ভারতের জাতীয় খেলা না হয়েও জনপ্রিয়তার নিরিখে প্রায় তাই হয়ে উঠেছে ক্রিকেট। দেশের পেশাদারি খেলার দুনিয়ার অবিসংবাদী রাজা এখন ক্রিকেট। হ্যাঁ, রাজার খেলা বলেই ক্রিকেট পরিচিত, এই সেদিন পর্যন্ত রানীদের স্থান ছিল প্রচারের আলোর বাইরে। যদিও মিতালী রাজের মত কয়েকজন মহিলা ক্রিকেট খেলোয়াড়ের নাম আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু তাঁরা ব্যতিক্রম। মহিলাদের ক্রিকেটের খোঁজখবর রাখার আগ্রহ আমাদের ততটা নয়, যতটা পুরুষদের ক্রিকেট ঘিরে উন্মাদনা। আগামী মাস থেকে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের আদলে যে মহিলাদের প্রিমিয়ার লিগ ভারতে শুরু হতে চলেছে, তাতে কি এই চিত্রটা পালটাবে?

আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যে সব পেশাকে মহিলাদের জন্য স্বাভাবিক ও উপযুক্ত বলে সিলমোহর দিয়েছে, ক্রিকেট তার বাইরে। আর আমাদের আর্থসামাজিক কাঠামোয় লিঙ্গবৈষম্য ঢুকে আছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেদিক থেকে দেখলে একজন গৃহবধূ আর একজন প্রথম শ্রেণির মহিলা ক্রিকেট খেলোয়াড়ের মধ্যে বড় মিল একটাই – স্বীকৃতি না পাওয়াকে মেনে নিয়ে নিজের কাজের সাধনা চালিয়ে যাওয়া। একজন মহিলা ক্রিকেটারকে প্রতিষ্ঠা, যশ, অর্থ লাভের জন্য পুরুষের তুলনায় ১০০ গুণ বেশি চেষ্টা করতে হয়। অনতি অতীতে মহিলা ক্রিকেটারদের অনেক সমস্যার মধ্যে প্রধান ছিল স্পনসর না পাওয়া এবং প্রশিক্ষণের উপযুক্ত পরিকাঠামো না পাওয়া। আজ ক্রিকেটের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ কমাতে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগ চালু করা এবং গত বছর ভারতীয় দলের হয়ে খেলার জন্য ম্যাচ পিছু পুরুষদের সমান পারিশ্রমিকের ঘোষণা নিঃসন্দেহে স্বাগত জানানোর মত পদক্ষেপ।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

পেশাদার ক্রিকেট বর্তমানে এক আদ্যন্ত বাণিজ্যিক প্রকল্পে পরিণত। বিশেষ করে আইপিএল খেলার এই বাণিজ্যিক রূপকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। আইপিএলের প্রচলনে ক্রিকেটারদের বারো মাস বিপুল অর্থোপার্জনের পথ প্রশস্ত হয়েছে। এতে খেলা হিসাবে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তাও বেড়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা, যদিও খেলার গুণগত মানের ওঠাপড়া নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।

সে পথেই এবার হাঁটবেন এ দেশের মহিলা ক্রিকেটাররা। এবারের ডব্লিউপিএলের জন্য ইতিমধ্যেই নিলাম সম্পন্ন হয়েছে। দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, আমেদাবাদ আর লখনৌ সামগ্রিকভাবে ৪৬.৭ বিলিয়ন টাকা অর্থমূল্যে নির্মিত হয়েছে, অর্থাৎ গড়ে ৯.৩ বিলিয়ন টাকায় গঠিত হয়েছে একেকটা দল। এ দেশের মহিলা প্রিমিয়ার লিগের সূচনালগ্নেই এই পরিমাণ বিনিয়োগ বুঝিয়ে দেয় যে এই প্রতিযোগিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে বাণিজ্যিক মহল যথেষ্ট আশাবাদী। ২০২৩ সালের ডব্লিউপিএলের নিলামে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা হিসাবে উঠে এসেছেন ভারতের অত্যন্ত প্রতিভাবান ক্রিকেটার স্মৃতি মান্ধনা। তাঁর সঙ্গে ৩.৪ কোটি টাকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে রয়াল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর দলের। অবশ্যই ভারতের মহিলা ক্রিকেটে এ এক ঐতিহাসিক ঘটনা।

এক সংবাদমাধ্যমের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, মহিলাদের প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে আমজনতার মধ্যে যথেষ্ট ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই উৎসাহ আরও বেশি। আর ভবিষ্যতে ক্রিকেটার হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখা কিশোরীদের মধ্যে, তাদের পরিবারের মধ্যে দেখা গেছে নতুন উৎসাহ, ক্রিকেটও যে মহিলাদের জন্য পুরো সময়ের পেশা হয়ে উঠতে পারে – সেই আশ্বাস। এই নতুন উৎসাহ, উদ্দীপনার সঙ্গে বাণিজ্যিক পুঁজির মেলবন্ধন হয়ত অচিরেই ডব্লিউপিএলকে আইপিএলের মতই জনপ্রিয় ও লাভজনক করে তুলবে। অনেকে আশা করছেন, এর প্রভাবে মহিলা ক্রিকেটে ভবিষ্যৎ প্রতিভার বিকাশ আরও ত্বরান্বিত হবে। বেশ কিছু বড় কর্পোরেট মহিলাদের ক্রিকেটকে উৎসাহ দিতে এগিয়ে এসেছে, শুরু করেছে নানা হ্যাশট্যাগভিত্তিক প্রচারাভিযান। যেমন বিসিসিআই আর মাস্টারকার্ডের #HalkeMeinMattLo অথবা কোকাকোলার #PowerHasNoGender ইত্যাদি। এক কথায় বলতে গেলে বহু যুগ ধরে বঞ্চিত ভারতের মহিলা ক্রিকেটে এক নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন হল, এই নতুন যুগের আলোয় সত্যিই কি ভবিষ্যতের ক্রিকেটে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ কমবে?

সারা দুনিয়ার পরিসংখ্যান অবশ্য তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। এখনো বিশ্বে মহিলাদের খেলাধুলোয় কর্পোরেট পুঁজির বিনিয়োগ পুরুষদের অর্ধেক। সুতরাং শুধুমাত্র মহিলাদের প্রিমিয়ার লিগে পুঁজির বিনিয়োগ সামগ্রিকভাবে এ দেশের মহিলা ক্রিকেটের ভবিষ্যৎকে কতটা সমৃদ্ধ করবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। খেলার দুনিয়ায় আমাদের রোজকার দুনিয়ার মতই মহিলারা নানাভাবে লিঙ্গবৈষম্যর শিকার আর তার সূচনা হয় একেবারে প্রস্তুতি পর্বে। এ দেশে একজন মহিলা ক্রিকেটারের প্রশিক্ষণের জন্য রাষ্ট্রীয় অর্থ বরাদ্দ বা পরিকাঠামো – দুটোই বিরল। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কথা না হয় বাদ দেওয়া গেল, কিন্তু প্রতিভা অন্বেষণ করার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও অপ্রতুল। কাজেই ক্রিকেটার হয়ে ওঠার স্বপ্ন শুধু সেইসব পরিবারের মেয়েদের পক্ষেই লালন করা সম্ভব, যারা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সক্ষম। অসংখ্য দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের কাছে জাতীয় স্তরে ক্রিকেট খেলার আশা হয়ত দুরাশাই থেকে যাবে। তাছাড়া লিঙ্গবৈষম্য দূর করা এক দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ, যার প্রতিফলন জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে হতে হয়। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পদক্ষেপ হয়ত দু-একটা ভালো নিদর্শন তৈরি করতে পারে, কিন্তু সমস্যার সার্বিক মোকাবিলায় সক্ষম হয় না। ভারতে অবশ্য লিঙ্গবৈষম্য দূর করার জন্য নানা সামাজিক আন্দোলন হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু সমস্যার ব্যাপ্তি ও গভীরতার তুলনায় তা যথেষ্ট নয়। মহিলাদের প্রিমিয়ার লিগ সেই প্রচেষ্টায় হয়ত নবতম সংযোজন, কিন্তু লিঙ্গবৈষম্য দূর করে খেলার জগতের বাস্তুতন্ত্রের খোলনলচে বদলে ফেলতে যে পদক্ষেপ দরকার, যে মৌলিক কাঠামোগত সংস্কার দরকার, তা যোগাতে অক্ষম।

আরো পড়ুন মোটেরার মাঠে দেখবি একটা মজারু

তাছাড়া ক্রিকেট খেলা প্রসঙ্গে লিঙ্গসাম্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আরেকটা জিনিসের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। এই খেলার সঙ্গে জড়িত অন্য কুশীলবদের মধ্যে আজও মহিলাদের সংখ্যা কম। প্রশিক্ষক, আম্পায়ার, অন্যান্য টেকনিকাল দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি তো বটেই, এমনকি ক্রিকেটের ধারাভাষ্যকারদের মধ্যেও মহিলারা সংখ্যালঘু। কাজেই মহিলাদের ক্রিকেটে আইপিএলের আদলে ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ চালু করে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার ফলে লিঙ্গবৈষম্য দূর হবে – এরকম বলা অতিশয়োক্তি এবং এক জটিল আর্থসামাজিক সমস্যার অতিসরলীকরণ।

এসব সত্ত্বেও মহিলাদের প্রিমিয়ার লিগকে স্বাগত জানাতেই হবে। আশা করব, আগামীদিনে শুধু ক্রিকেট নয়, সামগ্রিকভাবে খেলার জগতে মহিলাদের প্রতিভার অনুসন্ধান, লালন ও স্বীকৃতি আরও বাড়বে। আশা করা যায়, আমজনতার মানসিকতাতেও আসবে পরিবর্তন। ফলে বিভিন্ন খেলায় মহিলা দলগুলোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে আর বাজারের নিয়মেই সেই জনপ্রিয়তাকে ব্যবসায়িক মূলধন করে লাভের আশায় আসবে আরও বিনিয়োগ। তবে প্রকৃত অর্থে লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সামাজিক সচেতনতা এবং রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। শুধুমাত্র কর্পোরেট পুঁজির বিনিয়োগে এ দেশের ক্রীড়া ক্ষেত্রে সমতা ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা হবে ভাবলে একাধারে অর্থনীতি তথা ইতিহাসের শিক্ষাকে অগ্রাহ্য করা হবে।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.