অনুভব মন্ডল
আমি ব্যারাকপুরের বাসিন্দা এবং বর্তমানে কলকাতার আর জি কর মেডিকাল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। গত ৯ জানুয়ারি (সোমবার) থেকে আমাদের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষা চলাকালীনই, গত ১৪ জানুয়ারি (শনিবার) রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে আমার ঘরে ফিরে দেখি তৃণমূল কংগ্রেস ছাত্র পরিষদের সদস্য ও সমর্থক ইন্টার্নরা ঘর থেকে আমার ট্রাঙ্ক, বেড সহ সমস্ত আসবাবপত্র বাইরে ফেলে দিয়েছে। তারা আমাকে হোস্টেল থেকে বেরিয়ে যেতে বলে এবং তাদের মর্জিমত না চললে, “ভবিষ্যতে মেরে ডাক্তার হওয়া ঘুচিয়ে দেব” বলে হুমকি দেয়। অনেককে এই ঘটনা হতভম্ব করে দিলেও আমাদের মত যেসব ছাত্রছাত্রী তৃণমূল কংগ্রেসের রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা না করে ছাত্রছাত্রীদের অধিকারের লড়াই লড়ে চলেছে, তাদের কাছে এটা খুব স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত ঘটনা। যেমন গত ১৩ ডিসেম্বর ২০২২ আমি কলকাতা মেডিকাল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে মেডিকাল কলেজে যাওয়ার পর থেকেই তৃণমূল কংগ্রেস ছাত্র পরিষদের সদস্যরা আমার উপর চড়াও হওয়া শুরু করে এবং হোস্টেল থেকে বার করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চলেছে। শুধু তাই নয়, আমি তফসিলি জাতির অন্তর্গত হওয়ায় আমাকে জাত তুলেও নানা কথা বলা হয়েছে।
এ অবশ্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারে আসার পর থেকেই ক্যাম্পাস গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করেছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন থেকে শুরু করে কলেজ কর্তৃপক্ষ – সমস্ত জায়গায় অনৈতিকভাবে তৃণমূল কংগ্রেস এর প্রিয়পাত্রদের বসিয়ে কার্যত পার্টি অফিস থেকে কলেজ চালাচ্ছে তারা। উপরন্তু যে কোনো ছাত্র আন্দোলনকে গুন্ডাবাহিনী পাঠিয়ে দমন করার এক ঘৃণ্য নীতি অবলম্বন করেছে। ২০১৮ সালে কলেজের পরিকাঠামো উন্নয়নের দাবিতে মেডিকাল কলেজের ছাত্র আন্দোলন হোক বা বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হোক; গনি খান চৌধুরী পলিটেকনিক কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রেসিডেন্সি কলেজ – সব ক্ষেত্রেই একই ধরনে গুন্ডাগিরি এবং ছাত্রছাত্রীদের উপর শারীরিক আক্রমণ দেখেছি।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এমনকি ২০২১ সালে আর জি কর মেডিকাল কলেজেই আমরা স্বচ্ছ হাউজস্টাফশিপ কাউন্সেলিং, হোস্টেল পরিকাঠামো উন্নয়ন কমিটিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নির্বাচন হোস্টেলের ছাত্রছাত্রীদের সাথে আলোচনা করে করতে হবে – এরকম বিভিন্ন ন্যায্য দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলি। আমাদের আন্দোলন ভাঙতে এক স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতার ‘ডান হাত’-কে পাঠানো হয় আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রছাত্রীদের মারধোর করতে। আমরা ওই দলবলের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলি এবং তৃণমূলের দালালে পরিণত হওয়া অধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি করি। এরপরই আমাদের সিনিয়র এবং ডাক্তার ছাত্রদের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী চন্দ্রমৌলি ঝা ও মৈনাক রায়ের রেজিস্ট্রেশন আটকে দেওয়া হয়। এছাড়াও আমাদের অনেককে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়া হয়, ভয় দেখানো হয় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে এ জন্মে আর ডাক্তার হতে হবে না। স্পষ্টতই হবু ডাক্তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি, তাদের দাবিদাওয়ার লড়াই, অধিকারের লড়াইকে অঙ্কুরে বিনাশ করতেই এসব করা হচ্ছে।
কিন্তু ক্যাম্পাস গণতন্ত্রকে কেন এত ভয় পায় শাসক দলগুলো? তৃণমূল কংগ্রেস তো বটেই, ক্যাম্পাস গণতন্ত্রের টুঁটি টিপে হত্যায় সিদ্ধহস্ত কর্পোরেটদের দালালে পরিণত হওয়া সব রাজনৈতিক দলই। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাও এবং অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে উন্নয়নের নামে শুরু হয় দেশ বিক্রির কারসাজি, যা উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ, বিশ্বায়ন নামে পরিচিত। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলো একের পর এক সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা ও তাদের দালালদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাঙ্কের নির্দেশে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ভুয়ো মুখোশ ছিঁড়ে শুরু হয় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সমস্ত ক্ষেত্রেই দেশি বিদেশি বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশ। শিক্ষা আর জনগণের মৌলিক অধিকার রইল না, হয়ে গেল পণ্য। বর্তমানে নরেন্দ্র মোদী, মমতা ব্যানার্জি, পিনারাই বিজয়ন সমেত সব সরকারই শিক্ষাক্ষেত্রে বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশের জায়গা করে দিচ্ছে। কেউ প্রকাশ্যে কেউ পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলের মোড়কে। পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে স্কুল কলেজের মাইনে এবং শিক্ষাখাতে বিনিয়োগের ব্যবসা ও মুনাফা।
আরো পড়ুন ক্যালকাটা মেডিকাল কলেজের শিক্ষার্থীরা কেন অনশনে?
একদিকে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারিকরণ চলছে, অন্যদিকে চলছে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ কর্তৃপক্ষের বেলাগাম তহবিল তছরুপের ঘটনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য নির্ধারিত আয়করদাতাদের টাকা যাচ্ছে নেতা, মন্ত্রীদের ফ্ল্যাটবাড়ি, গাড়ি, জমিজমা, রিসর্টের উন্নয়নে। ছাত্রছাত্রী তো বটেই, সাধারণ মানুষেরও এসব অজানা নয়। পাছে ছাত্রছাত্রীরা সংগঠিত হয়, এই লুঠতরাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই পাছে জনগণের বৃহত্তর লড়াইয়ের সঙ্গে মিশে যায় – এই ভয়েই বিভিন্ন সংসদীয় রাজনৈতিক দল ক্যাম্পাসে যে কোনো বিরোধ স্বরকে দমন করে।
আজ তৃণমূল কংগ্রেস ছাত্র পরিষদ দ্বারা আমার উপর আক্রমণ কেবল আমাকে পরীক্ষার আগে শারীরিকভাবে হেনস্থা করার জন্য নয়, বরং সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে সন্ত্রস্ত করে তোলার জন্য, যাতে তারা শাসকের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পায়, সংগঠিত হতে ভয় পায়।
লেখক আর জি কর মেডিকাল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র এবং ছাত্র আন্দোলনের কর্মী। মতামত ব্যক্তিগত, তথ্য লেখকের
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।