ভারতের সংবিধান সভায় খসড়া সংবিধান আলোচনার সময়ে হানসা মেহতা, রাজকুমারী অমৃত কাউর, দাক্ষায়ণী ভেলায়ুধান (ক্যাবিনেটের একমাত্র দলিত সদস্যা) সহ, বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর এবং মিনু মাসানী নারীবিরোধী ধর্মীয় ব্যক্তিগত আইনের পরিবর্তে এক অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা বলেছিলেন। কিন্তু অধিকাংশ সদস্য মনে করলেন, সেটা করা হলে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার ভঙ্গ করা হবে এবং ইতিমধ্যেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে পড়বে। এই প্রবন্ধে আমরা অবশ্যই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির জটিল এবং গত কয়েক দশকের গেরুয়াকণের ইতিহাস আলোচনা করব না। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে ব্যক্তিগত আইনগুলো বলবত থাকায় হিন্দুত্ববাদের উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যালঘু যৌনতা/লিঙ্গের অধিকারের আন্দোলন ধর্মীয় আইনের কাছেও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। সমপ্রেমী বিবাহের বিরুদ্ধে যে সব আপত্তি আনা হয়েছে তার অন্যতম হল, এই দাবি হিন্দু ব্যক্তিগত আইনের বিরুদ্ধে যায়।

ভারতের ইতিহাসে বিবাহ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতে নানা ধরনের সম্পর্ক ছিল। ধর্মীয় সম্মতি ছিল পুরুষ ও নারীর মধ্যে বিবাহে, কিন্তু সেই সঙ্গে সমপ্রেমী সম্পর্কও ছিল এবং তা নানাভাবে স্বীকার করা হত। মনুস্মৃতি বিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে সমপ্রেম দণ্ডনীয় অপরাধ বলে, অর্থাৎ প্রকারান্তরে অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে তা মেনে নেওয়া হয়। ঔপনিবেশিক ভারতে প্রথম সব ধর্মের জন্য অভিন্ন আইন চালু হয়। উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী বিধানই সব হিন্দুর বিধান বলা হয় আর সুন্নিদের হানাফি আইনকে সব মুসলমানের ব্যক্তিগত আইন হিসাবে চালু করা হয়।

একদিকে ভিক্টোরিয় দিশা, আর অন্যদিকে বিসমপ্রেমী পরিবারের উপর বুর্জোয়া জোর, যাতে সামাজিক পুনরুৎপাদনের জন্য শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে ‘স্বাভাবিক’ পরিবার গড়ে ওঠে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, ভারতে যৌনতা বা দাম্পত্য সম্পর্ক পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী সংজ্ঞা পায় এবং ‘অস্বাভাবিক’ যৌন আচরণ দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হয়।

বৈবাহিক সমতা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন

কিন্তু গত পাঁচ দশক বা তারও বেশি সময় ধরে বাধ্যতামূলক বিসম যৌনতা নানাভাবে প্রশ্নের মুখে পড়েছে, কারণ বিশ্বজুড়ে LGBTIQ+ (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সসেক্সুয়াল, ইন্টারসেক্স, কুইয়ার+) আন্দোলনের প্রসার ঘটেছে। তবে এশিয়া মহাদেশে তাইওয়ান একমাত্র দেশ, যেখানে সমপ্রেমী বিয়ে স্বীকৃত হয়েছে। ভারতে ২০২২ সালের নভেম্বর মাস থেকে নতুন করে এক দফা লড়াই আরম্ভ হয়েছে, বিশেষ করে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট, ১৯৫৪-র ৪(গ) ধারার সাংবিধানিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কারণ এই ধারা gender binary-কেই বিয়ের আবশ্যক শর্ত হিসাবে ধরে।

ন্যাশনাল নেটওয়ার্ক অফ এলবিআই উইমেন অ্যান্ড ট্রান্সপার্সনস যে পিটিশন দায়ের করেছে, তাতে লেসবিয়ান-বাইসেক্সুয়াল (সমপ্রেমী-উভপ্রেমী) মেয়েদের এবং ট্রান্স মানুষদের নিজের পছন্দের সঙ্গীকে বিয়ে করার আইনি ও সামাজিক স্বীকৃতি চাওয়া হয়েছে। অর্থাৎ দুজন মানুষের যৌনতা/লিঙ্গ পরিচিতি যা-ই হোক না কেন, তাদের বিয়ে করার অধিকার দাবি করা হয়েছে।

তবে এই পিটিশন নিয়ে আদালতে শুনানি হওয়ার আগে পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ (পিইউসিএল) এবং ন্যাশনাল নেটওয়ার্ক মিলে কুইয়ার ট্রান্স মানুষের উপর পারিবারিক হিংসা নিয়ে এক গণশুনানির আয়োজন করে। ১ এপ্রিল ২০২৩ কিছু অভিজ্ঞ বিচারক, আইনজীবী, শিক্ষক-গবেষক ও সমাজকর্মীকে নিয়ে গঠিত এক প্যানেলের সামনে এই গণশুনানি চলে। তার প্রতিবেদন আপ্নোঁ কা বহুত লাগতা হ্যায় শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এতে নথিবদ্ধ আছে ৩১ জন কুইয়ার-ট্রান্স মানুষের সমাজে ও জন্মসূত্রে পাওয়া পরিবারে (“biological family”) নিয়মিত যৌন হিংসার মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা এবং কীভাবে তাদের পছন্দের পরিবার (“chosen family”) গড়তে বাধা দেওয়া হয় বা তার জন্য হয়রানি ভোগ করতে হয় – সেই অভিজ্ঞতা। কুইয়ার সমাজকর্মী ও শিক্ষক সায়ন ভট্টাচার্য এবং ট্রান্স আন্দোলনের কর্মী ও নেত্রীদের অনেকেই, যেমন রঞ্জিতা সিনহা ও তিস্তা দাস, মনে করেন অধিকারহীন সম্পর্কের প্রতীকি স্বীকৃতি পেয়ে কোনো লাভ নেই। সুস্থভাবে, যথাযথ মর্যাদায় বাঁচার রসদ বা অন্যান্য নাগরিক অধিকার যদি না থাকে, তাহলে বিয়ের ক্ষেত্রে সমানাধিকার পেয়ে কী লাভ? কুইয়ার ফেমিনিস্ট পৌষালী বসাক খুব সঙ্গতভাবেই বলেছেন, বিয়ে না করার অধিকার যে কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে থাকা জরুরি।

সমপ্রেমী বিবাহে সরকারি আপত্তি

সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা সুপ্রিম কোর্টে এক চরম কুইয়ারবিদ্বেষী ও প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান নিয়েছেন, যা বিয়ে বলতে বোঝে কেবল পুরুষের বাসস্থানে বাস করা, জন্মসূত্রে পুরুষ ও নারীর মধ্যে বিসমকামী বিয়ে, যার মূল উদ্দেশ্য সন্তান উৎপাদন এবং যাতে পরিবারের সংজ্ঞা পিতৃতান্ত্রিক, যার ভিত্তি হল ‘ন্যায়সঙ্গত’ পুরুষ নির্ধারিত পরম্পরায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার।

সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট বেঞ্চে চলছে সমলিঙ্গ বিবাহ সংক্রান্ত এই শুনানি। এই বেঞ্চের শীর্ষে আছেন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। বেঞ্চকে দেওয়া হলফনামায় সরকার বলেছে, বিয়ে করার আইনি স্বীকৃতি কেবল বিসমপ্রেমী সম্পর্কের জন্য এবং এই ধারা বজায় রাখার পিছনে রাষ্ট্রের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ রয়েছে। আইন মন্ত্রকের সরকারি হলফনামায় বলা আছে, সমলিঙ্গ বিবাহে দুজন মানুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতীয় পরিবারের ধারণার (অর্থাৎ স্বামী, স্ত্রী ও সন্তান) সঙ্গে বেমানান। সরকার দাবি করেছে, কোনো আইনি পরিবর্তন করতে হলে তা করতে পারে একমাত্র নির্বাচিত সংসদ, কোনো আদালত নয়।

মেহতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের ২০২২ সালের ডবস বনাম জ্যাকসন মামলার প্রতিক্রিয়াশীল রায়ের উল্লেখ করেন। সেই রায় রো বনাম ওয়েড (১৯৭৩) এবং প্ল্যানড পেরেন্টহুড বনাম কেসি (১৯৯২)-র রায়কে উলটে দিয়ে নারীর নিজের দেহের উপর অধিকারের স্বীকৃতিতে আইনপ্রণেতার অধিকার ও আদালতের সীমাবদ্ধ ক্ষমতার কথা বলেছে। মেহতা এই রায়ের কথা বলে ভারতেও সমপ্রেমী বিয়ের আইনি স্বীকৃতি কেন আদালত দিতে পারে না, কেবল সংসদ পারে – তা জোর দিয়ে বলেছেন।

এখন প্রশ্ন হল, কে কাকে বিয়ে করবে, তা নিয়ে রাষ্ট্র হুকুম কেন দেবে? কী তার স্বার্থ? এ হল ধনতন্ত্র ও পুরুষতন্ত্রের স্বার্থ। রাষ্ট্র যেখানে সামাজিক নিরাপত্তার সব দায়দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে, সেখানে ধনতন্ত্রের আর্থিক স্বার্থে চাই এমন এক অসাম্য জর্জরিত পরিবার, যেখানে নারী তার “সহজাত” প্রবৃত্তির দরুন বিয়ের মাধ্যমে সমস্ত সেবামূলক বা পরিষেবামূলক কাজ করে। ফলে মালিক শ্রেণির বিনা পয়সায় শ্রমিকের জোগান অব্যাহত থাকে।

আরো পড়ুন এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের অধিকার: একুশে পাস, বাইশে?

মেহতা সুপ্রিম কোর্টকে আরও বলেছেন, স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে পারেন যদি তাঁর স্বামী ধর্ষণ/পায়ুমৈথুন/পশুকামের অপরাধে দণ্ডিত হন। তিনি বলেন, বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার নির্দিষ্টভাবে স্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে। সমপ্রেমী বিয়েতে এই অধিকার কে পাবে? পিটিশনারদের আদালতের কাছে বক্তব্য ছিল, উভয়পক্ষকেই এই অধিকার দিতে হবে। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। আদালত কি সমপ্রেমী বিবাহে দুই পক্ষকেই সেই অধিকার দিতে পারে, যা বিসমপ্রেমী বিবাহে একটা পক্ষকে দেওয়া হয় না?

অর্থাৎ মেহতা এবং তিনি যে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি, তাদের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, দুজন সম্পূর্ণ সমান মানুষ, যে লিঙ্গেরই বা যৌন প্রবণতারই হোন না কেন, বিয়ে করে একসঙ্গে বাস করতে পারেন। আরেকটা বড় সমস্যা হল, বিয়েতে কে স্ত্রী আর কে স্বামী তা নির্ধারণ করা, কারণ “আইন বলে বিয়ের পর স্ত্রী স্বামীর বাসস্থানে থাকার অধিকার পায়। তাহলে কে এখানে স্ত্রী হবে?”

কেন আমরা সমপ্রেমী/gender non-binary বিবাহের অধিকারের পক্ষে?

যাঁরা বিয়ে না করে একত্রে বাস করতে চান, বিসমপ্রেমী বা সমপ্রেমী – যেমন সম্পর্কেই হোক না কেন, তাঁদের সেই অধিকার থাকা দরকার। কিন্তু সমপ্রেমী বিবাহ বা সিভিল ইউনিয়ন, যে নামেই ডাকা হোক, সেটা আইনসিদ্ধ না হলে একত্রে থাকলেও সেই যুগলের অনেক সমস্যা থেকে যায়। তা নিজের সঙ্গীর জন্য চিকিৎসা বিমা পলিসি কেনা হতে পারে, নিজের সম্পত্তি (ফ্ল্যাট, ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকা) মৃত্যুর পর সঙ্গীকে দেওয়াও হতে পারে। কুইয়ারদের অনেক রকমের অধিকারই নেই। এই দুর্ভাবনা থেকেও বিয়ের কথা উঠে আসে। যেহেতু এই কথাগুলো বললেই অনেকসময় বলা হয় এসব “পেটি বুর্জোয়া” বা “আর্বান এলিটিস্ট” সমস্যা, আমজনতার সমস্যা নয়, তাই একটা তথ্য দেব।

চয়নিকা শাহ, রাজ মার্চেন্ট, শালস মহাজন এবং স্মৃতি নেওটিয়ার গবেষণা নো আউটলজ ইন দ্য জেন্ডার গ্যালাক্সি দেখাচ্ছে যে তাঁরা যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, তার এক বড় অংশ ছিলেন দরিদ্র। গবেষণার পর্বে (২০০৯-২০১৫) তাঁদের মাসিক আয় ছিল ১০,০০০ টাকার কম।

মনে রাখা জরুরি, যারা স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী বিয়ে করে, এমনকি তাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার এবং আরও একগুচ্ছ দেওয়ানি আইনের নির্ধারণ হয় ধর্মীয় ব্যক্তিগত আইনের মাধ্যমে। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অরিত্রা চক্রবর্তী বলেন, দেশের প্রায় ৩০% আইন সংশোধন করতে হতে পারে সমলিঙ্গ বিবাহ আইনসিদ্ধ হলে।

এটা অবশ্যই একটা বড় পদ্ধতিগত সমস্যা। কিন্তু যদি মানুষের অধিকারের সম্প্রসারণ মূল বিষয় হয়, তাহলে যে কুইয়াররা বৈবাহিক অধিকার চাইছেন, তাঁদের সমর্থন করা আবশ্যক। তবে তার অন্যতম পূর্ব শর্ত হল লিঙ্গ ও যৌনতার বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং পরিবারের ধারণার খোলনলচে বদল করা। দেখা যাক, জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্ট বা সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়। তার অনেকটাই অবশ্য নির্ভর করছে আমাদের যৌথ আন্দোলনের উপর।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.