পশ্চিমবঙ্গে জাত, ধর্মের বিভাজন নিয়ে কথা বলতে বসেছেন সাহিত্যিক ও শিক্ষিকা, উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা মৌমিতা আলম আর চলচ্চিত্র পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার, কলকাতার বাসিন্দা দেবারতি গুপ্ত। আজ কথোপকথনের দ্বিতীয় তথা শেষ কিস্তি।
২০০৯ সাল থেকে মতুয়ারা যে পশ্চিমবঙ্গের মূলধারার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করল তার একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত আছে। ১৮৬০ সালে হরিচাঁদ ঠাকুর আর গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে দক্ষিণবঙ্গের নমশূদ্ররা প্রথম একজোট হয়ে এক নতুন ধর্ম চর্চা শুরু করে। শূদ্র ও অস্পৃশ্যদের নিজস্ব ধর্মপালনের মধ্যে দিয়ে অবিভক্ত বাংলায় দলিতরা দলবদ্ধ হয়। তারপর কখনো তারা কংগ্রেসের সঙ্গে থেকেছে, কখনো বিচ্ছিন্নভাবে নিজেদের গোষ্ঠীর দাবিদাওয়া নিয়ে সোচ্চার হয়েছে। ভোটের রাজনীতিতে তাদের গুরুত্ব আন্দাজ করে ২০০৯ সালে তাদের নিয়ে বিজেপি আর তৃণমূল লোফালুফি খেলতে শুরু করে। মতুয়ারা অনেকে বিজেপিতে যোগ দেন, আবার এক দল তৃণমূলের সঙ্গে থেকে যান। যা-ই হোক পশ্চিমবাংলায় দলিতদের দলবদ্ধ রাজনীতিকরণ বলতে তো ওটাই। ওদিকে উত্তরবঙ্গে রাজবংশী সমাজ ঐতিহাসিকভাবেই বহুধাবিভক্ত। তুমি ধর্মের বিভেদের কথা একটু বলেছ, আবার তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে রাজবংশী জমির মালিকদের বিরুদ্ধে রাজবংশী কৃষি শ্রমিকরাই লড়াই করেছিলেন। অর্থাৎ পরিচিতির নিরিখে এককাট্টা হবার কোন হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। এ সম্বন্ধে তোমার কী বক্তব্য?
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ঠিকই বলেছ। দলিত পরিচয় নিয়ে রাজবংশীদের দলবদ্ধ হবার কোনো ইতিহাস নেই। তাছাড়া আমার জ্ঞানত, উত্তরবঙ্গে মতুয়াদেরও আলাদা কোনো কার্যকলাপ দেখিনি, যদিও এখানে প্রচুর নমশূদ্র আছেন। তাঁরা সমাজের খুবই পিছিয়ে পড়া অংশ। আমাদের রাজবংশী দলিত হিন্দুদের থেকেও আর্থিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া। অবশ্য তাঁরা তফসিলি জাতি বা শিডিউলড কাস্ট স্টেটাস পেয়েছেন। এবার এইখানে একটা মজার কথা বলি। এই দলিত বা মুসলিমরা তো কেউ সমজাতীয় মানুষের গোষ্ঠী নয়। তুমি তো নিজেই বললে, তেভাগা আন্দোলনের সময় উত্তরবঙ্গে রাজবংশী জোতদার ও রাজবংশী কৃষকদের মধ্যেকার বিরোধের কথা। অর্থাৎ যখন কোনো সম্প্রদায়কে আমরা শুধুমাত্র তার ধর্মীয় বা জাতিসত্তার পরিচিতির নিরিখে শনাক্ত করে সেই লাইনে তাদের গোষ্ঠীবদ্ধ করব, তখন কিন্তু সেই গোষ্ঠীর আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, অর্থাৎ শ্রেণির দ্বন্দ্ব, এবং ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে আরও ভয়ঙ্কর জাতের দ্বন্দ্ব, ঢাকা পড়ে যাবে। এখানেই তো বামপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা। দেখো, দেশের কিছু মুসলিম তো এখন ওবিসি স্টেটাস পেয়েছেন। অর্থাৎ সংরক্ষণের দাবিদার। কিন্তু সংরক্ষণের সুবিধে কারা পাচ্ছে? যাদের শিক্ষার অবকাশ আছে তারাই পাচ্ছে। এই যে মতুয়াদের কথা বলছ, তাদের নেতা পি আর ঠাকুর লন্ডন থেকে বার অ্যাট ল পাস করে এসেছিলেন। অর্থাৎ এলিট। আইডেন্টিটির লড়াইতে আমাদের নিজস্ব লাইনের কিছু প্রশ্ন তো আছেই। সেগুলো নিশ্চয়ই তুলতে দিতে হবে, কিন্তু এই একই পরিচিতির মধ্যে যখন এলিট আর পিছিয়ে পড়া শ্রেণি তৈরি হয়ে যাচ্ছে তখন তো নতুন করে স্বার্থের লড়াই শুরু হচ্ছে। তখন কিন্তু দলিত বা মুসলিম পরিচয় শ্রেণিস্বার্থের তলায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে এবং নমশূদ্র বা রাজবংশী উচ্চবিত্ত তাদের নিজেদের সমাজের বিত্তহীনকে শোষণ করে চলেছে। এখানেই তো শ্রেণির লড়াইকে পরিচিতির লড়াইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে বামপন্থীদের এগিয়ে আসার কথা ছিল। শুধু তাই নয়, মতুয়াদের লড়াইয়ের সঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলিমদের লড়াইকেও মেলাতে হবে। যারা আইডেন্টি পলিটিক্স ভাঙিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ফায়দা তুলে যাচ্ছে তারা তো এক্ষেত্রে এগিয়ে আসবে না। এই জায়গায় তো বামপন্থীদেরই দায়িত্ব নেবার কথা।
তুমি তো আবার মহিলা কবি এবং শিক্ষিকা। তার ওপর তুমি আবার জলপাইগুড়িতে থাকো। সাংস্কৃতিক ক্ষমতারকেন্দ্র থেকে অনেক দূরে। সারা দেশের ইংরিজি ভাষার পত্রপত্রিকায় (দ্য ওয়্যার, আউটলুক, ফ্রন্টলাইন ইত্যাদি) তোমার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আমি কিছু সাংবাদিক বন্ধুর থেকে শুনেছি, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকে যারা তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা নাকি প্রথমেই ধরে নেয় যে তুমি কলকাতার বাসিন্দা। তারপর যখন তুমি ওদের বলো যে কলকাতা থেকে অনেক দূরে জলপাইগুড়িতে থাকো, তখন চেন্নাই, হায়দরাবাদ বা মুম্বইয়ের মানুষ জায়গাটা ঠিক চিনতে পারে না। তখন তোমায় বলতে হয় যে তুমি দার্জিলিংয়ের পাশে থাকো বা নক্সালবাড়ির কাছে থাকো। এই যে পশ্চিমবঙ্গের কবি সাহিত্যিক মানেই তাকে কলকাতাবাসী হতে হবে – এই ধারণার জন্ম হয়েছে তো বাংলা সংস্কৃতির প্রবল কলকাতামুখী পক্ষপাত থেকেই। এই সব মিলিয়ে তোমার ধর্ম পরিচিতি ছাড়াও লিঙ্গ ও ভৌগোলিক অবস্থানও তোমায় বিশেষভাবে কোণঠাসা করেছে। এর জন্যে কী কী অসুবিধে হয়?
সাহিত্যের চর্চা কলকাতাকেন্দ্রিক এলিটরাই করবে, এটাই ছিল চালু ধারণা। এই যে শরৎকাল নিয়ে কলকাতার বাবু সাহিত্যিকদের আদিখ্যেতা, তারা কি কেউ কোনোদিন খোঁজ নিয়েছে, শরৎকালে গ্রামের চাষীদের কী করুণ অবস্থা হয়? বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের গ্রামে ভাদ্র মাসকে বলা হয় সবচেয়ে অভাবের মাস। এই সময়ে বাড়িতে আত্মীয় আসে না টানাটানির সময় বলে। এই সময়টায় দেখবে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। এখন ৪০-৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। এই সময়ে আমাদের আগের ফসলের থেকে আয় করে অথবা তুলে রাখা পাট বেচে চালাতে হয়। বাংলা সাহিত্য যে উচ্চবিত্ত ও উচ্চবর্ণের সাহিত্য সে তো বলাই বাহুল্য। আমি কৃষক পরিবারের মেয়ে, কলকাতার সাহিত্য জগৎ আমার অস্তিত্ব স্বীকার করবে না সহজে। তাছাড়া সমস্ত বড় প্রকাশনার দপ্তরই তো কলকাতায়। আমায় যদি প্রতিটা কবিতা বা প্রবন্ধ লিখে কলকাতার কাগজগুলোকে সমানে তদবির করতে হত তাহলে আমার লেখক পরিচিতি তৈরিই হত না। তুমিও আমায় চিনতে না। ডিজিটাল পত্রিকা হয়ে সুবিধে হয়েছে। আমরা যারা সবরকমভাবেই প্রান্তবাসী তাদের কণ্ঠস্বর সহজে পৌঁছে যাচ্ছে পাঠকদের কাছে। তবে যা বলছিলাম আর কি, শারদীয়া পুজো সংখ্যার হইচই তোমাদের, উচ্চবর্ণ উচ্চবিত্ত কলকাতার হিন্দু বাঙালিদের। আমাদের না।
এরপর আমার একটা ব্যক্তিগত খারাপ লাগা থেকে প্রশ্ন করছি। তুমি একজন বাঙালি কবি হয়ে বাংলায় তো প্রায় লেখোই না! বাংলা ভাষা নিয়ে তোমার কোনো জাতীয়তাবাদী আবেগ নেই? আজ যে বাংলা ভাষা-সাহিত্য-গান-সিনেমা এভাবে বিপন্ন, তা তো বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালিরই অবহেলার মানসিকতার জন্য। তুমি এত রাজনীতি সচেতন হয়ে অবলীলায় তোমার মেয়েকে মূলত ইংরিজি, হিন্দিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ করে তুলেছ। তুমি নিজেও বাংলায় কবিতা চর্চা করো না। ইংরিজি নিয়ে এত আদিখ্যেতা কেন তোমার?
(হাসি) প্রথম কথা হল তুমি বাঙালি বলতে কাদের কথা বলছ? আমার মাতৃভাষা যে বাংলা নয় সেটাই জানো না! আমার মাতৃভাষা রাজবংশী বা কামতাপুরী। যদিও আমাদের কমিউনিটিতে যারাই একটু অগ্রসর হতে পেরেছে তারাই নিজেদের মাতৃভাষাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করেছে। আমি একটু ভাল মানের মহকুমা স্কুলে পড়তাম। আমায় কিন্তু স্কুলে এবং বাড়িতে খুব যত্ন করে কলকাত্তাইয়া বাংলা শেখানো হয়েছে। আমার স্কুলে যে বন্ধু গোষ্ঠী ছিল তারা বেশিরভাগই ছিল কায়স্থ। স্কুলে কখনো যদি ভুল করেও কামতাপুরী ভাষায় কথা বলে ফেলতাম তখুনি আমার কায়স্থ বন্ধুরা ‘এ মা! ছি ছি’ করে ‘ওই ছোটলোকদের ভাষা’-য় কথা বলতে বারণ করত! বাড়িতেও বকাঝকা খেতাম কামতাপুরী ভাষায় কথা বললে। আমার মনে মনে খুব রাগ হত। তোমাদের কলকাতার ভদ্রলোকের ভাষা, যে ভাষায় আমি এখন তোমার সঙ্গে কথা বলছি, ছোট থেকে আমায় সেই ভাষায় কথা বলতে বাধ্য করা হত। তোমরা বলো ‘খেয়েছি’, আমার ভাষায় কিন্তু সেটা ‘খাইছি’। আমি যদি ‘খাইছি’ লিখে পাঠাই, সেটা কি তোমাদের আনন্দবাজার ছাপবে? ভুল সংশোধন করে তাকে ‘খেয়েছি’ করে দেবে। কেন? আনন্দবাজার কি শুধু কলকাতার লোকে পড়ে? গোটা পশ্চিমবঙ্গের লোক পড়ে। তোমাদের আনন্দবাজারের বাংলা ভাষা তো আমার মাতৃভাষা নয়, দেবারতিদি। এনআরসি-সিএএ মুভমেন্টের সময় থেকে আমার লেখালিখি শুরু। জাতীয় স্তরে নিজের লেখা পৌঁছে দিতে হলে তো আবার তোমাদের ভদ্র বাংলাতে লিখলেও হবে না। তাই আমি ইংরিজিকেই নিজের মাধ্যম করে নিয়েছি। তুমি যদি বলো হিন্দি তোমার উপর আগ্রাসন চালাচ্ছে, তাহলে তো আমিও বলতে পারি তোমাদের কলকাতার বাংলা আমার উপর সেই কবে থেকে আগ্রাসন চালিয়েছে। একটা কথা মুখের ওপর বলছি। ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে-তে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম, তার একটি লাইন ছিল, ‘ডিউরিং অর্গাজম আই মোন ইন কামতাপুরি’। এবার বুঝে নাও।
দলিত সাহিত্য আকাদেমি কতটা সুবিধে দেবে দলিত লেখালিখিকে?
দেখো, উত্তরবঙ্গে এর তেমন প্রভাব এখনো চোখে পড়েনি। আর সবথেকে বড় কথা হল আমার দলিত আইডেন্টিটি নিয়ে বেজায় গণ্ডগোলের মুখে আমায় পড়তে হয়। আমি যদি হিন্দু রাজবংশী হতাম তাহলে তফসিলি জাতিভুক্ত হতাম। কিন্তু ভারতে যেসব দলিত ধর্ম পরিবর্তন করেছে, তারা শিডিউলড কাস্ট স্টেটাস পায় না। রাজিন্দর সাচার কমিটির রিপোর্টের পর বেশ কিছু মুসলিমকে ওবিসি স্টেটাস দেওয়া হয়। তোমায় তো আগেই বললাম যে তবলিগীদের প্রভাবে নস্যশেখ মুসলিমরা সাচ্চা মুসলিমদের চাঁদোয়ার নীচে আসার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এই উদ্যোগের অন্যতম কাজ হল আমাদের দলিত পরিচয় সামনে আসতে না দেওয়া। যেহেতু নবীর ধর্মে কেউ দলিত নয়। কিন্তু নস্যশেখরা ভুলেই গেছে যে এই শতকের একদম শুরুর দিকে দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আমরা ওবিসি স্টেটাস পেয়েছিলাম। তবলিগীদের ছাঁচে ঢালতে গিয়ে নস্যশেখদের রাজনৈতিক চেতনা পুরোপুরি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে কারো নজর নেই। এখন নস্যশেখদের মধ্যে ৯০ শতাংশই তবলিগী জমাত। আমি এখন যদি নিজের দলিত পরিচয়কে এগিয়ে নিয়ে আসতে যাই, তাহলে আমার কমিউনিটির মধ্যেই আমায় প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে। কাজেই দলিত সাহিত্যিক হিসাবে আমি বা আমার মত মানুষেরা খুব বেশি সুবিধে পাবে না।
তুমি এক অদ্ভুত পরিচিতির মানুষ। একদিকে দলিত আরেকদিকে মুসলমান। তোমার কি মনে হয় দলিত–মুসলিম ঐক্য যদি ঘটে, তা এই ধর্ম ও জাতির ভিত্তিতে বিভক্ত ভারতের সমাজ ও রাজনীতিকে পাল্টে দিতে পারবে?
আগের প্রশ্নের উত্তরের রেশ নিয়েই বলছি, মুসলিমরা নিজেদের মধ্যে জাত বৈষম্যকে স্বীকার করে না। তাই পরিচিতির রাজনীতিকে সামনে আসতে দেয় না। আবার তাদের মধ্যে বর্ণসচেতনতাও প্রখর। আমি নস্যশেখ, আমার প্রাক্তন স্বামী জোলা আর আমার শাশুড়ি মা ছিলেন ধুনিয়া কমিউনিটির। সব কিন্তু দলিত মুসলিম। আমার শ্বশুরবাড়ি ছিল মালদা। সেখানে তো মুসলিমদের মধ্যে ভীষণ জাত বৈষম্য। ওখানে জোলা, ধুনিয়াদের মসজিদও আলাদা। পাঠান, সৈয়দরা এই ছোট জাতের মসজিদে কোনোদিন যাবে না। পাঠান, সৈয়দরা ধুনিয়া বা জোলা শব্দগুলোকে গালাগাল হিসাবে ব্যবহার করে। কাজেই এর উল্টোদিকে দলিতদের মধ্যেও ইসলামবিরোধিতা আছে। আর বিজেপি তো স্বাভাবিকভাবেই এই বিরোধকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে। আমাদের নিপুচাপুর চা এস্টেটের পাশেই কিন্তু আদিবাসী গ্রাম। আমাদের গ্রামের মুসলিমরা আজ অব্দি কোনোদিন প্রতিবেশী আদিবাসীদের গ্রামে ঢুকে তাদের সঙ্গে সহজভাবে মেলামেশার চেষ্টা করেনি। চৌত্রিশ বছরের বামফ্রন্ট সরকার এইটুকু সামাজিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে উঠতে পারেনি। সেইজন্যেই আজকে যখন চা বাগান এলাকায় হু হু করে আরএসএস শাখা হচ্ছে, তখন সহজেই এই হিন্দুত্ববাদীরা আদিবাসীদের নিজেদের ছাতার তলায় নিয়ে আসতে পারছে। দ্য প্রিন্ট ২০২০ সালে একটা রিপোর্ট বের করেছিল, সেখানে দেখা গেছে পশ্চিমবঙ্গে মোট ১৬০০ আরএসএস শাখা কর্মরত। এটা সম্ভব হয়েছে আদিবাসীদের মনে মুসলিমদের প্রতি রাগের কারণেই। এখানে একটা কথা বললে অন্যরকম শোনাবে, কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি – মুসলিমরা যে সব জায়গাতেই নিপীড়িত তা নয়। বেশকিছু জায়গায় তারাও নিপীড়ন করে। তাই বিষয়টা যদি সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু হিসাবে দেখা হয়, তাহলে মনে হয় দেখার লেন্সটা কিছুটা স্বচ্ছ হবে। আমার নিজের পর্যবেক্ষণ থেকে বলছি, কিছু কিছু জায়গায় কোনো দোকানে গেলে বিশেষ কোনো জিনিসের জন্যে দোকানি মুসলিমদের থেকে যে টাকা চায় আদিবাসীদের থেকে তার চেয়ে বেশি টাকা চায়। মুসলমানদের মধ্যে ভাল সংখ্যক মধ্যবিত্ত আছে, কিন্তু আদিবাসীদের মধ্যে তুমি কোনো মধ্যবিত্ত খুঁজে পাবে না। আমাদের এলাকায় চা বাগানে যেসব আদিবাসী শ্রমিকরা রয়েছে তারা দিনে ১০০-১৫০ টাকায় কাজ করে। সারা দেশেই কিন্তু এই চেহারা। এরা আর মধ্যবিত্ত হয়ে উঠবে কী করে? ফলে সহজেই বিজেপি তাদের হিন্দুত্ববাদী বয়ানে টেনে আনতে পারে। এখানেই বামপন্থীদের চূড়ান্ত ব্যর্থতা।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।