বাংলা নববর্ষ আসছে এটা ছোটবেলায় বুঝতে পারতাম চৈত্র সেল আর হালখাতার জন্য মায়ের প্রস্তুতি দেখে। চৈত্র সেলের সঙ্গে গ্রামে বড় হওয়া আমার মায়ের পরিচয় কলকাতার দক্ষিণে এই মফস্বলে এসে। দেশ-গাঁয়ে তখনো ও জিনিস অতটা চালু হয়নি। তবে হালখাতার সঙ্গে তাঁর পরিচয় জন্মাবধি। হালখাতা মানে তখনকার গ্রামবাংলার আপাত শান্ত জীবনে এক হইহই কান্ড, রইরই ব্যাপার। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হতে না হতেই ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে, সাইকেলে চেপে পৌঁছে যাওয়া হাটে। সেখানে আশেপাশের আরও পাঁচটা গ্রামের লোক ভেঙে পড়েছে ততক্ষণে। বিভিন্ন দোকানে ঢুঁ। ভিড় ঠেলে জায়গা করে নিতে পারলেই এক হাতে শরবত, অন্য হাতে মিষ্টি। তারপর অনেক মিষ্টির প্যাকেট আর সরু করে রোল করা ক্যালেন্ডারের গোছা নিয়ে বাড়ি ফেরা রাত করে।

এখন নববর্ষ আসছে এটা বুঝতে পারি তার কয়েকদিন আগে থেকে সোশাল মিডিয়ায় শশাঙ্ক বনাম আকবর শুরু হয়ে গেছে দেখে। এবার আরও বোঝা গেল, আমাদের প্রতিবেশী দেশ, আমাদের ভাষারই মানুষের দেশ বাংলাদেশ থেকে একটি খবর পেয়ে। গত রবিবার, অর্থাৎ ৯ এপ্রিল, সে দেশের সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী আইনি নোটিস দিয়ে বলেন, ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ নববর্ষ উদযাপনের অঙ্গ হিসাবে যে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে থাকে তাতে সংখ্যাগুরু মুসলমানের ভাবাবেগ আহত হয়। তাই ওটা বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। অথচ এই দৃষ্টিনন্দন শোভাযাত্রা বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের কৃষ্টির প্রতিনিধি, ধর্ম ও জাতের ঊর্ধ্বে উঠে বাংলাদেশের মানুষের ‘বাঙালি’ সত্তার প্রতিনিধি। ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর বহুদেশীয় কমিটি এই অনুষ্ঠানকে সেই স্বীকৃতিও দিয়েছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এখানে বলে রাখা ভাল, নোটিসে মূল আপত্তি তোলা হয়েছে এই শোভাযাত্রায় যে বিশাল বিশাল আকৃতির বাঘ, মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর মূর্তি ব্যবহৃত হয় তা নিয়ে। কিন্তু এর পরপরই ফেসবুকে ওই আইনজীবীর সমর্থনে যাঁরা বক্তব্য রাখছিলেন তাঁরা অন্য একটি আপত্তির কথা তোলেন। তাঁরা বলেন ‘মঙ্গল’ শব্দটিতেই তাঁদের আপত্তি, কারণ তাতে অন্য ধর্মের অনুষঙ্গ আছে। তাঁরা মনে করিয়ে দেন, প্রথম যখন এই শোভাযাত্রা শুরু হয়, তখন নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা।

আরো পড়ুন বঙ্গাব্দ, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?

মজার ব্যাপার, সমাজের যে অংশ থেকে আপত্তিটা উঠছে, এঁরা ‘আনন্দ’ যুগেও শোভাযাত্রার বিরোধীই ছিলেন। এমন মানসিকতার মানুষ সীমান্তের দুপারেই বরাবর ছিলেন। আছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে থাকবেনও। এপারে যখন হিন্দুত্ববাদী চিত্রকর ‘পানি’ বলা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করছেন, ওপারেও আপত্তি উঠছে ফুলের নাম কৃষ্ণচূড়া কেন? গুলমোহর বলা হোক। এপারেও, আমার ছোটবেলাতেও, মনে আছে, বাবা-মা অনেক অযাচিত খোঁচা ও উপদেশ সহ্য করেছেন। কারণ অনেকের বক্তব্য ছিল তাঁদের ছেলের কথাবার্তা, চালচলন হিন্দুদের মতো হয়ে যাচ্ছে। ‘গোসল’ না বলে চান করবে বলছে! ‘জল’ চাইছে! গ্রামবাংলার হালখাতার যে অভিজ্ঞতার কথা শুরুতেই বললাম, সেটারও যে হিন্দু-মুসলমান হতে পারে আমার মা তা অবশ্য টের পান এই ‘কসমোপলিটান’ কলকাতায় এসে। যে কাপড়ের দোকান থেকে মা কেনাকাটা করতেন, সেখানে হালখাতার প্রসঙ্গ তুলতে দোকানি রেগে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, আমার মা কি জানেন না যে মুসলমানদের হালখাতা করতে নেই?

এখন অবশ্য গ্রামও আর সেই গ্রাম নেই। তামাম দুনিয়া থেকে ‘খবর’ ঢুকছে হোয়াটস্যাপে হোয়াটস্যাপে। অন্য রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে পাঁচমিশালি অভিজ্ঞতা নিয়ে গ্রামে ফিরছে মানুষ, বদলাচ্ছে গ্রাম। হিজাব-বোরখার চল বাড়ছে, বাচ্চাদের মাদ্রাসা-মিশনে দেওয়ার হিড়িক বাড়ছে। আর বাড়ছে নিজে থেকেই আরোপিত নিত্যনতুন বিধিনিষেধ। বাইরে থেকে আক্রমণ যত বাড়ছে, ততই শামুকের মত নিজেকে আরও গুটিয়ে নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমান সমাজ।

 

ফুড ভ্লগারদের কৃপাধন্য রগরগে হালিম আর নেহারির বাইরে আছে তার ভেজানো ছোলা, তাজা ফল আর বড়জোর চপ-পেঁয়াজির আটপৌরে ইফতার। কিন্তু মুসলমানের ‘অ্যালাই’ আর তথাকথিত তোষণকারীরা কলকাতার অবাঙালি মুসলমানের চশমা খুললে তবে তো দেখতে পাবেন।

 

সেজন্য তাদের সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় কি? দেখুন, এই মুহূর্তে সত্যি বলতে এই রাজ্যের বাঙালি মুসলমানের না আছে বন্ধু (ally অর্থে), না আছে নেতৃত্ব। কলকাতার যে উদারপন্থী সমাজ নিজেকে মুসলমানের ‘অ্যালাই’ বলে ভাবে (বা অন্তত দাবি করে), তারা মুসলমানের আন্দোলন বলতে পার্ক সার্কাস বোঝে; মুসলমানের রান্নাবান্না বলতে বোঝে জাকারিয়া স্ট্রিট। মুখ্যমন্ত্রী রেড রোডে ঈদের জামাতে উর্দু-হিন্দি মিশিয়ে চারটে কথা বলেন এবং তারপরই তোষণ বনাম “বেশ করেছে” চালু হয়ে যায়। কিন্তু এই প্রশ্নটা কেউ তোলে না, যে কলকাতার রেড রোডে যাঁরা নামাজ পড়েন তাঁদের ভাষাগত পরিচয় কী? পশ্চিমবঙ্গের কত শতাংশ মুসলমান মুখ্যমন্ত্রী উর্দু-হিন্দিতে যা বলেন তা তর্জমা ছাড়া বুঝতে পারে? জেলার বাঙালি মুসলমানকে ছোঁয়ার কোনো প্রয়াসই নেই। তার যে স্বতন্ত্র কৃষ্টি আছে, রান্নাবান্না আছে, আছে স্বতন্ত্র সমস্যাও – সেই স্বীকৃতি কোথায়? ফুড ভ্লগারদের কৃপাধন্য রগরগে হালিম আর নেহারির বাইরে আছে তার ভেজানো ছোলা, তাজা ফল আর বড়জোর চপ-পেঁয়াজির আটপৌরে ইফতার। কিন্তু মুসলমানের ‘অ্যালাই’ আর তথাকথিত তোষণকারীরা কলকাতার অবাঙালি মুসলমানের চশমা খুললে তবে তো দেখতে পাবেন।

নেতৃত্বের অভাবের কথা বলছিলাম। বাঙালি মুসলমান নিজেদের প্রতিনিধি ভাবতে পারবে এরকম নেতা পশ্চিমবঙ্গে কে আছেন? দক্ষিণপন্থী শক্তি রাজনীতিতে সার্বিকভাবে মুসলমান অংশীদারিত্ব কমাতে চায়। আর আধা-মধ্যপন্থী, এট্টু-বাম-এট্টু ডান দলগুলো টোকেন হিসাবে যাদের তুলে আনছে সেই কলকাতাকেন্দ্রিক, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবাঙালি মুখগুলোকে রাজ্যের অধিকাংশ মুসলমান নিজের লোক মনে করতে পারছে না। শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বই নয়, জেলা থেকে কোনো দরকারে কলকাতায় এলে হজ কমিটি বা ওয়াকফ বোর্ড বা মাইনরিটি বোর্ডের যে কর্তাদের সামনে জোড়হাত হতে হয় সেই দণ্ডমুন্ডের কর্তারাও তাঁদের প্রতিনিধি নন। তাঁরা এই জেলার মানুষগুলোর ভাষাও বোঝেন না, সমস্যাও বোঝেন না। তাহলে কী দাঁড়াল? পশ্চিমবঙ্গনিবাসী বাঙালি মুসলমান নিজের রাজ্যে, একটা বাংলাভাষী রাজ্যে, বাঙালি হয়েও দ্বিতীয় শ্রেণির বাঙালি এবং মুসলমান হয়েও দ্বিতীয় শ্রেণির মুসলমান।

এই যে শূন্যস্থান, তা অনন্তকাল পড়ে থাকতে পারে না। আজ জেলায় জেলায় ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের এত দ্রুত বিস্তার হচ্ছে এই শূন্যস্থান ভরাট করেই। ভাষাভিত্তিক পরিচিতি নিয়ে রাজনৈতিক জমি যাঁরা তৈরি করার চেষ্টা করছেন পশ্চিমবঙ্গে, তাঁরাও খুব সুচারুভাবে বাঙালি মুসলমানের এই অসন্তোষকে টার্গেট করছেন। কলকাতাকেন্দ্রিকতা ঝেড়ে ফেলে বামপন্থী ও অন্যান্য অবিজেপি রাজনৈতিক দলগুলো আগামীদিনে তাদের আওয়াজ শুনতে চায় কিনা তার উপরই নির্ভর করবে এই রাজ্যের বাঙালি মুসলমানের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

ইতিমধ্যে তাকেও একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। ‘বাঙালি মুসলমান’ এই পরিচিতির দুটো অংশ – বাঙালি এবং মুসলমান। দুটোর কোনোটা নিয়েই লজ্জিত হওয়ার কারণ নেই। এপারের হিন্দুত্ববাদীদের কাছে নিজেকে বাঙালি প্রমাণ করা বা বাংলাদেশের মুসলমান মৌলবাদীদের কথায় নিজের মজ্জাগত বাঙালিয়ানা ঝেড়ে ফেলা — কোনোটারই দায় তার নেই। তার বাঙালিয়ানা তার কর্তব্য নয়, অধিকার। রক্তের বিনিময়ে আদায় করা অধিকার। এই প্রভাত ফেরী, এই শোভাযাত্রা করারই অধিকার। সমস্ত বাঙালির অধিকার। নতুন বছর, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, শুভ হোক। মঙ্গল হোক সকলের।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।