১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩। সেই কালরাত্রিতে কি একবারের জন্যেও দু চোখের পাতা এক করতে পেরেছিলেন সদ্য পঁচিশে পা দেওয়া নন্দিনী? তাঁর হাওড়ার বাড়ি থেকে সোয়া দুই হাজার কিলোমিটার দূরে কান্নুর শহরে সেদিনের অভিশপ্ত বিকেলে সন্তোষ ট্রফির খেলায় এক অন্ধ্রপ্রদেশের ফুটবলারের সঙ্গে হেড করতে উঠে মাথায় বিপক্ষের কনুই লেগে মাটিতে আছড়ে পড়েন রেল দলের ফুটবলার সঞ্জীব দত্ত। যন্ত্রণায় চোখ বুজে গিয়েছিল সঞ্জীবের। সেই চোখ আর খোলেনি। স্ত্রী নন্দিনীর কাছে যখন খবর আসে, তখন গভীর রাত।

সেদিন রাতে সেই অসহ্য শোক কীভাবে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন সঞ্জীবের সদ্য বিধবা স্ত্রী, তাঁর শোকাতুরা মা এবং দিশাহারা দুই বোন? একমাত্র তাঁদের অতি নিকট মানুষেরা ছাড়া আর কেউ সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার সাক্ষী ছিলেন না। আঠাশ বছর আগের ঘটনা, তখন মিডিয়া নামক শব্দটি প্রায় অজানা, সংবাদমাধ্যম বলতে তখন বোঝায় খাতা পেন হাতে একদল মানুষ, যাঁরা অবধারিত অফিসের ঝড়ঝড়ে গাড়ি চেপে অকুস্থলে হাজির হন, প্রয়োজনীয় সংবাদ সংগ্রহ করে ঝটপট চলে যান, আমজনতা এককথায় তাঁদের প্রেসের লোক বলে চেনে। টেলিভিশন ক্যামেরা সেইসময় এক প্রায় অজানা বস্তু; বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করে মানুষের শোক, দুঃখ, আনন্দ, বেদনার অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলি অবিকৃত অবস্থায় তুলে এনে জনসমক্ষে হাজির করবার অতি পরিচিত চল তখনও বহুলাংশে অনাবিষ্কৃত।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

সেই অর্থে নন্দিনী কিছুটা হলেও বুঝি ভাগ্যবতী। তাঁর প্রিয় মানুষটির জন্য একাকী, অতি ব্যক্তিগত কিছু চোখের জল ফেলবার সময় তিনি পেয়েছিলেন। তাঁর স্বামী, আটপৌরে রেলের চাকুরীজীবী, ফুটবলার সঞ্জীবকে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য নির্জনে স্মরণ করতে বাধা পাননি তিনি। কিন্তু সেদিক থেকে ডেনমার্কের কোটিপতি তারকা ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের স্ত্রী সাবরিনা বড়ো দুঃখী এক যুবতী। তাঁর ভালবাসার মানুষটিকে কোপেনহেগেনের মাঠে আশঙ্কাজনকভাবে লুটিয়ে পড়তে দেখে তাঁর চোখে দুকূল ছাপিয়ে যখন জল এল, তখন সেই জল ঝটিতি হয়ে দাঁড়ালো বিপণনের অন্যতম পণ্য; ইউরো কাপের যাবতীয় স্বত্ব কয়েক হাজার কোটি টাকায় কেনা টেলিভিশন কোম্পানিগুলি মুহূর্তকাল অপেক্ষা না করে সাবরিনার অশ্রুসজল মুখের ছবি নির্দ্বিধায় ছড়িয়ে দিলেন সারা বিশ্বে। লাইভ কভারেজ। আধুনিক সাংবাদিকতার সবচাইতে নির্মম ও শাণিত অস্ত্র; যার সুতীক্ষ্ণ আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া যায় যাবতীয় ব্যক্তিগত মান, মর্যাদা, প্রতিরোধ। সেই অমোঘ পাশুপতে বধ হলেন সাবরিনাও।

আসলে বোধহয় ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হচ্ছে; কারণ অন্যরকম কিছু হবে, এমন আশা কি সত্যি কেউ করেছিল? হিসাব বলছে, এই ইউরো কাপ থেকে প্রায় এক হাজার মিলিয়ন ইউরো লাভ করবার আশায় আছে ইউরোপীয় ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা উয়েফা, যার একটা বিশাল অংশ আসবে টেলিভিশনের কাছ থেকে। এই কোভিডের ভরা বাজারেও যথেষ্ট বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে টুর্নামেন্টের পুরস্কার মূল্য। বিজয়ী দল ঘরে ফিরবে দশ মিলিয়ন ইউরো পুরস্কার মূল্য নিয়ে, রানার্স আপ দল পাবে সাত মিলিয়ন ইউরো। এ তো গেল প্রথম দুটি দলের কথা। শুধু ফাইনাল রাউন্ডে স্থান করে নেবার জন্য ২৪টি দলের প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ ৯.২৫ মিলিয়ন ইউরো। গ্রুপ লিগে প্রতিটা ম্যাচ জেতার পুরস্কার ১.৫ মিলিয়ন ইউরো, ড্র করলে তার অর্ধেক। দ্বিতীয় রাউন্ডে ১৬টি দলের আটটি জয়ী দল পাবে দুই মিলিয়ন ইউরো করে, কোয়ার্টার ফাইনালে জিতলে প্রাপ্য অঙ্ক ৩.২৫ মিলিয়ন ইউরো, সেমিফাইনালে পাঁচ মিলিয়ন ইউরো। এই বিশাল অঙ্কের টাকার বেশিরভাগটাই আসবে টেলিভিশন স্বত্ব থেকে। অতএব, টেলিভিশনই শেষ কথা।

যথেষ্ট আটঘাট বেঁধেই বাজারে নেমেছে উয়েফা। বহু আগে থাকতে পরিকল্পনা করে। আমস্টারডাম শহরের কাছে সুবিশাল জায়গা নিয়ে তৈরি হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্ট সেন্টার; ইউরো কাপের ৫১টি ম্যাচের লাইভ ফিড সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেবার কেন্দ্রবিন্দু। দিনরাত এক করে সেখানে কাজ করছেন এক হাজার কর্মী। ৩৫টি অত্যাধুনিক ক্যামেরায় ধরা পড়ছে প্রতিটি ম্যাচ, আকাশে হেলিকপ্টার থেকেও ছবি নিচ্ছে কয়েকটি ক্যামেরা। এছাড়া প্রতিটি স্টেডিয়ামে থাকছে আটটি করে ক্যামেরা, যাদের একমাত্র কাজ হল ম্যাচের বাইরে কী হচ্ছে, ক্রমাগত তার ছবি তুলে যাওয়া। সুতরাং, সাধ্য কি ডেনমার্কের বাকি খেলোয়াড়রা ঘিরে ধরে লুকিয়ে রাখবেন এরিকসেনের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ, আড়ালে চোখের জল ফেলবেন তাঁর প্রেয়সী? সবার উপরে টেলিভিশন সত্য….। টিআরপির নগ্ন হাতছানি আধুনিক পৃথিবীতে যৌনক্ষুধার ন্যায় তীব্র, তাকে অস্বীকার করা উয়েফার অসাধ্য।

সুখের কথা একটাই, সারা পৃথিবী থেকে তীব্র প্রতিবাদ এসেছে এই দস্তুরমত ইতর টেলিভিশন সম্প্রচারের বিরুদ্ধে। বিবিসির ইয়ান রাইট স্টুডিওর মধ্যেই চিৎকার করে বলে ওঠেন, “এসব হচ্ছেটা কী? এখনই বন্ধ করুন এই ছবি দেখানো।” সোশ্যাল মিডিয়ায় ইএসপিএনকে তুলোধোনা করেন বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষজন। তাঁদের বক্তব্য, একজন মানুষ জীবন মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে লড়াই করছেন, তাঁর প্রিয়জনেরা অসহ্য আবেগে ছারখার হচ্ছেন, আর আপনারা টেলিভিশনের পর্দায় এসব দেখিয়ে পয়সা লুটছেন? আপনাদের লজ্জা করে না? প্রতিবাদ এতটাই সজোরে আছড়ে পড়ে যে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয় বিবিসির মত সংস্থা।

কিন্তু ওটা তো ছিল কোপেনহেগেন, ইউরোপ। ফিরে আসা যাক আমাদের দীনদুঃখিনী মায়ের কাছে। সেখানে কি এই প্রতিবাদ গ্রাহ্য হত? কদিন আগেই আমরা দেখেছি ইয়াস আক্রমণে বিধ্বস্ত, এক হাঁটু জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের সামনে বুম নামক একটি বস্তু ধরে নির্বিকার ভঙ্গিতে প্রতিক্রিয়া দিতে অনুরোধ করা হচ্ছে।

আমরা দেখেছি করোনায় সদ্য স্বজন হারানো মানুষের বুকফাটা কান্না ভাবলেশহীনভাবে দেখানো হচ্ছে টেলিভিশনের পর্দায়, দিনের পর দিন, প্রতিবাদহীনভাবে। অথচ এই চোখের জলের উৎস কী, এই অতিমারির পিছনে দায়ী কোন অদৃশ্য হাত, সেই প্রশ্ন সুকৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন এই অত্যুৎসাহী মিডিয়াই। নরনারী নির্বিশেষে মানুষের ব্যক্তিগত শোকের পরিসরে ঢুকে তাকে জনসমক্ষে বেআব্রু করে দিতে এদেশে কোনও বাধা নেই, যত অনীহা শুধু সেই শোকের সামগ্রিক কারণ অনুসন্ধানে।

পশ্চিম দেশে একটা সুবিধা — সেখানে এখনও প্রতিবাদ করা যায়, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের জবাবদিহি করতে একপ্রকার বাধ্য করা যায়। এরিকসেনের ঘটনার সম্প্রচার নিয়ে সাফাই গাইতে আসরে নামতে হয়েছে স্বয়ং দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রডকাস্ট কোম্পানির বড়কর্তা জঁ জ্যাক অ্যামসেলেমকে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, তাঁদের এই সম্প্রচারকে যে এক ধরনের বিকৃত মানসিকতা বলে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা অতীব দুঃখজনক। তাঁর কথায়, “এরিকসেন যখন পড়ে যাচ্ছিলেন, তখন আমাদের ক্যামেরা স্লো মোশানে প্রতিটি মুহূর্ত তুলে রেখেছিল। আমরা কিন্তু সেগুলি মোটেই দেখাইনি। সেদিন মাঠে তিরিশটির বেশি ক্যামেরা ছিল। ইচ্ছা করলে আমরা ক্লোজ শটে মাঠের ভিতর এরিকসেনের যাবতীয় চিকিৎসা দেখাতে পারতাম। তেমনটা কিন্তু করা হয়নি। পরিবর্তে নির্দেশ ছিল এরিকসেনকে ঘিরে মাঠে উপস্থিত মানুষের যাবতীয় আবেগ দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হোক। তাই কখনও ডেনমার্কের ফুটবলার ও সমর্থকদের ওপর ক্যামেরা তাক করা হয়েছে, কখনো বা ফিনদের ওপর। উয়েফার কড়া নির্দেশ আছে, এই ধরনের ঘটনার ক্লোজ শট দেখানো চলবে না। আমরা সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, এই ঘটনায় স্টেডিয়ামে সবাই কতটা উদ্বিগ্ন, সেটা তুলে ধরা, আর কিছু নয়। যাক, এই নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ছেলেটি যে সুস্থ হয়ে উঠেছে, এটাই সবাইকে স্বস্তি দেবে।”

এই ধরি মাছ না ছুঁই পানি সাফাই আদতে কতটা স্বস্তি দেবে, তা বলা মুশকিল। তবে স্বীকার করা হোক আর না হোক, একটা কথা তো ঠিক — গত কয়েক দশকে অনেকটাই পরিবর্তনশীল এই পৃথিবী। মনুষ্যত্বের অপমানে অথবা ব্যক্তিচেতনায় আঘাত নেমে এলে সেই আগের মত প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন না অনেকেই। সেদিন এরিকসেনের ঘটনার কয়েক ঘন্টার মধ্যে ইউরো কাপের আর একটি ম্যাচে সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে যা ঘটল, তা আবার প্রমাণ করল বদলে গেছে দুনিয়া। ঐতিহাসিক শহর সেন্ট পিটার্সবার্গ; রাশিয়ার সাংস্কৃতিক রাজধানী, অক্টোবর বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু, ফ্যাসিস্ট আক্রমণের বিরুদ্ধে ৮৭২ দিনের এক কালজয়ী লড়াইয়ের সাক্ষী। অথচ সেদিন যখন বেলজিয়ামের ফুটবলাররা ম্যাচের আগে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে হাঁটু মুড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন, তখন দর্শকরা তাঁদের ভরিয়ে দিলেন তীব্র বিদ্রুপে, সমর্থনে একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না কেউ। বিক্ষুব্ধরা চটে মটে বলতেই পারেন ভাগ্যিস, শহরটার নাম আর আগের মত লেনিনগ্রাদ নেই! কিন্তু তাতে কীইবা এসে গেল! সুতরাং ধরেই নেওয়া যেতে পারে এরিকসেনকে ঘিরে টেলিভিশন সাংবাদিকতার নামে এই বাড়াবাড়ি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, ব্যক্তিমানসের ওপর এমনধারা উৎপাত চলছে ও চলবে। আর এদেশে যেহেতু আইনকানুনের প্রভাব ক্রমশ ক্ষীয়মান, টাকার সামনে মলিন হয়ে যায় যাবতীয় প্রতিরোধ, সেহেতু মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়ের সঙ্গে মাথায় তুলে নিতে হবে সাংবাদিকতার নামে টেলিভিশন চ্যানেলগুলির এই নির্লজ্জ আক্রমণও।

কিন্তু তবু, আজ থেকে বহু বছর বাদে, যেদিন এরিকসেন ও সাবরিনা সরে যাবেন এই ফুটবল নামক সর্বগ্রাসী উন্মাদনা থেকে বহু দূরে, তাঁদের চুলে পাক ধরবে, তাঁদের সন্তানসন্ততি ব্যস্ত হয়ে পড়বেন নিজেদের সন্তানদের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে, সেদিন এই দম্পতি যখন ফিরে দেখবেন এই ঘটনার রেকর্ডিং, তাঁদের একবারও কি মনে হবে না, কোন অপরাধে এই একান্ত নিভৃত ও পবিত্র শোক করে তোলা হয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষের তারিয়ে তারিয়ে উপভোগের বস্তু? “অথচ দেখো হৃদয় ছিল, হৃদয় থাকা কাল হল কি?” আজকের ভোগবাদী দুনিয়ায় হৃদয়ের স্থান কোথায়?

চিত্র সৌজন্য – উইকিপেডিয়া, News.de এবং Insider.com ওয়েবসাইট

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.