ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের কথা বলতে গেলে বলতেই হয়, সর্বার্থে এই দেশের বারো মাসে তেরো পার্বণ। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বিশ্বকর্মা পুজো থেকে শুরু হয়ে সরস্বতী পুজো পর্যন্ত চলে নানা ধরনের দেবদেবীর আরাধনা। তার মধ্যে দুর্গাপুজো বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। অতীতে রাজা বা জমিদাররাই দুর্গাপুজোর আয়োজন করতেন এবং তাঁদের অধীনস্থ প্রজারাই পূজা প্রাঙ্গণে এসে জমিদারের মণ্ডপ ভরিয়ে দিতেন। ক্রমশ দেবতাদের উপর রাজা কিংবা জমিদারদের এই আধিপত্যবাদকে অস্বীকার করে গড়ে উঠল সাধারণ মানুষের উদ্যোগে সর্বজনীন পুজো, যা চলতি কথায় বারোয়ারি পুজো। রাজতন্ত্র এবং জমিদারতন্ত্রের কঠিন নাগপাশ থেকে মুক্তি পেলেন দেবদেবীরা। সাধারণ মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে পুজো শুরু হল। বাঙালির রক্তে মিশে আছে মহালয়ার আগমনী গান আর দশমীর রাতে নদীর জলে বিসর্জনের ছবি।
স্বাধীনোত্তর বাংলায় রাজনীতিবিদরা ক্রমেই বুঝতে আরম্ভ করলেন, বাঙালি মননে দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। ফলে এই পুজোগুলোকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার উদ্যোগ শুরু হল। কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় রাজনীতিবিদরা সর্বজনীন পুজোর পৃষ্ঠপোষক হতে আরম্ভ করলেন এবং অচিরে এঁরাই পুজো কমিটিগুলোর সভাপতি কিংবা সম্পাদকের পদে আসীন হলেন। সমাজে যাঁরা বিত্তশালী বা বাহুবলী তাঁরাও পিছিয়ে থাকলেন না। সর্বজনীন পুজোর আয়োজনে তাঁরাও আধিপত্য বিস্তার করলেন, কারণ তাঁরা বুঝেছিলেন, এর মধ্যে তাঁদের শ্রীবৃদ্ধির সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। স্বাধীনোত্তরকালে পশ্চিমবঙ্গের বুকে অত্যন্ত সংগত কারণে বামপন্থী আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছিল, কিন্তু বামপন্থী নেতারা জনমানসে প্রভাব বিস্তারের জন্য কোনো সর্বজনীন পুজো কমিটির কর্তাব্যক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা করেননি। তবে শারদোৎসবে বামপন্থী বইয়ের স্টল দেওয়া বা সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার নানাবিধ মৌলিক সমস্যা নিয়ে স্টল সাজানোর উদ্যোগ দেখা গেছে। গত শতকের আটের দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে বাম জনপ্রতিনিধি, নেতারাও সর্বজনীন পুজো কমিটির বিভিন্ন আসন অলংকৃত করতে উদ্যোগী হন।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
গত ১৫ বছরে সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে এক তীব্র ধর্মীয় বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিবেশে সর্বজনীন পুজোর বহুমুখী নির্মলতা ক্রমশ মুছে গিয়ে চূড়ান্ত রাজনৈতিক, বিত্তশালী ও বাহুবলীদের আধিপত্যবাদ সর্বজনীন পুজোকে গ্রাস করেছে। একসময়ে রাজা বা জমিদারদের আধিপত্যকে খর্ব করে সর্বজনীন পুজোর সৃষ্টি হয়েছিল, এখন আবার সেটা ক্ষমতা প্রদর্শনের জায়গা হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিককালে সরকারি কোষাগার থেকে ধর্মীয় ব্যক্তিদের আর্থিক সাহায্য বা সর্বজনীন পুজো কমিটিগুলোকে অর্থসাহায্য দেওয়ার মধ্যে দিয়ে এক নতুন পরিমণ্ডল তৈরি করা হয়েছে। শাসক দল এইভাবে পুজো কমিটির কর্মকর্তাদের নিজেদের তাঁবে আনতে চাইছেন। কারণ পাড়ায় পাড়ায় যেসব সর্বজনীন পুজো হয়, সমাজে তার কর্তাব্যক্তিদের কমবেশি প্রভাব থাকে এবং সেই প্রভাব ভোটের অঙ্কে গুরুত্বপূর্ণ। সে অঙ্ক মেলানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতেই হবে, তা সে সর্বজনীন পুজোয় রাষ্ট্রের অর্থসাহায্য নিয়ে যতই আলোচনা, সমালোচনার ঝড় উঠুক।
আরো পড়ুন রামনবমী এখন প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার উদযাপন
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দুর্গাপুজো করার প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল স্বাধীনতার ঠিক পরেই। মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় স্বয়ং এই উদ্যোগের কারিগর ছিলেন। ১৯৪৭ সালের পর দেশভাগের অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে অবিশ্রান্ত উদ্বাস্তু জনস্রোত তখন পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করছে, উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে মৃত্যুর বিভীষিকা, দিশেহারা অবস্থা সমস্ত ছিন্নমূল মানুষের। তাঁদের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে সরকারি উদ্যোগে দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু আজকের দিনে দুর্গাপুজো বা যে কোনো সর্বজনীন পুজোয় রাষ্ট্রীয় সাহায্য দেওয়ার পিছনে রয়েছে এক জটিল রাজনৈতিক আধিপত্যবাদ। স্পষ্টতই এই আধিপত্যবাদ সর্বজনীন পুজোর সাথে যুক্ত সারল্যের পরিপন্থী। এ এক দুঃসময়, যখন সর্বত্র দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা। সে চেষ্টা সমাজকে কলুষিত করছে, মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করছে। এই দুঃসময়ে একদিকে চলছে ব্যাঙ্ক, বীমা, রেল প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের লাগামছাড়া বেসরকারিকরণ, অন্যদিকে ধর্ম ও পুজো সম্পর্কিত বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগের রাষ্ট্রীয়করণ।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
[…] আরো পড়ুন সর্বজনীন পুজোকে গ্রাস করছে রাষ্ট্রীয়… […]