“প্রগতির সাধনায় যারা নিজেদের উৎসর্গ করেছি তাদের সমস্ত পুরনো বিশ্বাস, সমস্ত পুরনো ধারণাকে সমালোচনা করতে হবে, সন্দেহের চোখে দেখতে হবে এবং চ্যালেঞ্জ করতে হবে।”
কারাগারে বসে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ২৩ বছরের বিপ্লবী লিখছেন এই কথা। যিনি প্রগতির সাধক, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করাই যাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। ভগৎ সিং ও তাঁর সঙ্গীরা চেয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক ভারত। ভগৎকে নিয়ে আলোচনা কম হয় না। কিন্তু তাঁর মতাদর্শ নিয়ে চর্চা হয় খুব কম। বিপ্লবী সমাজবাদী ভগৎ সিং এবং তাঁর কমরেডদের স্মরণ করতে হলে সেই চর্চা অত্যন্ত জরুরি।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ভগৎ বিপ্লবী কার্যকলাপ চালাতে উত্তরপ্রদেশে যান মাত্র ১৭ বছর বয়সে। লাহোরে জয়চন্দ্র বিদ্যালঙ্কারের মাধ্যমে বিপ্লবী শচীন সান্যালের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। শচীন সান্যাল হিন্দুস্থান রিপাব্লিকান অ্যাসোসিয়েশনের (এইচআরএ) কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে তাঁকে কানপুরে পাঠান। অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীরা উত্তর ভারতে এইচআরএ নামে তার আগে থেকেই কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। কানপুরে ভগৎ সিং বিপ্লবী যোগেশ চ্যাটার্জীর নেতৃত্বে কাজ শুরু করেন। এইচআরএ প্রথম থেকেই সমাজবাদী মতাদর্শে বিপ্লবী কার্যকলাপ চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। ১৯২৪ সালে কানপুরের প্রাদেশিক সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়, পার্টির লক্ষ্য ভারতে একটি প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। যে স্বাধীন ভারতের সরকার মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ সম্পূর্ণ বন্ধ করবে। সম্মেলনে কমিউনিস্ট আদর্শ ও নীতি প্রচারের কথা বলা হয়। বলা যেতে পারে এইচআরএ-র সংগঠক হিসাবে ভগৎ সেই সমাজবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। শচীন, যোগেশ, সুশীল ভট্টাচার্য প্রমুখের পাশাপাশি রামপ্রসাদ বিসমিল, আশফাকউল্লা খান, বটুকেশ্বর দত্ত, চন্দ্রশেখর আজাদ, যতীন দাসরা ছিলেন ভগতের কমরেড।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯২৫ সালের কাকোরী রেল ডাকাতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলার সূত্র ধরেও পুলিশ ভগৎকে খুঁজছিল। কারণ পুলিশ লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা, দিল্লি ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত বিপ্লবীদের সঙ্গে এই মামলার যোগসূত্র খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কানপুরে যোগেশ ভগতের ছদ্মনাম দেন বলবন্ত সিং। তাই পুলিশ এই মামলায় তাঁকে খুঁজে পায়নি। দলের আর্থিক তহবিলের জন্য সেইসময় বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক ডাকাতি করা হয়েছিল। ভগৎ সেই কাজে যুক্ত ছিলেন। তারপর আলিগড়ে জাতীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার জন্য তাঁকে পাঠানো হয়। এতে যেমন দলের আর্থিক সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হয়েছিল, তেমন তাঁর নেতৃত্বে আলিগড়েও দলের সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
সমাজবাদী মতাদর্শের সঙ্গে দলের সম্পর্ক আরও স্পষ্ট করতেই সোশালিস্ট শব্দটি জুড়ে নাম দেওয়া হয় এইচএসআরএ। দলের নামের এই রূপান্তরে আজাদ, ভগৎ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৩১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আজাদ শহিদ হন, তার কিছুদিন পরেই ২৩ মার্চ ভগতের ফাঁসি হয়। তার আগে ১৯২৭ সালে রামপ্রসাদ বিসমিল, আশফাকউল্লা, রাজেন লাহিড়ী কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলার রায়ে শহিদ হন। ১৯২৯ সালে যতীন দাস জেলে অনশন করে শহিদের মৃত্যু বরণ করেন। এইচএসআরএ এবং অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীদের এই জীবনদান স্মরণ না করে বিচ্ছিন্নভাবে ভগৎ চর্চা করা যায় না।
লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালে তিনি ও তাঁর কমরেডরা আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন না বলে জানিয়ে দেন। সেই সংক্রান্ত বিবৃতিতে তাঁরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন “আমরা পরিবর্তন চাই। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্ত ক্ষেত্রে বর্তমানে যে ব্যবস্থা চলছে তাকে আমূল বদলে ফেলে এমন এক নবীন সমাজ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই যেখানে মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণের সম্ভাবনা থাকবে না এবং সর্বক্ষেত্রে মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যাবে। আমরা মনে করি, গোটা সমাজব্যবস্থাকে বদলে ফেলে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যদি না যায় তবে মানবসভ্যতার পরিণতি বড় ভয়ানক।”
মনীষী স্মরণে তাঁকে দেশ-কাল-সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে চর্চা করার একটা ঝোঁক রয়েছে। সে চর্চা একজন মানুষকে দেবতা বানিয়ে দেয়। মতাদর্শের চর্চার স্থান দখল করে ব্যক্তিপুজো। ভগৎ সিং এর বিরোধী ছিলেন। অথচ তাঁর চর্চাতেও এই অবৈজ্ঞানিক, ভাববাদী ঝোঁক রয়েছে। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তাঁর বিপ্লবী সমাজবাদী মতাদর্শে উত্তরণ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সেই ধারার অবদান নিয়ে আলোচনার বদলে ভগৎ হয়ে যান একজন অতিমানব। বিপদ আসে সেই অবৈজ্ঞানিক চর্চার পথেই।
আরো পড়ুন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর: এক রোম্যান্টিক বিপ্লবী
হিন্দুত্ববাদীরা তাই আজ ভগতের ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করার দুঃসাহস দেখাতে পারে। স্বাধীনতা আন্দোলনে যারা বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকা পালন করেছিল, রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদকে হাতিয়ার করে স্বাধীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করতে চেয়েছিল, তারাও আজ ভগৎকে নিয়ে মাতামাতি করছে, তাঁর উপর দেবত্ব আরোপ করতে চাইছে। জেলখানায় বসে বস্তুবাদী দৃষ্টিতে নাস্তিকতার পক্ষে কলম ধরা বিপ্লবী আজ মৌলবাদীদের কাছে দেবতা! ভগৎ সিংদের ক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় অপমান আর কী হতে পারে? ভারতের বিপ্লবী আন্দোলন, তার সঙ্গে বিপ্লবী সমাজবাদী ধারার যোগসূত্র চর্চার মধ্য দিয়েই মৌলবাদীদের এই অপকর্ম ব্যর্থ করতে হবে। সেটাই হবে ভগৎ সিংয়ের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।