খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে মহারাষ্ট্রের দাহানু, পালঘর প্রভৃতি অঞ্চলে দাস ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। সামন্ত প্রভু শাহুকারেরা বাড়িতে বেগার খাটাতো। জমিদার, মালিকের আদেশ ছাড়া দাসদের কাজের সময় জল পান করার অনুমতিও ছিল না। অসহ্য ক্লান্তিতে জেরবার হয়ে গাছের ছায়ায় সামান্য বিশ্রামের সুযোগ ছিল না। কোনো কারণে অসুস্থ হলেও নিস্তার নেই। সেই অসুস্থ শরীরেই ধুঁকতে ধুঁকতে কাজে আসতে হত। কমিউনিস্ট নেত্রী গোদাবরী পারুলেকর, শ্যামরাও পারুলেকর তীব্র গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই নারকীয় ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটিয়েছিলেন। গোদাবরী তাঁর সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার, জহরলাল নেহেরু পুরস্কার, সোভিয়েত ল্যান্ড পুরস্কার জয়ী আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস- ‘জেউহা মানুষ জাগা হোতো’-এর পৃষ্ঠায় সেই নারকীয় সময়ের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে ছবিটা ঠিক একইরকম না হলেও প্রথমে যুক্তফ্রন্ট এবং পরে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার আগে গ্রামের দিকে বেশ কিছু জায়গায় প্রায় সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। শ্রমিক, কৃষি মজুর, এমনকি সরকারি দপ্তরেও চুক্তি ভিত্তিক কর্মচারীদের মালিক ও আমলারা দাস মনে করতেন। শিক্ষকদের বেতন কাঠামো কেবল কমই ছিল না, তাঁরা উপযুক্ত মর্যাদা পেতেন না। বাধ্য হতেন পথে নামতে। বাম সরকারের চরম নিন্দুকরাও একথা স্বীকার করবেন যে, শ্রমিক, শিক্ষক, কর্মচারীদের সম্মান ও অধিকার বিগত বাম সরকার অনেকাংশেই প্রতিষ্ঠা করেছিল।

এই লেখার উপরের অংশটুকু বর্তমানের তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি সিদ্ধান্ত বিষয়ে আলোচনার গৌরচন্দ্রিকা মাত্র। সম্প্রতি নবান্ন থেকে একটি নির্দেশিকা জারি করে বলা হয়েছে, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কাজ চলাকালীন কোনো রকম ঝামেলা এড়াতে কাজের সময় এবং টিফিন অর্থাৎ দুপুরের খাওয়ার সময়ের বিরতিতে বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে সরকারি কর্মীদের। একই নির্দেশিকা সরকার পোষিত বিদ্যালয়গুলির ক্ষেত্রেও বলবৎ করা হয়েছে। নির্দেশিকায় একাধিক বিষয়ের সাথে উল্লেখযোগ্য ভাবে বলা হয়েছে, দুপুর দেড়টা থেকে দুটো পর্যন্ত মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে শিক্ষক, কর্মচারীরা কেউ বিদ্যালয় বা দপ্তরের বাইরে বেরোতে পারবেন না। কোনো রকম মিটিং মিছিল আন্দোলন করতে পারবেন না। নিয়মলঙ্ঘনকারী শিক্ষক, শিক্ষিকা, কর্মচারীকে অনুপস্থিত হিসেবে ধরা হবে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এতখানি অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত যে সরকার তার কর্মীদের উপর চাপিয়ে দেয়, তাকে স্বৈরাচারী বলতে কোনো দ্বিধা থাকতে পারে না। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট কিছু নিয়মশৃঙ্খলা থাকবে এবং কর্মচারীদের তা মেনে চলতে হবে – এই নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। শিক্ষক-শিক্ষিকারা নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যালয়ে আসবেন, পড়াবেন, এই বিষয়েও কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। একই সঙ্গে, আমাদের রাজ্যের শিক্ষক বা সরকারি কর্মচারীরা তাঁদের অধিকারের অপব্যবহার একদমই করেন না, এমনটাও বলা যাবে না। শিক্ষক কর্মচারীদের কর্মসংস্কৃতি নিয়ে অতীতে একাধিকবার প্রশ্ন উঠেছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য স্লোগান তুলেছিলেন- ‘ডু ইট নাও।’ সামগ্রিকভাবে জনমানসে রাজ্যের শিক্ষক কর্মচারীদের কর্মসংস্কৃতি নিয়ে অসন্তোষ আছে। কর্মসংস্কৃতি উন্নত হোক, কাজের পরিবেশ আরো শৃঙ্খলাপরায়ণ হোক, নাগরিক মাত্রই তা চাইবেন। কিন্তু এর দাওয়াই সরকারি স্বৈরাচার নয়৷ সমস্যা হল, বর্তমান শাসকদল শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতি সাধারণ নাগরিকদের অসন্তোষকে ব্যবহার করে আসলে বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর দমাতে চাইছে। বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বলা যায় এখন অনির্দিষ্টকালের গরমের ছুটি চলছে। সরকারই এই ছুটি ঘোষণা করেছে। ছুটির জন্য পঠনপাঠন বিঘ্নিত হচ্ছে। শুধু অপরিকল্পিত ছুটি নয়, বিভিন্ন সময়ে ইচ্ছেমত ছুটি দেওয়া হয়, যেটি নিশ্চিত ভাবে কর্মসংস্কৃতির ভালো নমুনা নয়। একদিকে সরকার বলছে কর্ম দিবস বাড়াতে হবে, অন্যদিকে পুজোয় ছুটি বাড়িয়ে দশ দিন করেছে। এমনকি ‘জামাইষষ্ঠী’তে অর্ধদিবস অফিস ছুটি! এমন করে নিশ্চয়ই কর্ম দিবস বাড়ানো যায় না। কাজেই, সরকার কর্মসংস্কৃতি ও কাজের পরিবেশ উন্নত করতে মধ্যাহ্নভোজের বিরতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, এমনটা মানতে চাইছেন না শিক্ষক কর্মচারীরা। তাঁদের মত, সরকার তাঁদের ন্যায্য দাবী এবং আন্দোলনকে দমন করতে চাইছে।

ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসকেরা জোর করে, বল প্রয়োগ করে বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করে। ফ্যাসিবাদীরা কোনো মতেই সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। ফ্যাসিবাদ ব্যক্তিগত পরিসর, স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর স্বীকার করে না। আমাদের রাজ্যে এখন ফ্যাসিস্ট সরকারেরই ছায়া। স্বৈরশাসকের মতের বিরোধী কণ্ঠস্বর দমানোর প্রয়াস চলছে। চলতি নির্দেশিকা দ্বারাও রাজ্য সরকার ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বী কর্মচারী, শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। কর্ম সংস্কৃতি, শৃঙ্খলা-সহ সরকার ঘোষিত সমস্ত কিছুই বাইরের মুখোশ মাত্র।

তৃণমূল সরকার বর্তমান সময়ে একাধিক বিষয়ে বিব্রত। দীর্ঘদিন ধরে সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাঁদের ন্যায্য ডিএ-র দাবীতে আন্দোলন করছেন। প্রতিবাদ, কর্ম বিরতি, লাগাতার ধর্ণা, শহীদ মিনারে শিক্ষক কর্মচারী সমাবেশ, শেষে সফল ধর্মঘট পর্যন্ত সংগঠিত হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগ সহ একাধিক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়েও সরকার প্রচণ্ড চাপে। নানামুখী অভিযোগে তৃণমূল সরকার বিব্রত, তাই ফ্যাসিস্ট কায়দায় শিক্ষক কর্মচারীদের অধিকার হরণ করতে চাইছে। সরকার চাইছে কর্মীদের একান্ত আনুগত্য। চাইছে জো হুজুর কর্মী সংগঠন। চাইছে সরকারি কর্মীরা কেউ যেন সরকারের বিরুদ্ধে কিছু না বলেন। সাধারণত অফিসে মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে কর্মচারীরা গণতান্ত্রিক উপায়ে নিজেদের দাবী উত্থাপন করেন, স্লোগান মিটিং মিছিল ইত্যাদি সংগঠিত করেন। এই সবকিছুই কর্মচারীদের দীর্ঘ দিনের আন্দোলনের ফলে অর্জিত অধিকার। বর্তমান সরকার কর্মচারীদের সেই অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে।

সরকারের এই কালা নির্দেশিকায় কর্মচারীরা যেমন বিপদে পড়বেন, তেমনই মারাত্মক বিপদে পড়বেন শিক্ষকরা। বিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতিগুলির মাথায় শাসকদল মনোনীত দলীয় নেতা-কর্মীরা বসে আছেন। তারা এই নির্দেশিকাকে হাতিয়ার করে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বী শিক্ষক, শিক্ষিকাদের চূড়ান্ত ভাবে হেনস্তা করবেন, এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গ প্রায় পুলিশ-রাজ্যে পরিণত হয়েছে। সাধারণ নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিদিন প্রশ্ন চিহ্নের সামনে, তার উপর কর্মচারী শিক্ষকদের দমন করার জন্য সরকারের দানবীয় নির্দেশিকা, ব্যক্তিগত পরিসর নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের সংকেত দিচ্ছে। বিভিন্ন কারণেই এই নির্দেশিকায় সাধারণ নাগরিক হয়তো তেমন ভাবে আন্দোলিত হবেন না। সেই নির্লিপ্ততার সুযোগে আগামী দিনে সরকার বিরোধী নাগরিক কণ্ঠস্বর চরম ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। কর্মচারীদের বেগার শ্রমিকের মত সরকারের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে হবে, চলতে হবে নবান্নের মর্জিমতো। সরকার যতটুকু পারিশ্রমিক দেবে, মুখ বুঁজে তাই নিতে হবে। কোনোভাবেই নিজের জীবন জীবিকার স্বার্থে ন্যায্য প্রশ্ন, দাবী তোলা যাবে না। কারণ ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনতে চায় না। ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার চায় প্রশ্নহীন বেগার শ্রমিক।

~মতামত ব্যক্তিগত।

আরো পড়ুন

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.