছেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র – মেছুয়াবাজারে সাময়িক উল্লাস।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এরই মধ্যে আপনি ডালহৌসি পাড়ায় বিশেষ কাজে গিয়ে ট্রাম থেকে নামলেন; নেমেই মাথায় বজ্রাঘাত, কারণ তখনই আবিষ্কার করলেন আশিটা টাকা এবং ট্রামের মান্থলি সহ আপনার মানিব্যাগটি পকেটমার হয়ে গেছে। নিকটবর্তী থানায় আপনি ডায়েরি করতে গেলেন – ডায়েরি নেওয়া হল বটে, কিন্তু যে আলগা উদাসীনতার সঙ্গে কাজটা করা হল, তাতে আপনি পরিষ্কার বুঝলেন আদতে ভস্মে ঘি ঢালা হল মাত্র। অফিসপাড়ায় এক বন্ধুর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে আপনি ক্ষুণ্ণমনে বাড়ি ফিরলেন।

পরের দিন সকালে কাগজ খুলে কিন্তু আপনার মনটা কিছুটা হলেও ভাল হয়ে গেল। একটি বহুলপ্রচারিত বাংলা দৈনিকের তিনের পাতায় আপনার পকেটমার হবার খবরটা ছাপা হয়েছে। আরও যা আপনাকে অবাক করল তা হল, সাংবাদিক জানিয়েছেন, আপনার পকেটমার হয়েছে সাড়ে দশটা নাগাদ ডালহৌসিতে। তার মাত্র মিনিট সাতেক আগে ওই একই জায়গা দিয়ে সাড়ম্বরে লালবাতি জ্বালিয়ে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী, যিনি পুলিশমন্ত্রীও। এক পথচারী নাকি সাংবাদিককে ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, শহরের সবচেয়ে সুরক্ষিত অঞ্চলে যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে গ্রামেগঞ্জে মানুষ এই প্রশাসনের আমলে কি অবর্ণনীয় অবস্থার মধ্যে আছেন, তা সহজেই অনুমেয়।

খবরটা পড়ে আপনার ভালো লাগলেও একটি ব্যাপারে আপনার মনে সামান্য খটকা থেকেই গেল। একটা পকেটমার হবার ঘটনায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে টেনে আনা কতটা উপযুক্ত সাংবাদিকতা, তা নিয়ে আপনার মনে একটা প্রশ্ন হয়ত জাগল।

কিন্তু আজ, এই ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে একটা কথা বুক ফুলিয়ে বলা যায়। সেদিন আপনার মনে যে প্রশ্ন জেগেছিল, আজ আর তা কোনোমতেই উত্থাপন করা যাবে না। কারণ আজকের বাংলা সাংবাদিকতা অনেক বেশি পরিণত, সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে এখন যে দায়িত্ববোধের পরিচয় পদে পদে পাওয়া যায়, তা পাঠককে বারংবার মুগ্ধ করে।

এই ধরুন গত মার্চ-এপ্রিল মাসে পশ্চিমবঙ্গে যখন পরপর ধর্ষণের অভিযোগ উঠে আসছিল, তখন সংবাদমাধ্যম যে সংযমের পরিচয় দিয়েছে, তার তুলনা মেলা ভার। সাগর, বসিরহাট, কেশপুর, হরিশচন্দ্রপুর, গলসি, হাঁসখালি, নামখানা, বোলপুর — সব জায়গা থেকেই উঠে আসছিল একই অভিযোগ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঘটনাগুলি কি কাগজ অথবা টেলিভিশনে প্রচারিত হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। দিনের পর দিন লেখালিখি হয়েছে, তদন্ত কীভাবে এগোচ্ছে তা জানতে পেরেছেন পাঠক। কিন্তু সেই আশির দশকের মত দায়িত্বজ্ঞানহী সাংবাদিকতার পরিচয় দিয়ে কেউ একবারও বলেননি, এর দায় নিতে হবে মুখ্যমন্ত্রীকে, যিনি আবার রাজ্যের পুলিশমন্ত্রীও বটে। লেখেননি বা বলেননি, কারণ তাঁরা জানেন এমন কথা বলা মানে এক ধরনের অস্থিরতাকে প্রশ্রয় দেওয়া, যা একেবারেই দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা নয়।

এরই মধ্যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এক ধর্ষিতাকে নিয়ে কিছু আলটপকা মন্তব্য করে বসলেন। সন্দেহ নেই খুবই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। কিন্তু সংবাদমাধ্যম যেভাবে পুরো ব্যাপারটিকে সঠিক পথে পরিচালিত করল, তার জন্য তাদের অজস্র ধন্যবাদ প্রাপ্য। যিনি হালকাভাবেও মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করলেন, তিনিও তৎক্ষণাৎ পাশাপাশি মনে করিয়ে দিলেন, কন্যাশ্রী থেকে শুরু করে পরপর কতগুলি প্রকল্প মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে এই রাজ্যে চালু হয়েছে। সত্যিই তো, এটুকু তো করতেই হবে – রাজ্যের বাইরে ভুল বার্তা যাতে না যায়, তার জন্য বাংলার সাংবাদিকরা সদাসতর্ক।

তারপর ধরুন, এই শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারটা। রাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত বারবার বলছে চরম দুর্নীতি হয়েছে, স্রেফ টাকা নিয়ে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে, গোটা দুয়েক শিক্ষামন্ত্রী ওতপ্রোতভাবে এর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এই আপতকালেও সংবাদমাধ্যম তাদের পরিণত মনের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছে। সেই আগের মত বালিগঞ্জ ফাঁড়ির সামনে ট্রাম লাইনচ্যুত হলেও জ্যোতিবাবু দায়ী — এই বোকাবোকা মনোভাব থেকে তারা বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছে। দুই শিক্ষামন্ত্রীই একই ক্যাবিনেটের সদস্য – কিন্তু তাতে কী? মুখ্যমন্ত্রী সেই টাকার ভাগ পেয়েছেন — এমন অবাস্তব অভিযোগ কিন্তু কেউ আনেননি। এ কি সেই অন্নদাশঙ্করের ছড়া নাকি? যেখানে যা কিছু অনাসৃষ্টি, সকলের মূলে কমিউনিষ্টি! বাংলার অপমান হোক, এমন কোনো কাজ এঁরা করেন না।

বিরোধীপক্ষে কিছু লোক আছেন, যাঁদের কাজই হল যুক্তিহীন সমালোচনা করা। এঁদের বক্তব্য, এই সাংবাদিকরা নাকি অনেকে শাসক দলের কাছ থেকে টাকা পান, ফ্ল্যাট পান; অনেকে আবার রাজ্য সরকারের কাছ থেকে নিয়মিত ভাতা পেয়ে, অথবা গোটা দুয়েক রাজনৈতিক দলে নাম লিখিয়ে, ইতিমধ্যেই এমএলএ, মন্ত্রী হয়েও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা চালু রেখেছেন।

আরো পড়ুন সাংবাদিক একা অসৎ হতে পারেন না, দুর্নীতি এখন প্রাতিষ্ঠানিক

সর্বৈব মিথ্যা কথা। প্রয়োজনে এঁরা কঠোর সমালোচনা করতে পারেন, আগুন ছোটাতে পারেন কলম দিয়ে। যাঁদের সন্দেহ আছে, তাঁরা পড়ে দেখতে পারেন উত্তরপ্রদেশে দলিত হত্যা নিয়ে বাংলা সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টিং। অথবা ইউক্রেনে রুশ আক্রমণ নিয়ে সিপিএম যখন নেহাত একটি সাদামাটা বিবৃতি দিল, তখন কি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বামপন্থীদের এই নৈতিক অধঃপতনের সমালোচনা করা হয়েছিল তা ছিদ্রান্বেষী পাঠককে একবার চোখ বুলিয়ে দেখতে অনুরোধ করি।

এই সাংবাদিককুল আমাদের গর্ব। এঁদের লেখা পড়লে শ্রদ্ধায় মাথা আপনা থেকেই নিচু হয়ে আসে।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

4 মন্তব্য

  1. হ্যাঁ, মাথা অব উপসর্গ সহ নত এমন ভাবে হয়, সহজে আর উঠতে চায় না৷ বছর ছয় আগে আমরা অনেকে মিলে নিয়োগের দাবীতে লাগাতার আন্দোলন করছিলাম। তখন দু’বার ফর্ম ফিল আপ করিয়ে ক্যান্সেলড হয়েছিল। আমাদের ভয় ছিল, তৃতীয়বারের ফর্মও হয়তো মরীচিকায় পরিণত হবে৷ আমরা ‘নিয়োগের প্রতিশ্রুতি’র প্রতীকি শ্রাদ্ধ শান্তি করলাম। উত্তরবঙ্গ সংবাদের সাংবাদিক ফোনে পুরো বিষয় লিখিত চাইলেন৷ লিখে ওঁকে মেসেজে পাঠালাম। পরদিন কাগজে আমাদের লিখিত হুবহু ছাপা হল৷ সাংবাদিক কিংবা নিউজ ডেস্ক শুধুমাত্র শিরোনাম জুড়েছিলেন৷ শিরোনামে লেখা ছিল- শিক্ষামন্ত্রীর কুশপুতুল পোড়ানো হল রায়গঞ্জে। অথচ শিরোনামের সঙ্গে ভেতরের কথাবার্তার কোনো সম্পর্ক অবধি পাওয়া গেল না।

    গত বছর ‘অভিসন্ধি'(লিটল) প্রকাশের আগে পোস্টার সাঁটি দেয়ালে৷ ‘যদি রাষ্ট্রের হাতে বন্দুক থাকে, আমাদের হাতে কেন থাকবে শুধুই পতাকা’- পোস্টারের বয়ান৷ পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বুম হাতে সাংবাদিক বললেন, নির্বাচনের আগে মাওবাদীদের হুমকিপূর্ণ পোস্টারে ছেয়ে গেল শহর৷ পুলিশও ডেকে পাঠিয়েছিল আমায়৷

    গত কয়েক বছরে অন্তত চার বার শুধুমাত্র আমারই সঙ্গে বিচিত্র সব ঘটনা ঘটেছে৷ এ’সব অভিজ্ঞতা থেকে কাগজে ছাপা হরফে সব লেখা পড়ে বিশ্বাস করতে অস্বস্তি হয়৷

    মিডিয়ার ক্ষমতা যতটা বাড়ছে, বিশ্বাসযোগ্যতা ঠিক ততটাই কমছে৷

    খুব জরুরি আপনার এই লেখা… ❤️

  2. ‘নাগরিক’ যে এমন নিষ্কৃষ্ট মানের লেখা প্রকাশ করছে তা এই নিবন্ধ না পড়লে জানতে পারতাম না 😂

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.