‘এন্ড নাও ফাউন্ডেশন’ হল ভারতের প্রথম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যারা আন্তর্জালিক নৈতিকতা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা (Better Internet Ethics and Digital Wellbeing) বিষয়ে কাজ শুরু করেছিল ৷ এই সংস্থা জানিয়েছে, নিয়মিতভাবে যাঁরা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করেন তাঁদের মধ্যে অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ভাবে ট্রোলিং-এর শিকার হয়েছেন। ট্রোলিং-এর প্রভাব কী হতে পারে তা নিয়ে সারা বিশ্বে অনেক গবেষণা হয়েছে। গবেষণাগুলি জানাচ্ছে যে, যাকে ট্রোল করা হয়, তার মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে । মানসিক অবসাদ ও উদ্বেগের শিকার হতে পারেন, এমনকি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়তে পারেন তাঁরা। ট্রোলিং-এর কোপে পড়ে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন কমবয়সীরা। নিরন্তর ব্যঙ্গ বিদ্রুপ তাঁদের আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরায় সহজেই।
আমরা ভারতবাসীরা এখন ইন্টারনেট ট্রোলিংয়ে রীতিমতো অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে যে কোনো রকম রাজনৈতিক বিষয়ে মতামত রাখলেই দেখা যায় বিপরীত রাজনৈতিক মতাবলম্বী মানুষজনের একাংশ ঝাঁপিয়ে পড়েন। বেশ কিছু রাজনৈতিক দল শুধুমাত্র ট্রোল করার জন্য পয়সা দিয়ে লোক নিয়োগ করে। এই মানুষগুলির কাজই হল নিয়োগকারী রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা অথবা সেই দলমতের বিরুদ্ধমত কোনো সামাজিক মাধ্যমে চর্চিত হতে দেখলেই সেখানে গিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে আসা। তবে এই নিয়োগ করা ব্যক্তিরা ছাড়াও বেশ কিছু মানুষ আছেন যাঁরা সামাজিক মাধ্যমে অন্যকে ছোট করে আনন্দ পান। মনোবিদরা বলেন এই মানুষগুলি আসল জীবনে বুলি করতে ভালোবাসেন। সামনাসামনি লাঞ্ছনা করার থেকে ইন্টারনেটে অন্য মানুষকে হেয় করা আরও বেশি সহজ কারণ নিজের নাম লুকিয়ে, মিথ্যে পরিচয়ের আড়ালে থেকেও, এখানে অন্য মানুষকে কষ্ট দেওয়ার আনন্দটা দিব্যি পাওয়া যায়।
ট্রোলিং কি শুধু বিপরীত রাজনৈতিক মতবাদের লোককে করা হয়? না। তা একেবারেই নয়। যে মানুষটিকে দেখলেই একটু ব্যতিক্রমী মনে হয় তাঁকেই ট্রোল করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ একজন মানুষের ছবি দেখে যদি তার লিঙ্গ পরিচয় সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন জাগে তাহলে তাঁকে অবশ্যই হাজার হাজার অপরিচিত মানুষ এসে ব্যঙ্গ করবেন, ফেসবুক ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক মাধ্যমে এ জিনিস নিয়মে পরিণত হয়েছে। একইভাবে অন্যান্য সামাজিক মাপকাঠি নিয়েও ট্রোল করা হয়ে থাকে। যেমন ভাষিক পরিচয়, কায়িক চেহারার বৈশিষ্ট্য, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, বা যেকোনো প্রান্তিক পরিচয়। এখানে অবশ্যই যে কথা না বললেই নয় তা হল, বর্তমান ভারতবর্ষে ধর্মের ভিত্তিতে ট্রোলিং করা প্রায় স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি ট্রোলিং-এর বিশেষ কিছু নিদর্শন দেখলেন পশ্চিমবঙ্গবাসী। এই হাসি তামাশা শুরু হয় মাধ্যমিকের মেধা তালিকা প্রকাশ পাবার পর, এবং উচ্চমাধ্যমিকের মেধা তালিকা প্রকাশিত হলে তা নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ অত্যন্ত নিম্ন রুচির দিকে এগোয়। মাধ্যমিক পরীক্ষায় যে মেয়েটি প্রথম হয়েছে তার ছবিতে আমরা দেখি যে তার মাথার চুল খুবই ছোট করে কাটা। ফলে তার ছবি বা ভিডিওর তলায় “ছেলে না মেয়ে”, “হিজড়া”, “সমকামী” ইত্যাদি মন্তব্যের সঙ্গে যৌনগন্ধী হাসি ঠাট্টার ধুম পড়ে যায়। মাধ্যমিকে যুগ্মভাবে দ্বিতীয় হওয়া ছেলেটির মুসলমান নাম দেখামাত্র শুরু হয়ে যায় তাকে জঙ্গি দলের সরদার বলে মন্তব্যের বন্যা। বেশ কিছু ব্যক্তি লেখেন মুসলমান বলেই ছেলেটিকে বেশি নম্বর পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও কী কারণে তা করা হবে তার কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। ভারতে এখন আর মুসলমান বলে কাউকে হেনস্থা করা হলে অবাক হই না। এদেশের কিছু মানুষের মনে যে বিদ্বেষ-বিষ ছিল, তাকে নানা ভাবে হাওয়া দিয়ে ফুলিয়ে বড় করার কাজ করতে বিজেপি সক্ষম হয়েছে।
এর এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রকাশিত হয় উচ্চমাধ্যমিকের ফল। এবারও শুরু হয় নানা ধরনের ট্রোলিং। সবথেকে বেশি বিদ্রুপ এর শিকার হতে হচ্ছে চতুর্থ স্থানাধিকারী একটি মেয়েকে। মেয়েটির দোষ সে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছে যে সে পশ্চিমবঙ্গের দুর্নীতি নিয়ে ক্ষুব্ধ। তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকরা যে ভাষায় এই মেয়েটিকে আক্রমণ শুরু করেছে তা আলোচনা করতে লজ্জা লাগে। এই মেয়েটির বাবাকে চোর বলা, বাবা মায়ের যৌনজীবন নিয়ে রসিকতা, কিছুই বাদ নেই এই তালিকায়। একটি সতেরো আঠারো বছরের ছাত্রী, যে খুব সম্ভবত আগামী বছর ভোট দেবে, সে চোখের সামনে দেখেছে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হতে, শিক্ষামন্ত্রী ও অন্যান্য শিক্ষা অধিকর্তাদের জেলে যেতে ৷ তার পক্ষে কি এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলাই স্বাভাবিক নয়? তথাকথিত শিক্ষিত মানুষরাও যোগ দিয়েছেন এই মেয়েটিকে ট্রোল করতে। বারবার মনে করানো হচ্ছে যেহেতু মেয়েটি সরকারি সুযোগ সুবিধা পেয়েছে, তাই সরকারের কোনো দোষ ধরার অধিকার তার নেই। অথচ দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা সকলেই কোনো না কোনো সরকারি সুবিধা নিয়ে থাকি, তার জন্যে কি সকলেই সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করার অধিকার হারিয়ে ফেলেছি? তাছাড়া কন্যাশ্রী প্রকল্প বা সবুজ সাথী প্রকল্প চলে সরকারি টাকায়, যার প্রধান উৎস জনগণপ্রদত্ত কর ৷ কোনো একটি রাজনৈতিক দলের দান এগুলো হতে পারে না। এই বিষয়গুলিকে অদ্ভুত ভাবে গুলিয়ে দিয়ে মেয়েটিকে কেউ কেরালা চলে যেতে বলছেন, কেউ বা চীন দেশে যেতে বলছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো সমালোচনা করলেই যে পাকিস্তান চলে যেতে বলা হয় আমাদের, সেই হুমকির সঙ্গে এই হুমকির পার্থক্য কিছুই নেই। তৃণমূল কংগ্রেস যদি মনে করে দুর্নীতির মোকাবিলা করার মুখ্য উপায় “নিন্দারে করিব ধ্বংস কণ্ঠরুদ্ধ করি”, তাহলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করছে – এ কথা সাধারণ মানুষ মানবে না।
এই দুঃসহ সময়ের একমাত্র সান্ত্বনা উচ্চমাধ্যমিকে মেধাতালিকায় থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের বক্তব্যগুলি। চিরাচরিত কথা না বলে তারা অনেকেই মূল স্রোতের সংবাদমাধ্যমকে এমন কিছু কথা বলেছে যা মনে আশা জাগায়। এক অতি সাধারণ পরিবারের ছেলে “বড় হয়ে কী হতে চাও” প্রশ্ন শুনে টিভি সাংবাদিককে মুখের ওপর বলছে “আমি বলব না” – এ আমাদের কাছে অভিনব অভিজ্ঞতা । আরেকজন তার রূপান্তরকামী পরিচয় লুকোবার প্রয়োজন বোধ করেনি। সে গর্বের সঙ্গে জানিয়েছে সে কিছুদিন বাদেই তার নাম পরিবর্তন করবে এবং রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য কাজ করবে। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে এবছর যারা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলো, তারা অত্যন্ত সংবেদনশীল বয়সে অতিমারীর সম্মুখীন হয়েছে। বয়ঃসন্ধিকালের এই কঠিন অভিজ্ঞতা তাদের হয়তো আরও শক্ত করেছে, আরও সচেতন করেছে। যুগের নিয়মে ট্রোলিংকে মোকাবিলা করার পদ্ধতিগুলিও জেনে নিতে হবে তাদের। কারণ, রাজনৈতিকভাবে সচেতন যুব সমাজ গড়ে তোলাই দেশের প্রকৃত উন্নতির একমাত্র পথ।
Like this:
Like Loading...
Related
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
প্রিয় পাঠক,
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।