ঝাড়খণ্ডের দৃষ্টিহীন শিশু কন্যাটিকে বাবা-মা অনেক আশা নিয়ে ভর্তি করেছিলেন গুরগাঁওয়ের একটি বিশেষ বিদ্যালয়ে। এক মাসের মধ্যেই শিশুটি সেই হোস্টেলে থাকাকালীন মারা যায়। মৃত্যুর সময় যে হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তারা জানিয়েছে তার শরীরের নানা জায়গায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। হোস্টেল সুপার অবশ্য বলেন মেয়েটি অসুস্থ ছিল, বারবার বাথরুমে যাচ্ছিল এবং বাথরুমে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছে। সমাজকর্মীরা যে এনজিও এই আবাসিক স্পেশাল স্কুলটি চালায় তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করছেন। কেউ কেউ বলছেন ওই স্কুলে আগেও নানা ধরনের ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু উঁচু মহলে যোগাযোগ থাকার জন্য এরা সবসময় পার পেয়ে যায়। এই এনজিও অবশ্যই নিজেদের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে পারে না এবং এদের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া জরুরি। তবে এই ঘটনা আমাদের আরও অনেক বড় প্রশ্নের সম্মুখীন করে।
প্রথমেই যে প্রশ্ন মাথায় আসে, তা হল এই সাত বছরের শিশুটিকে কেন তার বাবা-মা, পরিবারের আর সবাইকে ছেড়ে অত দূরে অন্য একটি রাজ্যের আবাসিক স্কুলে ভর্তি হতে হল। আমাদের দেশের শিক্ষার অধিকার আইন কি একেবারেই অন্য কথা বলে না? ওই আইন অনুযায়ী বাড়ির কাছাকাছি সরকারি স্কুলে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পড়ার অধিকার সব শিশুর আছে। এই ‘সব’ শিশুর মধ্যে কিন্তু প্রতিবন্ধী শিশুরাও পড়ে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
বাড়ির কাছাকাছি বিদ্যালয় বা “neighborhood school” এর কথা কিন্তু আমরা বহু বছর আগের কোঠারি কমিশনের সময় থেকেই শুনে আসছি। একটি শিশু তার পরিবারের সঙ্গে বড় হবে এবং স্কুলে যেতে আসতে তার অনেকখানি সময় নষ্ট হবে না — এই দুটি শর্তকে প্রাথমিক শিক্ষার অধিকার নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা সকলেই স্বীকৃতি দেন। প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মীরা বিশ্বজুড়েই প্রতিবন্ধী শিশু বা বয়স্কদের তাঁদের পরিবারের সঙ্গে থাকার অধিকার নিয়ে আন্দোলন করছেন। পরিবারের থেকে দূরে বড় হওয়ার কারণে অনেকসময় প্রতিবন্ধী মানুষ পরবর্তীকালে পরিবার বা আশপাশের সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। বিশ্বের প্রতিবন্ধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার, তা হল প্রতিবন্ধীদের কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠানে নয়, সমাজে সবার সঙ্গে একসাথে থাকার অধিকার দেওয়া।
ঝাড়খণ্ডের শিশুটির বাবা-মার পক্ষে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের কথা জানা হয়ত অসম্ভব। খবরে প্রকাশ, দৃষ্টিহীনরা পড়াশোনা করতে পারে এরকম স্কুলের খোঁজ করতে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন গুরগাঁওয়ের ওই স্পেশাল স্কুলটির কথা। তাঁদের নিজের রাজ্যে কি দৃষ্টিহীন শিশুদের জন্য স্কুল ছিল না? ছিল, কিন্তু তাঁদের কাছে সে খবর পৌঁছে দেবে কে? দেওঘরে একটি ছোট মুদিখানা চালান যে মানুষটি, তিনি যদি আত্মীয়ের মুখে শোনেন, একটি দৃষ্টিহীনদের স্কুল একটু দূরে অন্য শহরে আছে। তাহলে তাঁর মনে হতেই পারে, আমার সন্তানকে সেখানেই ভর্তি করব।
আসলে আমাদের দেশের সরকারগুলো প্রতিবন্ধকতাযুক্ত শিক্ষার্থীদের বাবা-মাকে সঠিক দিশা দেখাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ফলত এই অভিভাবকরা আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। শহরাঞ্চলে একটু অবস্থাপন্ন পরিবারের অভিভাবকরা নিজেরাই চেষ্টা করেন স্পেশাল স্কুল চালু করতে। এ দেশের স্পেশাল স্কুলের ইতিহাস খোঁজ করলে দেখা যাবে, সেগুলো হয় প্রতিবন্ধীদের বাবা-মায়েরাই চালু করেছেন, নয়ত কোনো মিশনারি বা কোনো এনজিও। মোটের উপর প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের পড়াশোনার দায়িত্বটা সরকার একেবারেই নেয় না।
সবচেয়ে কষ্টের কথা, এনজিও পরিচালিত স্পেশাল স্কুলগুলো স্কুল শিক্ষা দপ্তরের অধীনে পড়ে না, সমাজকল্যাণ দপ্তরের অধীনে কাজ করে। অর্থাৎ প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাকে আমরা এখনও কল্যাণমূলক কাজ হিসাবে দেখি, বৃহত্তর শিক্ষাক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করি না। আমাদের রাষ্ট্রের এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে দেয় প্রতিবন্ধী শিশুরা ঠিক কতটা অবহেলিত, বঞ্চিত। ঝাড়খণ্ডের সাত বছরের ওই শিশুকন্যা যে স্কুলের হোস্টেলে মারা গেল তার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়ত হবে, কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা সন্দেহ থেকেই যায়। কিন্তু সেই তদন্তে বৃহত্তর সমস্যার সমাধান হবে, এমনটা আশা করা যাচ্ছে না।
আরো পড়ুন স্কুল খুলছে, কিন্তু প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের কী হবে?
প্রশ্ন উঠতেই পারে, এনজিও পরিচালিত সব স্পেশাল স্কুলই কি খারাপ? বা দৃষ্টিহীনদের জন্য যে আবাসিক স্পেশাল স্কুলগুলো আছে তার সবকটাতেই কি ছাত্রদের উপর অত্যাচার করা হয়? তা তো নয়। তবে এনজিও পরিচালিত স্কুলগুলোতে শিশুদের মারধর, এমনকি যৌন নির্যাতন করার খবরও মাঝেমাঝেই পাওয়া যায়। এই স্কুলগুলো শিক্ষা মন্ত্রকের অধীন না হওয়ায় অনেকসময় পার পেয়ে যায়। শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী এই স্কুলগুলোতেও যে কর্পোরাল পানিশমেন্ট বন্ধ করা উচিত, তা নিয়ে আলোচনা একেবারেই হয় না। উল্টে এরা সেবামূলক কাজ করার জন্য বিশেষ স্বীকৃতি পায়। এনজিও শিক্ষার মত এক মৌলিক অধিকারকে সেবামূলক কাজে পরিণত করলে লাভ সরকারের, কারণ সেক্ষেত্রে সরকারকে এই শিশুদের দায়িত্ব নিতে হয় না।
এই ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক শিশুরা। অন্য শিশুদের সঙ্গে সমানভাবে সমাজে অংশগ্রহণ করতে না পেরে তারা ক্রমশ আরও পিছিয়ে পড়ছে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।