পৃথিবী জুড়ে শব্দের নিরন্তর খেলা। সমুদ্রে ঢেউয়ের গর্জন, নদীতে জলের কলতান, আকাশে মেঘের নিনাদ – সমস্ত জীবজগৎ পরস্পরকে শব্দের বিন্যাসে আহ্বান করে। শব্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটে শব্দেরই মাধ্যমে। সুরকাররা চলমান প্রকৃতি থেকেই সুরের সন্ধান করেন, সেই সুর গানের মধ্য দিয়ে মানুষের চিন্তাকে চমৎকৃত করে, বিনোদনের জগৎকে দেয় মাত্রা। সাহিত্যিকরা প্রকৃতির নিরন্তর শব্দের চঞ্চলতাকে সাহিত্যের ক্যানভাসে তুলে ধরেন। মানুষ ছাড়া অন্যান্য জীবও শব্দ আর নৈঃশব্দ্যের জগতে বিচরণ করে শারীরিক তথা মানসিক প্রশান্তি অনুভব করে।
তাই একথা অনস্বীকার্য যে শব্দের সুচারু প্রয়োগ সমস্ত জীবজগতের পক্ষে জরুরি। কিন্তু শব্দ ক্রমশ মানুষের কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। তা ঘটছে মানুষেরই জন্য । মাইক্রোফোনের অপব্যবহার মানুষকে বাধ্যতামূলক শ্রোতায় পরিণত করেছে। কারখানার যন্ত্রের আওয়াজ শ্রমিককে বধিরতা উপহার দিয়েছে। মোহময় শব্দজগৎ মানুষের জীবন থেকে ক্রমে মুছে যাচ্ছে। এককথায়, অবাঞ্ছিত শব্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মানুষ সৃষ্টি করেছে শব্দদানব। সেই দানবের অত্যাচারে ঘটে চলেছে নানা অবাঞ্ছিত ঘটনা।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
কিন্তু এই শব্দদানবের হাত থেকে বাঁচার তাগিদেই আবার মানুষ সৃষ্টি করেছে নানাবিধ আইন। আইনের সুচারু প্রয়োগের পথ প্রশস্ত হয়েছে মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রদত্ত এক বিচারের মধ্য দিয়ে। ঘোষিত হয়েছে, কোনো মানুষ অন্য কোনো মানুষকে বন্দী বা দাস শ্রোতায় পরিণত করতে পারবে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেমন আবশ্যিক গণতন্ত্রের স্বার্থে, সভ্যতার অগ্রগতির প্রয়োজনে, ঠিক তেমনি কোনোকিছু শুনতে না চাওয়াও জীবনের পক্ষে অপরিহার্য। মানবজীবনে শব্দের প্রয়োজন যেমন আবশ্যিক, তেমনি নৈঃশব্দ্যও অপরিহার্য। ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে মাননীয় বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ এক ঐতিহাসিক তথা গুরুত্বপূর্ণ রায় দেন। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ওই রায়কে সুরের অসুর নিধনে এক গুরুত্বপূর্ণ বাণী হিসাবে গ্রহণ করেন। ওই রায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। রায়টি দেওয়া হয়েছিল সাধারণ মানুষের কল্যাণার্থে।
আরো পড়ুন প্লাস্টিক ক্যারি ব্যাগের বাড়বাড়ন্ত, পরিবেশের নাভিশ্বাস
তারপর সবটাই ইতিহাস। শব্দদূষণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আদালতের একের পর এক রায় কেন্দ্রীয় সরকারকে বাধ্য করে বিষয়টি নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করতে এবং তার ফলস্বরূপ ২০০০ সালে প্রণয়ন করা হয় শব্দদূষণ সংক্রান্ত নতুন আইন। সেই আইনের প্রধান নির্দেশগুলি হল:
১। উৎসবের আনন্দকে বজায় রাখতে নিয়ম মেনে সাউন্ড লিমিটার সহ মাইক্রোফোন ব্যবহার করতে হবে।
২। শব্দবর্জিত অঞ্চলে কোনোরকম শব্দদূষণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আদালত ও হাসপাতাল থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকা শব্দবর্জিত অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই অঞ্চলে হর্ন বাজানোও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
৩। নির্ধারিত সময়সীমা এবং প্রশাসনের অনুমতি ব্যতীত মাইক্রোফোন ব্যবহার করা যাবে না। রাত দশটার পর এবং সকাল ছটার আগে মাইক্রোফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ।
৪। উচ্চ বিস্ফোরক শব্দ যুক্ত বাজি বা পটকার (চকলেট বোমা, দোদোমা, কালিপটকা প্রভৃতি) উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ।
৫। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ডিজেল জেনারেটর সেট পর্ষদের পূর্ব অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করতে হবে এবং শব্দ নিয়ন্ত্রক বেষ্টনী ব্যবহার করা আবশ্যিক।
৬। যানবাহনে এয়ার হর্ন ব্যবহার, বিক্রি এবং মজুত আইনত নিষিদ্ধ।
৭। পশ্চিমবঙ্গের বনাঞ্চলগুলিতে লাউডস্পিকার বা মাইক্রোফোন ব্যবহার করা যাবে না।
৮। সার্বিক শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সজাগ থাকতে হবে।
দুর্গাপুজো দিয়ে আরম্ভ হয়ে গেছে শারদোৎসব। উৎসবের রেশ থাকবে সরস্বতীপুজো পর্যন্ত। উচ্চস্বরে মাইক বাজবে, শব্দবাজি ব্যবহার হবে নিয়ম ভেঙে। তবু নৈঃশব্দ্যের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করতেই হবে। শব্দদানব এক সময় পশ্চিমবঙ্গে বোতলবন্দি হয়েছিল, কিন্তু সে আবার বোতল থেকে বেরিয়ে এসেছে। বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা শব্দদানবকে বোতলবন্দি করার জন্য নাগরিক আন্দোলন আরম্ভ করেছে, প্রশাসনকে সক্রিয় হওয়ার জন্য আবেদন করেছে। শব্দদানব যদি বোতলবন্দী না হয়, তবে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে আরও অনেক শব্দ-শহিদের জন্য। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৯৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ১৪ জন শব্দ-শহিদ হয়েছেন, যদিও মাত্র একটি ক্ষেত্র ছাড়া আর কোনো ক্ষেত্রেই দোষীরা শাস্তি পায়নি। দোষীদের দ্রুত শাস্তি ও শব্দ-শহীদদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিতে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা বিচারাধীন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গে এখনো বহু বেআইনি বাজি কারখানা রয়েছে। প্রশাসনের কাছে বারবার আবেদন নিবেদন করা সত্ত্বেও এই বেআইনি কারখানাগুলো চালু রয়েছে। জানা গেছে, এই ধরনের কারখানায় বেআইনি বোমাও তৈরি করা হয়। এইসব কারখানায় বিস্ফোরণের ফলে এখন পর্যন্ত প্রায় সত্তর জন মারা গেছেন । এমনকি গত মঙ্গলবারও (১১ অক্টোবর) পূর্ব মেদিনীপুরের এক বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের ফলে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। তাই মনে হয়, এ রাজ্যে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। নৈঃশব্দ্যের দাবিতে নাগরিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া পথ নেই।
নিবন্ধকার পরিবেশ ও সমাজকর্মী। মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।